যাত্রীদের সাথে ঘাট ইজারাদারদের প্রজার মতো আচরণ
নীরব প্রকাশ
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০৭:১৩ পিএম, ২৯ জুলাই ২০২২ শুক্রবার
# কিছুদিন পরপরই যাত্রী লাঞ্ছিতের ঘটনা ঘটছে
# জিম্মি ও নির্যাতিত যাত্রীরা
প্রজা শব্দটি ইংরেজী টেনান্ট শব্দের বাংলা রূপ, যার আরেকটি অর্থ ভাড়াটিয়া। অন্যদিকে ইংরেজী সিটিজেন শব্দের অর্থ নাগরিক। তাই প্রজা এবং নাগরিক শব্দের অর্থের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। ১৭৫৭ সালে ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধে যখন ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়, তখন থেকে প্রায় ২০০ বছর ভারতবর্ষের জনগণ ইংরেজদের দ্বারা শাসিত ও শোষিত হয়েছে। সে সময় পরাধীন এই ভারতবর্ষ ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় জমিদারদের কবলে ছিলেন বিভিন্ন ধর্ম ও শ্রেণি পেশার মানুষ। সেসব শাসকদের চোখে সাধারণ মানুষরা ছিল প্রজা। সে সময় প্রজা মানেই লোমহর্ষক নানা বঞ্ছনার শিকার।
সেই সমাজ ব্যবস্থায় রাজা আর প্রজার মধ্যে এতই পার্থক্য ছিল যে, প্রজাকে তারা চাকর হিসেবে ব্যবহার করতো। তাদের উপর সেসব শাসকরা নিজেদের স্বার্থে জোর পূর্বক তাদের নিজেদের ইচ্ছে চাপিয়ে দিত এবং প্রজাদের কষ্টে তারা তৃপ্তি অনুভব করতো। কোন জমিদার নিরীহ প্রজাদের উপর কতটা স্টীম রোলার চালাতে পারে কতটা কব্জায় নিতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলতো। প্রজাদের যে বেশি নিপীড়ন করতে পারতো সে-ই ততো বড় জমিদার হিসেবে বিবেচিত হতো। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের প্রচেষ্টায় ইংজেদের বিতারিত করা হয়েছে ৮০ বছর হয়ে গেছে। এরপর ১৯৭১ সালে বর্বর ও হানাদার হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানী শাসক বাহিনীর হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। অথচ এই আধুনিক সভ্যতায় এই স্বাধীন দেশে এখনও সেই জমিদারী ভূত রয়ে গেছে অনেকের মধ্যে।
বিশেষ করে শহর এলাকা, যেখানে শিল্প প্রতিষ্ঠান বা কর্মসংস্থান বেশি, সেখানকার লোকেরা গ্রাম বা মহল্লার লোকদেরকে প্রজা মনে করে। আর নিজেদের ভাবতে শুরু করেন রাজা। এরা যখন স্থানীয় কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির সান্নিধ্য লাভ করে তার শীষ্য হতে পারে তাহলেতো কথা-ই নেই। তেমনি একটি অবহেলিত এলাকা নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর এলাকা। শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পারের এই এলাকাটি এখনও নারায়ণগঞ্জ শহরের কিছু প্রভাবশালী শীষ্যদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। এতটাই জিম্মি যে, না পারছে কিছু বলতে না পারছে কিছু করতে। এরকম রাজা প্রজার দৃশ্যটি যেখানে বেশি রকমভাবে ফুটে উঠে তাহলো বন্দরবাসীর যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম খেয়াঘাটগুলোতে।
প্রতিদিন কর্মসংস্থান ও জীবিকার তাগিদে লক্ষ লক্ষ বন্দরবাসীকে নদী পার হয়ে খেয়াঘাট পার হয়ে শহরে আসতে হয়। এসব খেয়াঘাটের ইজারাদাররা বেশিরভাগ হয় শহরের। ফলে তারা ইচ্ছেমতো টোল আদায়, অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে লোকজন পারাপার, ঘাট পারাপারে বিভিন্ন ভোগান্তি থাকলেও বোবার মতো মেনে নিতে হয়। যখন অত্যাচারের মাত্রা অতিরিক্ত হয়ে উঠায় সহ্য করতে না পারে তখন হয়তো হঠাৎ করেই প্রতিবাদী হয়ে উঠে। আর তার ফলাফলে হতে হয় মারধরের শিকার, থানা পুলিশের হয়রানি একই সাথে ঘাট দিয়ে পুরো বন্দরবাসীর চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। যার সর্বশেষ গত মঙ্গলবারের ঘটনাটি।
