শনিবার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১৪ ১৪৩১   ২৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

যুদ্ধাহত সেই মুক্তিযোদ্ধার করুণ চেহারা এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে

বীর মুক্তিযোদ্ধা কমলা রাণী কর

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৮:২৮ পিএম, ১০ ডিসেম্বর ২০২২ শনিবার

 

একাত্তরে ডিসেম্বর মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরার জন্য এই বিজয়ের মাসে ‘দৈনিক যুগের চিন্তা’য় একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কাহিনী তুলে ধরা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা কমলা রানী কর (লক্ষ্মী চক্রবর্তী)’র  লেখা ভারতের ত্রিপুরার আগরতলা জিবি হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার কাহিনী।  

 

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা কমলা রাণী কর : ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা ছিল নারায়ণগঞ্জ এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল। মুক্তিযুদ্ধকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে পালিয়ে ভারতে যাওয়া শত শত মুক্তিযোদ্ধার প্রথম ঠিকানা হয়ে ওঠেছিল আগরতলা। আর যুদ্ধে আহত হওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বাঁচানোর প্রথম ঠিকানা ছিল আগরতলার জিবি হাসপাতাল। জিবি হাসপাতাল চিকিৎসা দিয়ে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার জীবন বাঁচিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জন এবং স্বাধীনতার ৫২ বছর পর মনে হয় একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের দুঃসময়ে আগরতলার জিবি হাসপাতাল, সেখানকার চিকিৎসক-সেবিকারা যে অবদান রেখেছে তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

 

 

আর একজন মুক্তিযোদ্ধা সেবিকা হিসেবে সেই হাসপাতালে দীর্ঘদিন দেশের বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে আহত হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার যেমন জীবন বাচিয়েছি তেমনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তরের গভীর থেকে যে ভালবাসা পেয়েছি তা জীবনের কখনো ভুলতে পারবোনা। মনে হয় একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সেই ভালবাসাই আমার জীবনের পাথেয় হয়ে আছে। স্বাধীনতার এত বছর পরও সেই জিবি হাসপাতালের মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেয়ার দিনগুলোর কথা মনে হলে আনন্দ-বেদনার আবেগে মনটা ভরে ওঠে। বিশেষ করে একজন আহত তৃষ্ণার্ত মুক্তিযোদ্ধার ডাব খেতে চাওয়া এবং তাকে ডাব খেতে দেয়ার আগেই তার শহীদ হওয়ার করুন কাহিনী এখনো ভুলতে পারিনা।

 

 

একাত্তরে আমি ছিলাম  ১ নম্বর ঢাকেশ্বরী কটন মিলস উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী। আমার বাবা নলিনী রঞ্জন কর ঢাকেশ্বরী কটন মিলের বড়বাবু ছিলেন, তিনি বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহন করেছিলেন। মা আশা লতা করও বৃটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। আমি তাঁদের একমাত্র সন্তান। আমরা মিলের স্টাফ কোয়ার্টারে থাকতাম। তখন আমিও ছাত্র রাজনীতি করতাম। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের সময় থেকে প্রতিটি আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষনের পর থেকেই ১ নম্বর ঢাকেশ্বরী মন্দিরের মাঠে আমরা ঢাকেশ্বরী হাই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী ও যুবকেরা অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছি। প্রশিক্ষনের জন্য মিলের নিরাপত্তার জন্য রাখা অস্ত্র অফিসাররা আমাদের দিতেন।

 

 

একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানীদের গণহত্যা শুরুর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। এরপরই এলাকার ছাত্র-যুবক ও রাজনৈতিক নেতারা মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষন নেয়ার জন্য ভারতে যাওয়া শুরু করেন। ২৭ মার্চ আমরা চলে যাই আমাদের গ্রামের বাড়ি মুন্সগীঞ্জের গজারিয়াতে। সেখান থেকে এপ্রিল মাসে কুমিল্লার দাউদকান্দি, ফুলতলা, দেবীদ্বার হয়ে ভারতের ত্রিপুরায় যাই। সেখানে  বিশালগড় হাইস্কুলে গিয়ে উঠি। বিশালগড় থেকে আমাদের শরণার্থী কার্ড দেওয়া হয় এবং সূর্যমণি নগর ক্যাম্পে পাঠানো হয়। বাবা সেখান থেকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি লেখেন বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের পরিচয় দিয়ে। কয়েকদিন পর ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন সিংহের কাছে চিঠির উত্তর আসে। মুখ্যমন্ত্রী শচীন সিংহ সরকারি লোক পাঠিয়ে দ্রুত আমাদের স্পেশাল ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। আমার বাবা, শচীন সিংহ, কবি নজরুল, রবি নাগ এঁরা সকলে বৃটিশবিরোধী আন্দোলন একসাথে কারাগারে ছিলেন। সেই কারনেই আমরা এত আদর-যত্ন পেয়েছিলাম।

 

 

