শনিবার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১৪ ১৪৩১   ২৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রান্সফর্মার ধ্বংসের পর পাকিস্তান বাহিনী অন্ধকারে থাকতে বাধ্য হয়

বীর মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইসলাম কেতা

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৮:০৭ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর ২০২২ সোমবার

 

একাত্তরে ডিসেম্বর মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরার জন্য এই বিজয়ের মাসে ‘দৈনিক যুগের চিন্তা’য় একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কাহিনী তুলে ধরা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইসলাম কেতা-এর  লেখা মুক্তিযুদ্ধে বার্মাশেল তেল ডিপোর কাছে বিদ্যুতের একটি ট্রান্সফর্মার ধ্বংস করার কাহিনী।  

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইসলাম কেতা :  মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত সাহসের সাথে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন করেছি। কিন্তু একটি অপারেশনের সাফল্যের স্মৃতি আমি এখনো ভুলতে পারি না। সেই অপারেশনটি ছিল গোদনাইলের বার্মাশেল তেলডিপোর অদূরে বিদ্যুতের একটি ট্রান্সফর্মার ধ্বংস করা। ট্রান্সফর্মারটি ধ্বংস করার পর বার্মাশেল তেলডিপোতে পাকিস্তান বাহিনীর ক্যাম্প এবং পুরো এলাকা চারদিন অন্ধকারে ডুবে ছিল। সেই কয়েকদিন পাকিস্তান বাহিনী সন্ধ্যার পর ভয়ে ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে যেতে পারেনি। পাক বাহিনী রাতে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে গণহত্যা এবং জ্বালাও-পোড়াও করত, তা অনেক কমে গিয়েছিল। সেটাই ছিল আমাদের জন্য বড় সাফল্য। সেই ট্রান্সফর্মার ধ্বংস করার অপারেশনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলাম আমি। সেটা আমার জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয় ছিল।

 

১৯৭১ সালে আমি ছিলাম বেকার যুবক। স্কুলে পড়াশোনা শেষ করার পর তখনো কোন চাকুরীতে যোগ দেইনি। এরই মধ্যে ২৫ শে মার্চের সপ্তাহ খানেক আগে আমাকে বিয়ে করিয়ে দেন আমার বাবা। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রশিক্ষনের জন্য ভারত যাব যাব করেও যাওয়া হচ্ছিল না। ২৫ শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরুর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। ২৮ শে মার্চ পাকিস্তান বাহিনী বিপুল অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে নারায়ণগঞ্জে প্রবেশ করেই হত্যা-জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে। সেই দিনই পাকিস্তান বাহিনী গোদনাইলে বার্মাশেল তেলডিপোতে ক্যাম্প স্থাপন করে। এই বার্মাশেল তেলডিপো থেকেই ঢাকা শহরে যানবাহন এবং বিমানের জ্বালানি সরবরাহ করা হতো। ঢাকা সেনানিবাসের সব জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হতো এই বার্মাশেল তেলডিপো থেকেই। ফলে বার্মাশেল তেলডিপোর নিরাপত্তা রক্ষা করা পাকিস্তান বাহিনীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এজন্য পাকিস্তান আর্মি প্রথমেই সেখানে ক্যাম্প করে অবস্থান নেয়।

 

পাকিস্তান বাহিনী বার্মাশেল ডিপোতে ক্যাম্প করার পরপ সেই এলাকায় চরম হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং তেলডিপোর চারপাশের বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়। এটা তারা করেছিল এ কারণে যে, তাদের অত্যাচার নির্যাতনে এলাকায় কোন লোক যাতে বসবাস করতে না পারে। এবং মুক্তিযোদ্ধারা যাতে তাদের উপর কোন হামলা করতে না পারে।  আমার বাড়ি ছিল বার্মাশেল তেলডিপো থেকে অল্প একটু দূরে। পাকিস্তান বাহিনী এলাকায় চরম নির্যাতন শুরু করলে আমি পরিবার-পরিজন নিয়ে জালকুড়ি গ্রামে চলে যাই। জালকুড়ি গ্রামটি তখন ছিল বিলের মাঝে বিচ্ছিন্ন একটি এলাকা। সেখানে রাস্তাঘাট খুব একটা ছিল না, ক্ষেতের আল এবং হালট দিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে যেতে হতো। ফলে পাকিস্তান বাহিনীর জন্য সেই এলাকাটা ছিল খুবই দুর্গম। এই সুযোগ নিয়েই অন্যান্য গ্রাম থেকে লোকজন এবং ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা মুক্তিযোদ্ধারা জালকুড়ি গ্রামে অবস্থান করতেন।

