স্মৃতিকথায় কবি হালিম আজাদ
ইউসুফ আলী এটম
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০৮:০৭ পিএম, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ শনিবার
সত্তর দশকের অন্যতম শক্তিমান কবি হালিম আজাদ আমারও প্রিয় মানুষদের অন্যতম। আজ শনিবার (১১ সেপ্টেম্বর) তার জন্মদিন। প্রিয় কবি, আপনাকে জন্মদিনের ফুলেল শুভেচ্ছা। হালিম আজাদ সবার আগে একজন কবি তারপর একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক এবং সবশেষে সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে এক দুঃসাহসী প্রতিবাদী পুরুষ। পারিবারিকভাবে তিনি একজন সফল স্বামী ও দুই সন্তানের আদুরে পিতা। নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানাধীন মধ্যনগর গ্রামের ছেলে হালিম আজাদ তার লেখা দিয়ে, কথা দিয়ে, সর্বোপরি তার নজরকাড়া ব্যক্তিত্ব দিয়ে আমার মতো অনেককেই মুগ্ধ করেছেন।
একান্তভাবে আপন করে নিয়েছেন। বয়সে ছোট হলেও তোলারাম কলেজে পড়ার সময় থেকেই তার সাথে আমার সম্পর্ক অনেকটাই বন্ধুর মতো। যা এখনও অটুট রয়েছে। তিনি যখন আব্দুল হালিম থেকে হালিম আজাদ হলেন, তখন থেকেই যেন তার কলম গর্জে ওঠতে শুরু করে। হালিম আজাদের কলমের সূক্ষ্মডগা দিয়ে বেরুতে থাকে একর পর এক তরতাজা সুখপাঠ্য কবিতা। লিখিত হয় ছয়টি কাব্যগ্রন্থ, তিনটি মনমাতানো উপন্যাস, একটি হৃদয়কাড়া গল্পগ্রন্থ এবং গবেষণাধর্মী সাহিত্যবিষয়ক ত্রিশটি প্রবন্ধ। তার প্রথম উপন্যাস ‘দূর্বাঘাস আর গ্রেনেডের গল্প’ শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হিসেবে ‘আনন্দ আলো-চ্যানেল-আই’ পুরস্কার লাভ করে।
ওইসময় নারায়ণগঞ্জের আরো অনেকেই পরিবর্তিত নাম নিয়ে সাহিত্যচর্চ্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন। যেমন- এম,এ, রাব্বী স্বপন থেকে ‘ওয়াহিদ রেজা’, বজলুল করিম বাবলু থেকে ‘বজলুর রায়হান’, মোস্তাফিজুর রহমান স্বপন থেকে ‘নাহিদ আজাদ’, রেজাউল করিম বিক্রমপুরী থেকে ‘করীম রেজা’ পিয়ার আলী থেকে ‘আলী এহসান’, নাফিজুল ইসলাম আশরাফ থেকে ‘ নাফিজ আশরাফ’ এবং আমি মোঃ ইউসুফ আলী থেকে ‘ইউসুফ আলী এটম’ হয়ে গেলাম। বছর কয়েক আগে প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ওয়াহিদ রেজা আমাদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমালেও তিনি যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টিশীল কর্মের মাঝে।
তবে হালিম আজাদ তার সমসাময়িক অনেক কবি লেখককে পেছনে ফেলে উঠে যান খ্যাতির শিখরে। তার এই ঈর্ষণীয় সাফল্যে আমি নিজে যারপরনাই আনন্দ ও গর্ব অনুভব করি। কারণ হালিম যখন সাহিত্যাঙ্গনে হাঁটি হাঁটি পা পা করছিলেন তখন তার সাথে আমি ইচ্ছে করেই ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকার বিভিন্ন সাহিত্যসভায় যেতে উৎসাহ দিতাম। কোন কোন সময় অনেকটা জোর করেই আমাদের সাথী করতাম। বিনা পয়সায় নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্রেনে চড়ে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গিয়ে সাহিত্যসভায় নিজেদের লেখা পাঠ করতাম। পঠিত লেখার ওপর ওইসময়ের প্রতিষ্ঠিত কবি ও লেখকদের গঠনমূলক আলোচনা এবং সমালোচনা শোনে নিজেদের লেখা নিজেরাই পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে নিতাম। বলা চলে, এভাবেই নিয়মিত অনুশীলন ও চর্চ্চার মধ্যদিয়ে একজন আব্দুল হালিম আজকের হালিম আজাদ হয়েছেন।
