সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১   ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ঘাটতি থাকলে ভোগান্তি বাড়াবে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু

লতিফ রানা

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৬:৫৯ পিএম, ২৫ জুলাই ২০২২ সোমবার

 

# সেতুর খুটির নকশায় ত্রুটির কারণে বাড়ছে নৌ-দুর্ঘটনা
# পরিকল্পনায় সমন্বয়হীনতার কারণে নির্মাণ মেয়াদ এবং ব্যায় বেড়েছে
# নির্মাণের দীর্ঘ এক যুগেও হয়নি সংযোগ সড়কের পরিকল্পনা

 


শীতলক্ষ্যার নকশার ত্রুটির বিষয়টি শুরু থেকেই আলোচনা সমালোচনা হতে থাকলেও বিষয়টি গুরুত্বের সাথে উঠে আসে গত বছরের ৪ এপ্রিল তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর কাছাকাছি একটি লঞ্চ দুর্ঘটনায় ৩৪ জনের প্রাণ হানির পর। সে সময় সেতুর নকশায় ত্রুটির কথা উল্লেখ করে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী শীতলক্ষ্যা নদীতে আরও লঞ্চ দুর্ঘটনার আশঙ্কা করেছিলেন (পরবর্তীতে ঘটেও ছিল দুর্ঘটনা)। 


সে সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন ‘সেতুর যে ছবিটি দেখেছি, এমনি এটি হচ্ছে সবচেয়ে ব্যস্ত নৌরুট। নদীতো আমাদের ছোট হয়ে আসছে বিভিন্ন কারণে, সেখানে আরও বেশি ছোট করে দেওয়ার ক্ষেত্রে এই যে সেতুর পিলার দুটি স্থাপন করা হয়েছে। পিলার দুটি দৃষ্টি সীমানায় বাধা দিতে পারে। এটা আমি জানি না, তবে তদন্তে বেরিয়ে আসবে। আবার সেখানে পাশাপাশি এই পিলার দুটি থাকার কারণে যে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে আমার আশঙ্কা, ভবিষ্যতে আরও দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে পারে শুধু এই নকশার (সেতুর নকশা) কারণে। মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা করব, যাতে না হয়।’ এর আগে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার সভাপতি মাহবুব উদ্দিন (বীর বিক্রম) বলেন, ‘নদীর উপরে একটি সেতু রয়েছে। সেতুর পিলারগুলো এমনভাবে বসানো হয়েছে যা লঞ্চ চলাচলের ক্ষেত্রে দৃষ্টির প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে।’ তখন থেকেই সেতুর নকশার ত্রুটির বিষয় উঠে আসে।


সেতুটির পরিকল্পনার ঘাটতির কারণে ছোট একটি সেতু নির্মাণে লেগে যায় প্রায় এক যুগ সময়, ব্যায় বেড়ে হয়ে যায় প্রায় দ্বিগুন। অন্যদিকে সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকলেও এখনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি সেতুর পূর্ব পারের বন্দর উপজেলার মদনগঞ্জ-মদনপুর সড়কের দীর্ঘ প্রায় ১৪ কিলোমিটার সড়কের প্রশস্তকরণ কাজের। কমপক্ষে চারলেনে উন্নীত হওয়ার কথা থাকলেও সেই প্রকল্পের কোন উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। এখন আবার সড়কের দুই পাশের তিন ফুট করে ছয় ফুট সড়ক প্রশস্তকরণ কাজ শুরু করার চিন্তা ভাবনা চলছে বলে জানা যায়।


