শ্রমিকের ছদ্মবেশে ঢুকে বোমা মেরে কুমুদিনী পাটগুদাম ধ্বংস করেছিলাম
বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম জন্টু
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০৯:৪৩ পিএম, ৯ ডিসেম্বর ২০২২ শুক্রবার
একাত্তরে ডিসেম্বর মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরার জন্য এই বিজয়ের মাসে ‘দৈনিক যুগের চিন্তা’য় একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কাহিনী তুলে ধরা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম ঝন্টুর লেখা খানপুরে কুমুদিনী পাট গুদাম বোমা হামলা করে ধ্বংস করার কাহিনী।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম জন্টু : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নারায়ণগঞ্জে একটি বড় অপারেশন ছিল খানপুরে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের পাটের গুদাম বোমা হামলা করে ধ্বংস করা। সেই অপারেশনে আমি একজন যোদ্ধা ছিলাম বলে এখনও গৌরব বোধ করি। আমরা মাত্র দুইজন মুক্তিযোদ্ধা সেই অপারেশনটি করেছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ সাউদ।
আমরা দুজন, মোহর আলী এবং ইসমাইল হোসেন একই সাথে ভারতে আগরতলায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্র চালনা এবং বোমা তৈরি ও তা নিক্ষেপ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেয়ার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। দেশে ফিরে এসে আমরা বেশ কিছু অপারেশন করেছিলাম। তাতে নারায়ণগঞ্জে অবস্থানকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল।
কারণ নারায়ণগঞ্জ ছিল শিল্পসমৃদ্ধ শহর, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এখানে এসে বিভিন্ন কলকারখানায় কাজকর্ম এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করতো। তাছাড়া নারায়ণগঞ্জ ছিল পাট ব্যবসার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শহর। এমন একটি শহরে পাকিস্তান সেনাদের বিরুদ্ধে অপারেশন করা সহজ সাধ্য ছিলনা। কিন্তু আমরা আন্তরিকতা ও অসীম সাহস দিয়ে সে অপারেশন করে সফল হয়েছিলাম।এর ফলে পাকিস্তানী সৈন্যরা বুঝে গিয়েছিল যে, মুক্তিযোদ্ধারা অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ফলে তাদের মধ্যে ভয় ঢোকাই স্বাভাবিক।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছিলাম ঢাকা কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র। ২৫ মার্চ পাকিস্তান বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষনার পর বিভিন্ন এলাকা থেকে তরুণ-যুবকরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য প্রশিক্ষন নিতে ভারতে চলে যেতে শুরু করে। আমাদের নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলেও অনেক রাজনৈতিক কর্মী এবং ছাত্র-যুবক ভারতে চলে যান। এমন পরিস্থিতিতে আমিও ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষন নেয়ার সিদ্ধান্ত নেই।
আমার ভারত যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানাতেই মজিদ সাউদ আমাকে আরো উৎসাহ দেয়। একদিন আমরা-আমি, মজিদ সাউদ, মোহর আলী ভাই ও ইসমাইল ভাই এক সঙ্গে ভারতের দিকে রওয়ানা হই। সেখানে পৌছে আমরা এলাকার আরো অনেকের দেখা পাই। তাদের সঙ্গে আমরা মেলাঘর এলাকায় প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যাই। সেখানে যুদ্ধের বিভিন্ন অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষন দেয়া হয় আমাদের।
প্রশিক্ষন শেষ হলে আমাদের দেশের ভিতরে এসে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়। সে নির্দেশ অনুযায়ী আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নিয়ে নিজ এলাকা গোদনাইলে চলে আসি। আরো কয়েকটি মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ তখন ভারতে প্রশিক্ষন নিয়ে এলাকায় ফিরে এসেছিল। তারা সবাই বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে একের পর এক অপারেশন করতে থাকি। এরই একটি অপারেশন ছিল কুমুদিনী পাট গুদাম বোমা মেরে ধ্বংস করা।
প্রশিক্ষণ নিয়ে নারায়ণগঞ্জে ফেরার পর কিভাবে পাকিস্তানীদের উপর হামলা করা যায় এবং কিভাবে ওদের ক্ষতি করা যায় তা নিয়ে প্রায়ই ভাবতাম। তখনই আমাদের মাথায় একটি বুদ্ধি আসে। তা হলো পাকিস্তান বাহিনীকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়া। আর এটা সম্ভব হবে নারায়নগঞ্জ থেকে পাট রপ্তানী বন্ধ করে দিতে পারলে।
আমরা যদি পাট গুদামগুলো বোমা মেরে ধ্বংস করে দেই তবেই পাট রপ্তানী করা আর সম্ভব হবেনা। এতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়া যাবে। অর্থনৈতিক ভাবে যদি পাকিস্তান বাহিনী পর্যদস্ত হয়ে যায় তখন তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধ করার মনোবল এবং সাহস হারিয়ে ফেলবে।
