আহত সহিদুল্লাহ আমার পিঠে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে
বীর মুক্তিযোদ্ধা শুকুর মাহমুদ
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০৮:৩২ পিএম, ২১ ডিসেম্বর ২০২২ বুধবার
একাত্তরে ডিসেম্বর মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরার জন্য এই বিজয়ের মাসে ‘দৈনিক যুগের চিন্তা’য় একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কাহিনী তুলে ধরা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা শুকুর মাহমুদের লেখা মুক্তিযুদ্ধে সহিদুল্লাহ সাউদের শহীদ হওয়ার কাহিনী।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শুকুর মাহমুদ : একাত্তরে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রায় মৃত্যুর মুখে পড়েছিলাম। পাকিস্তান বাহিনী আমাকে বেয়নেট চার্জ করেছিল। কিন্তু আল্লাহর অশেষ কৃপায় রক্ষা পেয়েছি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বলতে হয়, সেই দিন আমার পিঠে তুলে আমাদের এলাকার মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল্লাহকে নিয়ে পিছিয়ে আসার সময় সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। পাকিস্তানিদের গুলিতে শহীদুল্লাহ পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। তার দুই পা গুলীতে ঝাঝড়া হয়ে গিয়েছিল। সেটা আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা।
৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি আদমজী জুট মিলে কাজ করতাম। পাশাপাশি ছোটখাটো ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলাম। সে সময় আমাদের এলাকার সোবহান ভাই, হযরত ভাই আশেক আলী মাস্টার প্রমুখ নেতার সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। তারা রাজনীতি করতেন, আমি রাজনীতি করতাম না কিন্তু তাদের সাথে চলাফেরার কারণে রাজনীতির প্রতি কিছুটা ঝোক ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে সোবহান ভাই, হযরত ভাইসহ এলাকার সিনিয়ার ভাইয়েরা মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। তখন আমিও মুক্তিযুদ্ধের চলে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করি।
একদিন আমি কিছু জিনিস কেনার জন্য নারায়ণগঞ্জের কালিবাজারে যাই। সেখানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার সময় হঠাৎ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি সেখানে আসে থামে। আমি তাকিয়ে দেখি গাড়িতে কয়েকজন মেয়ে বসা, পরে জানতে পারি বিভিন্ন এলাকা থেকে এই যুবতী মেয়েদের ধরে এনেছে এবং তারা তাদেরকে নিয়ে জাহাজে তুলে নির্যাতন করার জন্য নিয়ে যাচ্ছে। এ কথা জানার পর আমার মনের মধ্যে ক্ষোভ জেগে ওঠে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেই, এই অসভ্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদেরকে যুদ্ধ করতেই হবে। সেদিন বাসায় ফিরেই আমি পরিকল্পনা করতে থাকি মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য আগরতলা চলে যাওয়ার।
একদিন সকালবেলা বাবার কাছ থেকে ব্যবসার মালামাল কিনব বলে ৫০ টাকা নেই। সেই ৫০ টাকা নিয়েই আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে নবীগঞ্জ ও কাইকারটেক হয়ে বৈদ্যের বাজার লঞ্চঘাটে যাই। সেখান থেকে রামচন্দ্রপুরগামী লঞ্চে উঠে বসি। লঞ্চের মধ্যেই হঠাৎ দেখি আমাদের এলাকায় সোবহান ভাই, হযরত ভাই প্রমুখ। তারা দ্বিতীয়বার আগরতলা যাচ্ছিলেন। আমি তাদেরকে পেয়ে অনেকটা আশ্বস্ত হই এবং ভয়ও কেটে যায়। তাদের সাথে কখনো হেঁটে কখনো নৌকায় আমরা ত্রিপুরায় সীমান্তে যাই।
ত্রিপুরা সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করার পরই আমরা সোজা আগরতলায় গিয়ে হোস্টেলে উঠি। আগে থেকেই সেখানে আমাদের এলাকার অনেকেই ছিলেন। সেখানে কয়েকদিন থাকার পর আমাদেরকে অন্য আরেকটি ক্যাম্পে পাঠানো হয়। সেখান থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য আসামের তেজপুর সেনানিবাসে পাঠানো হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসাররা আমাদের প্রশিক্ষণ দেন। আমাদের যে সমস্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তার মধ্যে ছিল রাইফেল, স্টেনগান, এসএলআর, এলএমজি ইত্যাদি।