সেই ক্যাম্পে এক পর্যায়ে নারায়ণগঞ্জের খাজা মহিউদ্দিন এবং ফরিদা মহিউদ্দিনসহ নারায়ণগঞ্জের অনেকের সঙ্গে আমাদের  দেখা হয়। সেই ক্যাম্পেই তাঁরা উঠেছিলেন। সেই ক্যাম্পে আমরা যেসব মেয়ে ছিলাম তাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য নেতাদের অনুরোধ করি। কিন্তু সেখানে নারীদের জন্য রাইফেল ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা  করার সমস্যা থাকায় বিশেষ প্রয়োজনে নার্সিং স্কোয়াড গঠন করা হয়। আমরা সেই নার্সিং স্কোয়াডে যোগদান করি। এরপর আমার ট্রেনিং হয় জিবি (গোবিন্দ বল্লভ) হাসপাতালে। জিবি ও ভিএম হাসপাতালের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন রথীন দত্ত। নির্বিঘ্নে আমরা মেয়েরা ট্রেনিং নিতে পেরেছিলাম। ট্রেনিংয়ের পর আমাদের জিবি এবং ভিএম হাসপাতালে  বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে নিয়োগ দেওয়া হয়। আমাদের কাজ ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক পরিচর্যা করা।

 

 

দেশের ভিতরে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে যে সব মুক্তিযোদ্ধা আহত হতেন তাদের জিবি হাসপাতালে নিয়ে আসা হতো চিকিৎসার জন্য।  যুদ্ধে আহত হয়ে কেউ দুই পা হারিয়েছে, কেউ এক হাত পা, কেউ দুই হাত হারিয়েছে- সে যে কী মর্মান্তিক দৃশ্য বলে বোঝাতে পারবো না। তাদের সব কাজ আমাদের  করতে হতো।  তবে সব থেকে কঠিন কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ানো। আহত মুক্তিযোদ্ধারা কেউ ঠিকমতো খেতে পারতেন না। প্রায় সময়ই মুক্তিযোদ্ধারা চিৎকার করে কান্নাকাটি করতেন। আমাদের দেখেও অনেক সময় হাউমাউ করে কেঁদে বলতেন, আমারওতো তোমার মতো একটা বোন ছিল, যাকে পাকিস্তানের মিলিটারিরা নিয়ে গেছে। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেই কান্না সহ্য করা অত্যন্ত কঠিন ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হাসপাতালে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হতো। আমাদের দেখে তাঁদের দুই চোখ বেয়ে নামতো জলের ধারা, কাঁদতে কাঁদতে বলতেন, কবে দেশ স্বাধীন হবে?

 

 

একদিন আমরা ডিউটি শেষ করে চলে আসবো; ঠিক সে সময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যুদ্ধাহত এক সৈন্যকে আনা হলো জিবি হাসপাতালে। আমরা তাকে তাৎক্ষনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে গিয়ে দেখি পাকিস্তান বাহিনীর মর্টারের আঘাতে তাঁর ফুসফুস চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাকে বাচানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। যতক্ষন তার জ্ঞান ছিল ততক্ষনই সে চিৎকার করে বলছিল, আমি ডাবের পানি খাবো। ডাব খেতে চেয়ে সে যেভাবে আর্তচিৎকার করছিল তা দেখে কষ্টে আমাদের সবারই চোখ ভিজে যায়। অনেকে কান্না লুকানোর জন্য অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখি। তাকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাকে কিছুটা সুস্থ্য করা হয়।

 

 

পরদিন আমরা কয়েকজন মিলে নিজেদের টাকা দিয়ে কয়েকটি ডাব কিনে হাসপাতালে ডিউটি করতে যাই। ডাব নিয়ে তার বেডের কাছে যেতেই দেখি সেই মুক্তিযোদ্ধা আর বেঁচে নেই। তার মরদেহ সাদা চাদরে ঢেকে রাখা হয়েছে। এ দৃশ্য দেখে আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। সবারই চোখের জল এসে যায়।

 

 

আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ে পঞ্চাশ বছর অতিক্রম করেছি, স্বাধীন দেশে জীবনযাপন করছি। কিন্তু আজও সেই মুক্তিযোদ্ধার করূণ চেহারা ভুলতে পারিনা। প্রায় তার চেহারা আমার সামনে ভেসে ওঠে, আজও বীর যোদ্ধার কণ্ঠটি আমার কানে বাজে। সেই মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়ে ডাব খেতে চেয়েছিল কিন্তু আমরা তাকে ডাব খাওয়াতে ব্যর্থ হয়েছি,তার আগেই সে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। সেই কষ্ট ভুলতে আমি এরপর আর কখনো ডাব খাইনি।

 

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে পরাধীনতার কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে মুক্তিযুদ্ধে করেছি, বিজয় অর্জন করে স্বাধীন হয়েছি। একদিকে স্বাধীনতা রক্ষা, অন্যদিকে  সেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্ন পূরণ করে সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলাই এখন আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

এস.এ/জেসি