নারায়ণগঞ্জ তখন পাট ব্যবসার জন্য অত্যন্ত বিখ্যাত এবং শীতলক্ষ্যা পাড়ে অনেকগুলো জুটমিল ও পাট রপ্তানি কেন্দ্র ছিল। এইসব পাটকলগুলোতে পাটের অনেক গোডাউন ছিল, যেখানে হাজার হাজার মন পাট জমা করে রাখা হতো এবং এখান থেকে জাহাজে করে চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম থেকে বিদেশে রপ্তানি করা হতো।
আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, নারায়ণগঞ্জ থেকে পাট রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার জন্য পাটের গুদামগুলো ধ্বংস করে দেবো। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা প্রথম খানপুরে অবস্থিত কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের পাট গুদাম বোমা মেরে ধ্বংস করে দেয়ার পরিকল্পনা করি। সে অপারেশনে আমার সাথে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ সাউদ।
কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের পাটের গুদাম ধ্বংস করার অপারেশন করার আগে আমরা কয়েকদিন সেই এলাকা রেকি করি। আমরা তখন সেই গোডাউনগুলোতে কাজ করে এমন শ্রমিকের ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলাম। সেই গুদামে কাজ করা শ্রমিকদের মত আমরা খালি পায়ে লুঙ্গি পড়ে দুইদিন সে এলাকা ঘুরে কোথায় কোন পাটের গুদাম আছে এবং কোন গুদামে বেশি পরিমান পাট আছে সেটা রেকি করি।
রেকি করার সময় অত্যন্ত সাবধানে ছিলাম,কারণ যদি আমাদের কেউ চিনে ফেলে যে আমরা পাট গুদামের শ্রমিক নই তাহলে হয়তো আমাদেরকে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে ধরিয়ে দেবে। আমরা শ্রমিকের ছদ্মবেশে সেই এলাকায় দুইবার ঘোরাঘুরি করে গোডাউনগুলো পর্যবেক্ষণ করি।
পরে আমরা দুইটি পাট গুদাম নির্ধারণ করি যেখানে আমরা বোমা মারবো। এরপর একদিন আমরা সকাল দশটা এগারোটার দিকে কোমরে বোমা লুকিয়ে খালি পায়ে গ্রামের লোকদের মত লুঙ্গি ও জামা পড়ে গোডাউন এলাকায় প্রবেশ করি। সেখানে গিয়ে আমরা বুঝতে পারলাম যে দুপুরের দিকে লোকজন কাজ বন্ধ করে গোডাউন এলাকা থেকে বেরিয়ে দুপুরের খাবারের জন্য যার যার বাসায় এবং আশেপাশে চলে যায়।
তখন পুরো এলাকাতে লোকজন খুব একটা থাকেনা এবং নীরব হয়ে যায়। আমরা এই সুযোগটি কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করে হাঁটাহাঁটি করে সময় ক্ষেপণ করি। ঘড়িতে দুপুর ১টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সবাই গোডাউন থেকে বেরিয়ে আশে পাশের বাসায় চলে যায় দুপুরের খাবার গ্রহনের জন্য। তখন আমি একটি গোডাউনের দিকে যাই আর আব্দুল মজিদ যায় অন্য আরেকটি গোডাউনের দিকে।
যে দুটি গোডাউন আমরা ধ্বংস করার জন্য নির্ধারণ করেছিলাম সেই গোডাউনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম গোডাউনের ভিতরে কোন শ্রমিক নেই। এই সুযোগে আমরা কোমরে থাকা ফসফরাসের বোমা সরাসরি গোডাউনের ভিতরে ছুড়ে মারলাম। আমাদের সৌভাগ্য যে, আমাদের ছুঁড়ে দেয়া দুটি বোমাই পাটের গুদামে অনেক পাটের স্তুপের মধ্যে গিয়ে পড়ে এবং বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। বোমা বিস্ফোরণের পর পরই গোডাউনে আগুন ধরে যায় এবং দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করে।
বোমা নিক্ষেপ করার পর আমি আস্তে আস্তে হেঁটে গোডাউন এলাকা থেকে বেড়িয়ে মেট্রো সিনেমা হলের রাস্তায় চলে আসি। আসার সময় কিছু লোক আমার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। কিন্তু কেউ কিছু বলেনি। একজন শ্রমিক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল কি ভাই গোডাউনে ভিতরে আগুন লাগল কিভাবে। আমি কোন কথা না বলে, কাউকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে বেড়িয়ে আসি।
আমি যে দিক দিয়ে গোডাউন এলাকা থেকে বেড়িয়ে যাই সেই এলাকা দিয়ে মজিদ বের হয়নি, সে নিজেকে আড়াল করার জন্য, যাতে কেউ বুঝতে না পারে এজন্য সে অন্য গেট দিয়ে গোডাউন এলাকা থেকে বেড়িয়ে আসে। কে কোন দিক দিয়ে বেরুচ্ছি তা আমরা দুইজনও ভালোভাবে বুঝতে পারিনি। আমি গোডাউন এলাকা থেকে বেরিয়ে মেট্রো হলের সামনে দিয়ে খানপুরের দিকে চলে যাই।
খানপুর থেকে আমি রেললাইন ধরে হেঁটে আমাদের এলাকায় চলে আসি। আসতে আসতে আমি টের পাচ্ছিলাম যে, বোমার আওয়াজের কারণে মানুষ বুঝে গেছে যে, মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে বোমা নিক্ষেপ করেছে। বোমার আওয়াজের পরপরই লোকজন ভয়ে যে যেদিকে পারে দূরে চলে যেতে থাকে। এরপর আমরা নিশ্চিত হই যে, আমাদের অপারেশন সফল হয়েছে।
সেই অপারেশনের পর নারায়ণগঞ্জে অবস্থানকারী পাকিস্তান বাহিনীর মধ্যে কিছুটা ভীতি দেখা দিয়েছিল। তারা ভাবতে পারেনি এত নিরাপদ এলাকায় গুদামে মুক্তিযোদ্ধারা বোমা হামলা করতে পারে। আমাদের যে পরিকল্পনা ছিল তার সফল বাস্তবায়ন হয়েছে ভেবে আমরা বেশ আনন্দিত হয়েছিলাম। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর যখন মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অপারেশনগুলোর কথা ভাবি তখন মনের পর্দায় ভেসে ওঠে সেই বোমা মেরে গুদাম ধ্বংস করার স্মৃতি।
এস.এ/জেসি