 

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর আমাদের এলাকার বড় ভাই ইসমাইল মিয়া যিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন, তিনি চাকরি ছেড়ে মুক্তিবাহিনীকে যোগদান করেন। তিনিসহ এলাকার অনেক যুবক তার নেতৃত্বে ভারতে চলে যান এবং সেখানে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপারেশন করতে শুরু করেন। একদিন আমি গোপনে বাড়িতে এসে ঘরদোর কেমন আছে দেখাশোনা করার পর জালকুড়ির দিকে যাচ্ছিলাম। গোদনাইল-জালকুড়ি রাস্তার মাঝামাঝি স্থানে গিয়ে দেখি সেখানে ইসমাইল ভাই, মোহর ভাই এবং আদমজির সুন্দর আলী বসে আছেন একটি ব্রিজের উপর।  আমাকে দেখে তারা বলেন, কিরে কই যাচ্ছিস তুই? আমি বললাম যে জালকুড়িতে পরিবারের কাছে যাচ্ছি।

 

তারা তখন আমাকে বলে যে, তোকে আমাদের সাথে একটি অপারেশন করতে হবে। কি অপারেশন না জেনেই আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই। ইসমাইল ভাই আমাকে কি করতে হবে বুঝিয়ে দেন। তিনি বলেন, বার্মাশেল রাস্তার মাথায় নারায়ণগঞ্জ-আদমজী সড়কের পাশে একটি বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মার আছে, সেই ট্রান্সফরমার থেকে বার্মাশেল তেলডিপোসহ ওই এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিলে তারা এই এলাকায় অত্যাচার নির্যাতন করতে ভয় পাবে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, আদমজী-নারায়ণগঞ্জ সড়কের পাশের বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মারটি বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হবে।

 

ইসমাইল ভাই ও মোহর ভাই আমার উপর দায়িত্ব দেন বিস্ফোরক নিয়ে সেই ট্রান্সফরমারের নিচে ফিট করার। সেই ট্রান্সফর্মারটির পাশেই আদমজী-নারায়ণগঞ্জ সড়ক এবং তার পাশে ওয়াপদার ক্যানেল। আদমজী-নারায়ণগঞ্জ সড়কে তখন যানবাহন খুব কম চলাচল করতো। কিছুক্ষণ পরপরই আদমজী মিল,বার্মাশেল এবং আশেপাশের বিভিন্ন কারখানায় স্থাপিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থেকে সৈন্যরা গাড়িতে করে নারায়ণগঞ্জ-আদমজী সড়কে টহল দিত। টহল দেয়ার সময় তারা সামনে যাকে পেত গুলি করে মেরে ফেলত, অনেককে আবার ধরে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে মেরে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দিত।

 

যে ট্রান্সফারটি ধ্বংস করার পরিকল্পনা করা হয় সেটি ছিল নারায়ণগঞ্জ-আদমজী সড়কের পূর্ব পাশে। সড়কের পশ্চিম পাশে ওয়াপদার ক্যানেল এবং তারপর জালকুড়ি বিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী ইসমাইল ভাই জালকুড়ি গ্রাম থেকে এক্সক্লুসিভ নিয়ে এসে আমাকে বুঝিয়ে দেন। তারা তখন ওয়াপদা ক্যানেলের পশ্চিমপাশে লুকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। আমি তাদের কাছ থেকে এক কেজি পরিমাণ বিস্ফোরক নিয়ে খুব সাবধানে ক্যানেলের পশ্চিমপাড় থেকে ভাঙ্গারপুল হয়ে উত্তর দিকে হেঁটে গিয়ে রাস্তার পাশে বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মারটির ভিতরে স্থাপন করি। প্রায় আধাঘন্টা সময়ের ফিউজ বিস্ফোরকের সাথে যুক্ত করি। তারপর ফিউজের মধ্যে আগুন দিয়ে আমি দ্রুত ট্রান্সফর্মারের কাছ থেকে সরে আসি। সরে আসার পর আমাকে দক্ষিণ দিকে হেঁটে তারপর হালট দিয়ে পশ্চিমে জালকুড়ি বিলের দিকে যেতে হবে।