তবে সেই প্রকল্পও কবে নাগাদ বাস্তবে রূপ নিবে তারও কোন হদিস নেই। অন্যদিকে খুব শীঘ্রই সেতুটি যানবাহন চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হবে বলে সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে। সড়ক প্রশস্তকরণ সম্পন্ন করার পূর্বে ছয়লেনের এই তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করা অনেকটা মরার উপর খারার ঘা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করেন সচেতন মহল। দীর্ঘ ১২ বছর আগে সেতু নির্মাণের প্রস্তাব পাস হলেও এর মধ্যে এর অন্যতম সংযোগ সড়ক মদনগঞ্জ-মদনপুর সড়কটির বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়াই সম্ভব হয়নি। কাজ সমাপ্ত হওয়াতো পরের কথা। তাই সেতুর শুরু থেকেই পরিকল্পনায় ঘাটতি এবং সমন্বয়হীনতার কারণে অনেক দুর্ভোগ এবং ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। তাই নতুন করে পরিকল্পনায় ঘাটতির কারণে আর যেন কোন নুতন ভোগান্তির সৃষ্টি না হয়।
 
এমনিতেই শহর সংলগ্ন হওয়া বন্দর উপজেলা একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এখানে রয়েছে বসুন্ধরা সিমেন্ট, আকিজ সিমেন্ট, সিমেক্স সিমেন্ট, সামিট পাওয়ার প্লান্ট, এসিআই ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, নৌবাহিনী পরিচালিত নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড, মেরিন ইনস্টিটিউট, তিন শতাধীক তুলা কারখানা, খাদ্যগুদামসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা। এসব প্রতিষ্ঠানের ভারি যানবাহন পরিবহনের জন্য এই সরু সড়কটি সবসময়ই খুব ব্যস্ত থাকে। অন্যদিকে ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর বন্দরে আসাকে কেন্দ্র করে  এই সড়কটি সর্বশেষ মেরামত করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান। এরপর মেরামতের লোক দেখানো কিছু কাজ দেখানো ছাড়া সড়কটি স্থায়ী মেরামতের আর কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিকল্প কোন ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়েই দুর্ভোগ আর ঝুঁকির মধ্যে চলাচল করতে হচ্ছে এখানকার জনসাধারণ ও যানবাহনকে।


এরই মধ্যে সড়কের কার্পেটের টেম্পার নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পুরো রাস্তা খোদাই করে নতুন কার্পেট না করলে কার্পেটিং করে কোন ফল পাওয়া যাবে না বলে সওজের পক্ষ থেকে জানানো হয়। তৃতীয় শীতলক্ষ্যাকে কেন্দ্র করে রাস্তাটি প্রশস্তকরণ কাজ করার সময় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে কাজটি করা হবে বলে আর সংস্কারও করা হয়নি। তাই যেখানে এই বন্দরে যানবাহনের ভারই নিতে পারছে না এই সড়কটি তা কীভাবে দেশের প্রায় অর্ধেক এলাকার যানবাহন চলাচলের ভার সইবে, সেই বিষয়টি সেতু নির্মাণ শুরু থেকেই কর্তৃপক্ষের ভাবা উচিৎ ছিল বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সচেতন মহল।


অন্যদিকে এই সড়কের অবস্থিত সরু সেতুগুলো স্থানীয় যানবাহনের চলালের জন্যই অনুপযোগী। এর মধ্যে বন্দর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ত্রিবেণী সেতু এবং জিউধরার নাসিকের ময়লার ডাম্পিং সংলগ্ন সেতু বহু আগে থেকেই স্থানীয় কারখানার ভারি যানবাহন চলাচলের জন্য বিপদজনক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এছাড়াও লক্ষণখোলা সেতু ও ইস্পাহানী সেতুসহ এখানকার সবগুলো সেতুই খুব সরু। তাছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাথে এই সড়কটির মিলনস্থলের জায়গা মদনপুর মোড়ে মিশুক, অটোরিকশা, সিএনজি, স্কুটার ও রিকশার অবৈধ স্ট্যান্ড তৈরির মাধ্যমে সড়কের বিশাল একটি অংশ দখল হয়ে যাওয়ার ফলে যানজট এখানকার নিত্য সঙ্গী।
 