এছাড়াও কিভাবে বিভিন্ন ব্রিজ কনভার্টে বিস্ফোরক রেখে ধ্বংস করে দিতে হবে তারও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আমরা প্রশিক্ষণ নিয়ে আবার আগরতলায় ফিরে আসি। আগরতলায় কয়েকদিন বিশ্রাম নেয়ার পর আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে যার যার এলাকায় চলে যাওয়ার জন্য। আমাদের গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন ইয়াফেস ওসমান (এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী)। আমরা বাংলাদেশের প্রবেশ করার আগে ভৈরব নামক একটি স্থানে সমবেত হই। পরিকল্পনা ছিল যে, আমরা কুমিল্লার বেতিয়ারা গ্রাম হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বিভিন্ন এলাকায় চলে যাবো।
ভৈরব টিলা থেকে রাত নয়টা-সাড়ে নয়টার দিকে আমাদের বাংলাদেশে প্রবেশ করার নির্দেশ দেয়া হয়। তার আগে স্থানীয় কয়েকজন লোক, আমরা যেখান দিয়ে প্রবেশ করব, সে এলাকা রেকি করে এসে জানায় যে, পথে কোন বিপদ নেই। আমরা ভৈরব টিলা থেকে নেমে লাইন ধরে ক্ষেতের আল দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দিকে যেতে থাকি। ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওঠার কয়েক মিনিট আগে, প্রায় ১০০ গজ দূরে থাকতেই হঠাৎ পাকিস্তানিরা আমাদের উপরে গুলিবর্ষন শুরু করে। আমরা বুঝতেই পারিনি যে পাকিস্তানিরা আমাদের সামনে এমবুস করে আছে।
পাকিস্তানীদের গুলিবর্ষণ শুরুর পর আমরাও আমাদের অস্ত্র থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করি। এভাবে পাকিস্তান বাহিনীর সাথে আমাদের প্রায় এক ঘন্টা গোলাগুলি হয়। এরপর পাকিস্তানিরা গুলিবর্ষণ বন্ধ করলে পিছন থেকে আমাদের একজন সংকেত দেন কলিং করে পিছিয়ে যাওয়ার জন্য। সংকেত যেয়ে আমি ক্রলিং করে পিছনের দিকে যেতে গিয়ে হঠাৎ গঙ্গানির মত শব্দ শুনি। কাছে গিয়ে দেখি আমাদের এলাকার শহীদুল্লাহ ধান ক্ষেতের উপর রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে।
পাকিস্তান বাহিনীর মেশিন গানের ব্রাশ ফয়ারে তার কোমরের নিচে পা ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। সহীদুল্লাহ কাঁদো কাঁদো স্বরে আমাকে বলল, শুকুর ভাই আমি দাঁড়াতে পারছি না আমার পায়ে গুলি লেগেছে, আমাকে আপনি বাঁচান। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যান। এ কথা শোনার পর আমি সহীদুল্লাহকে আমার পিঠে তুলে ক্রলিং করে ফিরে আসতে থাকি। এই সময় পাকিস্তানিরা আমাদের দেখে ফেলে। তারা এসে আমার পিঠে থাকা শহীদুল্লাহকে বেয়নের চার্জ করে। এতে সহীদুল্লাহ পিঠ ভেদ করে আমার পিঠেও বেয়নেটের মাথা কিছুটা বিদ্ধ হয়। তবে আঘাত ততটা গুরুতর ছিলনা।
বেয়নেট চার্জ করার পর আমার পিঠের উপরই শহীদুল্লাহর জীবন প্রদীপ নিভে যায়। সে আস্তে করে আমার পিঠ থেকে গড়িয়ে ধান খেতে পড়ে যায়। আমিও অনেকটা মরার মতই ধানক্ষেতে পড়ে থাকি। পাকিস্তানিরা এসে আমার মুখের মধ্যে লাথি মেরে পরীক্ষা করে আমি মৃত না জীবিত। কিন্তু আমি তখন আর নড়াচড়া করিনি। নড়াচড়া না করায় পাকিস্তান বাহিনী বুঝে যায় যে আমি মারা গেছি। তখন তারা আমাকে সেখানে ফেলেই চলে যায়। আমি প্রায় ঘন্টাখানেক সেখানে মরার মত শুয়ে থাকার পর তাকিয়ে দেখি আশেপাশে কেউ নেই।
তখন আমি ক্রলিং করে আরো পিছন দিকে গিয়ে আমার দলের অন্যদের সাথে একত্রিত হই। সেখান থেকে আমাকে সাথে সাথে ব্যান্ডেজ করে ভৈরব টিলা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আগরতলা হাসপাতালে আমি প্রায় এক মাস চিকিৎসা দিন ছিলাম। তারপর কিছুটা সুস্থ্য হলে দলের অন্য সদস্যদের সাথে আমি বাংলাদেশে প্রবেশ করে নিজ এলাকা গোদনাইলে ফিরে আসি। প্রায় ৫০ বছর হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু আজও সেই বেতিয়ারা যুদ্ধের কথা যখন মনে হয় তখন আমার চোখে ভেসে উঠে সহীদুল্লাহর সেই করুন কান্না- শুকুর ভাই, আমাকে বাঁচান।
আজ আমরা স্বাধীন দেশে বসবাস করছি কিন্তু শহীদ সহীদুল্লাহ আমাদের মধ্যে নেই। তার রক্তের বিনিময়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। আজ সেই শহীদ সহযোদ্ধা সহীদুল্লাহ সাউদের প্রতি আমি লাল সালাম জানাই।
এস.এ/জেসি