যমদূতের পাতা মৃত্যুফাঁদ যেন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথ
সায়মুন ইসলাম
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০৫:২৫ পিএম, ১৮ জুন ২০২২ শনিবার
# মোট ২৫টি লেভেলক্রসিংয়ের মধ্যে ১৫ টি অরক্ষিত
# সামান্য এদিক-সেদিক হলেই লাইনচ্যুত হচ্ছে ট্রেন
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথ ছিল রেলের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। অথচ কালের পরিক্রমে এই রেলপথ তার জৌলুস হারিয়েছে। ১৩৭ বছর পুরোনো ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ রেল পথ যেন পরিনত হয়েছে যমদূতের পাতা এক মৃত্যু ফাঁদে। উদ্বোধনের পর এ পথে আধুনিকতার ও ঐতিহ্যের ছোঁয়া থাকলেও তা এখন তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। চরম অব্যবস্থাপনায় চলাচলের কারণে সামান্য এদিক সেদিক হলেই লাইনচ্যুত হচ্ছে ট্রেন। অরক্ষিত লেভেলক্রসিং (রেললাইন পারাপার) এর কারণে হরহামেশাই হচ্ছে দুর্ঘটনা।
১৮ কিলোমিটার এই দীর্ঘ রেলপথে মোট ২৫ টি লেভেলক্রসিং রয়েছে। যার মধ্যে ১৫ টি অরক্ষিত। এসব অরক্ষিত লেভেলক্রসিং এর ফলে দুর্ঘটনা যেন নিত্যদিনের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে নেই কোনো বেরিয়ার, নেই কোনো গেইটম্যান। এর মধ্যে গলাচিপা, বালুরমাঠ ও নন্দনালপুর অন্যতম। ৫/৬ টার লেভেলক্রসিং এ বেরিয়ার থাকলেও তা উঠানামার জন্য নির্দিষ্ট লোক নেই। এগুলো উঠানো নামানোর কাজ করে স্থানীয়রাই । পাগলা, আলিগঞ্জ, ফতুল্লার কয়েকটি লেভেলক্রসিং এর মধ্যে অন্যতম। এর ফলে দূর্ঘটনার গতি ঊর্ধ্বমুখী। বাকি ১০ টির বেরিয়ার ও গেইটমেন থাকলেও দূর্ঘটনা থেমে নেই। এর কারণ হিসেবে গেইটম্যান দের সময়মতো নির্দিষ্ট জায়গায় অনউপস্থিতীকে দায়ি করছেন স্থানীয়রা।
যার জ্বলন্ত উদহারণ গতকাল (১৬ জুন) শহরের ২ নং রেলগেট এলাকায় চলন্ত ট্রেনের ধাক্কা লেগেও অল্পের জন্য রক্ষা পায় রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি কভার্ডভ্যান। এছাড়াও ২৬ ডিসেম্বর শহরের ১ নং রেলগেইট এ ট্রেনের ধাক্কায় দুমরে মূচরে যায় আনন্দ পরিবহনের একটি বাস। সেখানে শিশুসহ নিহত হন ৩ জন। এছাড়াও গত ২ মার্চ ফতুল্লার শাহ-জাহান রোলিং মিল এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে সিরু এক যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।এর আগে ২৮ জানুয়ারি একই স্থানে লিটন নামের আরেক যুবকের মৃত্যু হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত ১ মাসে এই একই স্থানে ৩ জনের প্রানহানী ঘটেছে। বেরিয়ার এবং গেইটম্যান থাকার পরও এমন দুর্ঘটনা ঘটায় শঙ্কিত স্থানীয়রা।। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি রেলক্রসিং এবং এখানে গেইটমেন থাকা সত্ত্বেও এ ধরণের দুর্ঘটনা ঘটলে যেই লেবেলক্রসিং গুলোতে গেইটম্যান নেই সেগুলো কতটা ঘাতক তা সহজেই আচঁ করা যায়। ফতুল্লা, আলীগঞ্জ, পাগলা, চাষাড়াসহ বিভিন্ন স্থানে ট্রেনে কাটা পড়ে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। ঘটছে ছোট বড় দুর্ঘটনা।
সূত্রের অভিযোগ রয়েছে, লেভেল ক্রসিংয়ে গেট নির্মাণ এবং তিনজন নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগের খরচ বহন করার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।অরক্ষিত এসব লেভেলক্রসিংগুলো নিয়মিত পরিদর্শনের নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে,আর কত দুর্ঘটনার পর টনক নড়বে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ রেলষ্টেশনের ষ্টেশন মাস্টার কামরুল ইসলাম যুগের চিন্তাকে জানান, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথে ৮ জোড়া ট্রেন নিয়মিত চলছে।
আমাদের আওতায় সর্বমোট ৪ টি লেবেলক্রসিং আছে যার মধ্যে ২ টি রক্ষিত আর ২ টি অরক্ষিত। বাকি গুলো চাষাড়া, ফতুল্লা, পাগলা, শ্যামপুর ও কমলাপুর রেলওয়ের ষ্টেশনমাস্টারের আওতাধীন। তিনি আরোও জানান, লেভেলক্রসিংয়ের বিষয়গুলো আগে তাদের সাথে সংযুক্ত থাকলেও বর্তমানে ডাবল রেললাইন প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় বিষয়টি আপাতত তারা তদারকি করছেন না। কেবল বৈধ লেভেলক্রসিং এর দায়িত্বে থাকা গেইটম্যানদের তারা বেতন প্রদান করছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গিয়েছে, রেললাইন ঘেষেঁ প্রচুর অবৈধ দোকানপাট। এমনকি রেললাইনের পাশে ও উপরেও বাজার বসতে দেখা গেছে। যার ফলে প্রচুর লোক সমাগম হয়। সময়মতো সরতে না পারার কারণে দূর্ঘটনার কবলে পড়ে সাধারন মানুষ। তবে রেললাইনের পাশে এভাবে দোকানপাট কার ইশারায় বসে? কারা সুবিধাভোগ করে এইসব দোকান বাজার থেকে। তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে এলাকাবাসী। তারা মনে করেন এসব দোকানপাট, হাঁট-বাজার উচ্ছেদ করা হলে দূর্ঘটনা অনেকটাই কমে যাবে।
এ পথে চলাচল করা নওসিন আক্তার সামিয়া যুগের চিন্তাকে জানায়, রেল দুর্ঘটনার জন্য অনেকটাই গেইটম্যান দায়ী। তারা যথাসময়ে উপস্থিত না থাকার কারণে বেশিরভাগ দুর্ঘটনাগুলো হয়। এছাড়াও যানবাহন গুলো প্রতিযোগিতা করে চলাচল করে তারা রেলক্রসিং পার হতে চায়। কিন্তু মাঝে মাঝে আটকে গিয়ে দূর্ঘটনা কবলিত হয়।
তিনি আরোও জানান, রেল দুর্ঘটনা কমাতে সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের উচিত সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কোনো কর্মসূচি গ্রহন করা।
রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের বিষয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ প্রস্তুতি নিয়েছে। দ্রুতই এর সমাধান হবে। রেলপথের চারপাশে ব্যারিকেড দেয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে চায়না কোম্পানির সাথে চুক্তি হয়েছে।এমই/জেসি