এই বিষয়ে বন্দর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান সানাউল্লা সানু বলেন, আমি মনে করি একটি সেতু হওয়ার সাথে সাথে সেতুর সাথের যে অবকাঠামো, তার সাথে সমন্বয় করতে হবে। সেতুর কাজ যদি সম্পন্ন করেন, আর সংযোগ যদি ঠিক না থাকে তাহলে তো আপনিও সেতুর করে লাভ হবে না। তাই সেতু করার সাথে সাথে সেতুর সাথে সম্পর্কযুক্ত সড়কটি প্রশস্ত করতে হবে এবং সংস্কার করতে হবে। যেন দুটি গাড়ি একসাথে চলাচল করতে পারে, আপডাউন করতে পারে। এখন যদি দেখা যায় একটি গাড়ি আসলে আরেকটি গাড়ি থেমে থাকে, রাস্তা-ঘাট যদি ভাঙ্গা থাকে, তাহলে সেতুর সৌন্দর্য্যও নষ্ট হবে মানও নষ্ট হবে।


এজন্য সেতুর প্রকৌশলী ও যারা কর্মকর্তা আছেন তাদের সার্বিক দিক দিয়ে চিন্তা করতে হবে। যেন সেতুর সাথে সাথে এর সম্পর্ক আছে এমন বিষয়গুলোর দিকেও নজর দেওয়া হয়। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর করার সাথে সাথে যেমন নদী শাসন ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেতু তৈরীর সাথে সাথে মাওয়া রাস্তাটি প্রশস্ত করা হয়েছে এবং সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে। তেমনি এই নাসিম ওসমান সেতু চালু করার জন্য রাস্তাঘাট প্রশস্ত করতে হইবো কার্পেটিং করতে হবে। যাতে দুটি গাড়ি খুব সহজেই আসা যাওয়া করতে পারে, এবং যানবাহন চলাচল করতে সহজ হয়। কিন্তু যদি দেখা যায় আমি সেতু তৈরি করলাম কিন্তু সেতুর সম্পর্কিত কাজগুলো সম্পন্ন হলো না তাহলে সে মান দুর্বল হয়ে যায়।
 
বন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবিএম কুদরত-এ-খুদা জানান, আমি যতটুকু জানতে পেড়েছি এনডিএন এর আওতায় সড়কটির দুই পাশে ৫ফুট করে ১০ ফুট বাড়ানোর একটি চিন্তা ভাবনা আছে। এর আগে সওজের পক্ষ হতে ৩ফুট করে দুই পাশে ৬ফুট বাড়ানো হবে বলে জানানো হয়েছে উল্লেখ করলে তিনি বলেন, এই সড়কটির চার লেনে উন্নীত করার জন্য যেহেতু জমি অধিগ্রহণ করা আছে। তাই এখন দুই পাশে সামান্য প্রশস্ত করণের জন্য বিদ্যুতের খুটি সরাতে হবে, জমি দখল নিতে হবে, দোকানপাট উচ্ছেদ করতে হবে। পরে আবার যখন ৪ লেনে উন্নীত করা হবে তখন এই একই কাজ আবারও করতে হবে। তাছাড়া পঞ্চবটি থেকে সেতু পর্যন্ত সড়কটিও যেহেতু ৪ লেনে উন্নীত করা হচ্ছে, তাই একদিকে ৪ লেন হলে কিন্তু অন্যদিকে যদি না হয় তাহলে মানুষ খুব বেশি সুবিধা পাবে না। তাই এখন যদি একেবারে ৪ লেনে উন্নীত করা হতো তাহলে মনে হয় সেতু তৈরি সুফলটা পুরোপুরি পাওয়া যেত। তিনি জানান, পদ্মা সেতু যেহেতু চালু হয়ে গেছে এবং নদীর পশ্চিম পার যেহেতু ৪ লেন হয়ে যাবে, তাই আমাদের এই পাশে ৪ লেন না হলে আমরা পরিপূর্ণ সুবিধাটা পাবো না। এক সাথে হয়ে গেলে মানুষের দুর্ভোগও কমবে এবং সেতু করার যে মূল উদ্দেশ্য সেটা ৪ লেন হইলেই পাওয়া যাবে। যেহেতু এই সড়কটি ভবিষ্যতে ৪ লেন করতেই হবে, তাই আমরা চাই যদি একেবারে করা যায় তাহলে মানুষের দুর্ভোগ অনেক কম হবে।এমই/জেসি