 

কিন্তু বিস্ফোরক স্থাপন করার পর পাকিস্তান  বাহিনীর কোন গাড়ি যদি নারায়ণগঞ্জ-আদমজী সড়ক দিয়ে টহল দিতে আসে তাহলে আমাকে সড়কের মধ্যে দেখে ফেলবে এবং ট্রান্সফর্মারের মধ্যে বিস্ফোরক পেয়ে যাবে। এরফলে পাকিস্তান বাহিনী আমাকে ফায়ার করে মেরে ফেলতে পারে। এই ভয়ে আমি জালকুড়ি যাওয়ার জন্য দক্ষিণ দিকে হেঁটে ভাঙ্গার পুল দিয়ে পশ্চিম পাশে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে বিস্ফোরক ফিট করার পরপরই সড়কের পাশে ওয়াপদা ক্যানেলের পানিতে নেমে যাই এবং কয়েক মিনিট সাঁতার কেটে পশ্চিম পাশে বিলের কিনারে হালটে গিয়ে দাঁড়াই।  ইসমাইল ভাইরা তখন সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি ঠিকভাবে বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মারে বিস্ফোরক স্থাপন করে নিরাপদে চলে এসেছি, এটা জানতে পেরে তারা আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরেন। এরপরই আমরা দ্রুত জালকুড়ির দিকে হাঁটা শুরু করি। কয়েক মিনিট পরেই বিকট শব্দে সেই ট্রান্সফর্মারে বিস্ফোরণ ঘটে এবং ট্রান্সফর্মারটি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মাটি থেকে কয়েক গজ উপরে উঠে আবার মাটিয়ে পড়ে।

 

সেই অপারেশনটি সফল হওয়ায় আমরা অত্যন্ত গৌরববোধ করেছিলাম। সেদিন ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরণের বিকট শব্দ পুরো এলাকায় সবাই শুনেছে। ইতিমধ্যে পাকিস্তান বাহিনী ও বার্মাশেল এবং আদমজী ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনারাও এই আওয়াজ পেয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে টান্সফর্মারের দিকে দ্রুত আসতে থাকে। কিন্তু আমরা ততক্ষণে জালকুড়ি বিলের অনেকটা পথ পেরিয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে আসতে সক্ষম হই। সেই বিদ্যুৎ ট্রান্সফর্মারটি ধ্বংস করার পর পুরো এলাকা অন্ধকারে ডুবে যায় এবং আশেপাশে বিভিন্ন শিল্পকারখানায় পাকিস্তান বাহিনীর যে ক্যাম্প ছিল তারাও অন্ধকারে মধ্যে থাকতে বাধ্য হয়।

 

এর ফলে পাকিস্তানিরা অনেকটা ভয় পেয়ে যায়, তারা নিশ্চিত হয় যে এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা অত্যন্ত সক্রিয়। সেই অপারেশনের পর পাকিস্তানিরা যখন তখন বাইরে বেরিয়ে এলাকায় অত্যাচার নির্যাতন করা এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনা অনেক কমে গিয়েছিল। প্রায় ৪দিন পর পাকিস্তানীরা প্রকৌশলী এনে সেই বিদ্যুত লাইন সচল করে। তবে মুক্তিযোদ্ধারা আবার বোমা মেরে ধ্বংস করে দিতে পারে সেই ভয়ে সেখানে আর ট্রান্সফর্মার স্থাপন করা হয়নি। সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুত লাইন সরাসরি বার্মাশেল ডিপোতে নিয়ে যাওয়া হয়। এত বছর পর সেই অপারেশনটির কথা মনে হলে আজও সেই অপারেশনের একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মনের গভীরে গৌরবোধ জেগে ওঠে।

এস.এ/জেসি