সাহিত্য সংগঠন করতে গিয়ে হালিমের সাথে আমার খুনসুটির কথাটিও এ মুহূর্তে মনে পড়ে গেলো। ‘৭৮ সালের দিকে বিশিষ্ট সাংবাদিক শ্রদ্ধেয় ফজলুল বারী’র পরিচালনায় নারায়ণগঞ্জের সামাজিক ও সাহিত্য সংগঠন ‘অক্ষর’ খুবই শক্তিশালী ছিলো। উক্ত সংগঠনে ওয়াহিদ রেজা, হালিম আজাদ, বজলুর রায়হান, বাকী বিল্লাহ, করীম রেজা, আলী এহসান, আ,খ শামসুল আরেফিন প্রমুখের সাথে আমিও সক্রিয় ছিলাম। অক্ষরের তত্ত্বাবধানে তখন নিয়মিত সাহিত্যসভা হতো। এসব সাহিত্যসভায় ঢাকা থেকে অনেক প্রতিষ্ঠিত কবি সাহিত্যিক অংশ নিতেন। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে পরিচালিত বাংলা ভাষার ওপর একটি জরিপ রিপোর্ট ও ‘ভাষাকার্ড’ প্রকাশের পর অক্ষর জাতীয়ভাবে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। নানা কারণে অক্ষর নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে ওয়াহিদ রেজা ও হালিম আজাদ ‘ড্যাফোডিল’ নামে একটি নতুন ধারার রুচিশীল ও মানসম্পন্ন পত্রিকা বের করেন।
বেশকিছু নতুন ও পুরানো মুখের সাথে আমিও ড্যাফোডিলের সাথে যুক্ত হই। খুব স্বল্পসময়ের ব্যবধানেই ড্যাফোডিল সুধীমহলের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়। ‘৭৯ সালে ড্যাফোডিল এফিউশন গ্রুপ তখন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিশিষ্ট কবি ও ছড়াকারদের লেখায় সমৃদ্ধ সংকলন ‘পৃথিবীর কাছে নোটিশ’ বের করে দেশব্যাপী আলোড়ন তোলে। ওই সংকলনে আমার লেখা ‘বদলা নেবো খুনের’ শিরোনামে ছড়া প্রকাশিত হয়েছিলো। কয়েকদিন পর গোয়েন্দাদের নজরদারিতে থাকা আমাকে একদিনের হাজতবাস করতে হয়েছিলো। ঢাকায় সংকলন বিলি করতে যেয়ে আমার গ্রেফতারের খবর নারায়ণগঞ্জে পৌঁছলে অনেকেই তাদের ঘরে রাখা সংকলন লুকিয়ে ফেলেন। অনেকে পুড়িয়ে ফেলেন বা পানিতে ফেলে দেন। এ ঘটনার পর মতাদর্শসহ আরো কিছু কারণে আমরা কয়েকজন ড্যাফোডিল ছেড়ে ‘দারুচিনি’ প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেই। এতেই প্রচন্ড ক্ষেপে যান হালিম আজাদ।
তিনি ওয়াহিদ রেজার সাথে শলাপরামর্শ করে আমাকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এক সন্ধ্যায় তারা দু’জন আমাকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করতে আমলাপাড়ার এক বাসায় (যেখানে আমি ছাত্র পড়াচ্ছিলাম) গিয়ে চড়াও হন। কিন্তু তাদের এই পাগলামীর কথা আঁচ করতে পেরে আগে থেকেই আশপাশে থাকা দারুচিনি’র অশোক গুহ, গৌতম রায় এবং সম্ভবত নাহিদ আজাদ তাদেরকে নিবৃত্ত করেন। একথা মনে হলে আজও আমি ফিক করে হেসে ফেলি।
লেখক: সাংবাদিক ও ছড়াকার ইউসুফ আলী এটম, ইমেইল: ুড়ঁংঁভধঃড়স@মসধরষ.পড়স