খেয়াঘাটের ভোগান্তির বিষয়ে বন্দর খেয়াঘাটের যাত্রী গার্মেন্টস কর্মী শিমুলী আক্তার বলেন, আমরা সপ্তাহের ৬দিনই এই ঘাট দিয়ে যাওয়া আসা করি। কোন কোন সময় কারখানা খোলা থাকার কারণে শুক্রবারও আমাদের যাওয়া আসা করতে হয়। এখানে যারা ট্রলারের টাকা তুলে (টোল আদায়কারী) তারা যাত্রীদের সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করে। প্রায়ই তারা অর্ধেক ট্রলার বন্ধ রেখে অর্ধেক ট্রলার চালায়। এতে করে গাদাগাদি করে ট্রলার ডুবোডুবো অবস্থায় নদী পারি দিতে হয়। তাদেরকে জানালে তারা বলে, ইচ্ছে হলে নদী পার হও না হলে পার হইওনা। অনেক সময়ই অনেককে তারা মারপিট করে আবার অনেককেই বলতে শুনি দেখি তোকে কে পার করে। এখানে ভোগান্তি সব সময়ই থাকে তবে এখনকার লোকদের ব্যবহার খুবই খারাপ।
হোসিয়ারী শ্রমিক সিদ্দিক মিয়া বলেন, কথায় কথায় তারা (টোল আদায়কারীরা) গায়ে হাত তুলেন, ট্রলার বন্ধ করে দেন। এই পারে আসা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি প্রদান করেন। তিনি বলেন, একজন মানুষের ভাড়া হিসেবে ২ টাকা টোল নেন, যা আগে ছিল ৫০ পয়সা। একটি টিভি মেরামত করার জন্য ঘাট দিয়ে নিয়ে আসলে তার কাছ থেকে ৩০ থেকে ৫০টাকা জোর পূর্বক রাখা হয়। না দিতে চাইলে টিভি-ই রেখে দিতে চায়। হাতে করে একটি সেলাই মেশিনের হেড নিয়ে পার হওয়ার সময় সেসব মহিলা কিংবা পুরুষদের কাছ থেকে ২০ থেকে ৩০ টাকা করে রাখা হয়। এছাড়া মুরগি, হাঁস কিংবা ছোট কোন প্যাকেট নিয়ে নদী পারাপারের সময়ে ওজন ছাড়াই ইচ্ছে মতো টাকা আদায় করে তারা। কেউ প্রতিবাদ করলে যাত্রিদের শায়েস্তা করতো গুন্ডা সেজে। বাজারের থলি একটু বড় হলে তার জন্যও আলাদা টাকা জমা দিতে হয়।
গত মঙ্গলবারের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রহিমা খাতুন বলেন, ঘটনার সময় সে ইসদাইর এলাকায় তার বোনে বাসায় যাচ্ছিলেন। যে ছেলেটিকে তারা ২ টাকার জন্য মারধর করেছে সে বারেবারে বলতেছিল যে একা, তাই ২টাকা দিয়েছে। কিন্তু তবুও তাকে মারধর করা হয়েছে। উল্টো তাকেই নাকি আবার পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, যারা টাকা তুলেন তাদের প্রতিদিনের অত্যাচারে মানুষের মনে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে সেই ক্ষোভ থেকেই জনগণ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছে। তিনি আরও বলেন, টোল আদায়কারীরা নাকি বলেছেন, কয়েকশত লোক মিলে তাদের উপর হামলা চালিয়েছে। যতটুকু জানতে পেরেছি সেই ছেলেটির এত অল্প সময়ের মধ্যে এত লোক জড়ো করার সাধ্য নাই। তারমানে যারা প্রতিবাদ করেছে নিজেদের উৎসাহেই করেছে। প্রতিদিন তাদের মধ্যে একটু একটু করে ক্ষোভ জমা হওয়ার কারণে তার সবাই প্রতিবাদ মুখর হয়েছে।
অন্যদিকে এই বিষয়ে একটি বাধাধরা নিয়ম করে দেওয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসন কিংবা জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসা উচিৎ বলে মনে করেন বন্দর বাসী। তাদের অভিযোগ, এই স্বাধীন দেশের বাসিন্দা হয়েও জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন তাদের এই নদী পার হয়ে শহরে আসতে হয় বলে এখানকার লোকেরা তাদের সাথে প্রজার মতো আচরণ করে। শুধু বন্দর খেয়াঘাটই নয়, শহর সংলগ্ন প্রতিটি খেয়াঘাট কিংবা ফেরিঘাটেই শহরবাসীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বন্দর বাসী। তাদের অর্থ ও ক্ষমতার দাপটে বন্দরবাসীকে তারা মানুষ বলে মনেই করতে চায় না বলে অভিযোগ করেন তারা।এমই/জেসি