শনিবার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১৩ ১৪৩১   ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অপারেশন সফল হওয়ায় মেজর মোশারফ খুশি হয়ে আমাকে বলেন ‘ধন্যবাদ শফি’

বীর মুক্তিযোদ্ধা শফি উদ্দিন

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৯:১৪ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০২২ মঙ্গলবার



একাত্তরে ডিসেম্বর মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরার জন্য এই বিজয়ে মাসে ‘দৈনিক যুগের চিন্তা’য় একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কাহিনী তুলে ধরা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা শফি উদ্দিনের লেখা সিদ্ধিরগঞ্জ-ঢাকা বিদ্যুৎ টাওয়ার ধ্বংস করার কাহিনী।  



বীর মুক্তিযোদ্ধা শফি উদ্দিন : মুক্তিযুদ্ধে আমার সবচেয়ে বড় আনন্দের বিষয় ছিল যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আমার প্রথম অপারেশন  অত্যন্ত সফল হয়েছিল। এবং সেই অপারেশনটি সফল হওয়ায় দুই নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর খালের মোশারফ আমাকে বলেছিলেন ‘ধন্যবাদ শফি’।

 

 

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের এতদিন পরও মেজর খালেদ মোশারফের সেই কথাটি বারবার মনে পড়ে। সে কথা মনে হলেই আমি অত্যন্ত গৌরববোধ করি। খালেদ মোশারফ  আমার যে অপারেশনের সাফল্যে খুশি হয়ে আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন সেই অপারেশনটি ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন থেকে ঢাকা শহর পর্যন্ত ৩৩ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ লাইন ধ্বংস করে দেওয়া।

 



মেলাঘর মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আমার প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর একদিন ক্যাপ্টেন হায়দার ক্যাম্পের মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার কোন মুক্তিযোদ্ধা আছে কিনা জানতে চান। তখন আমি তার সাথে দেখা করি এবং জানাই আমার বাড়ি সিদ্ধিরগঞ্জ থানার জালকুড়ি গ্রামে।

 

 

তখন তিনি আমাকে একটি ম্যাপ বের করে দেখিয়ে বললেন, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন থেকে যে বিদ্যুৎ লাইনটি ঢাকা পর্যন্ত গিয়েছে সেই বিদ্যুৎ লাইনটি আমি চিনি কিনা। আমি বললাম, সে এলাকা দিয়ে আমরা যাতায়াত করি, আমি খুব ভালোভাবেই বিদ্যুৎ লাইনটি চিনি। তিনি তখন আমাকে বললেন, তোমাকে এই বিদ্যুৎ লাইন ধ্বংস করার অপারেশন করতে হবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই।

 

 



মুক্তিযুদ্ধের সময় মেলাঘরে দুই নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে বসে ঢাকা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার একটি পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব ক্যাপ্টেন হায়দারের উপর দেয়া হয়েছিল। তখনই ক্যাপ্টেন হায়দার সেই অপারেশন করার জন্য সিদ্দিরগঞ্জ এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজছিলেন। আমি সেই অপারেশন করতে রাজি হওয়ায়  ক্যাপ্টেন হায়দার খুশি হয়ে আমাকে বললেন, ঠিক আছে তুমি প্রস্তুতি নাও।

 

 

কয়েক দিন পর একদিন ক্যাপ্টেন হায়দার আমাকে বললেন, আজই তোমরা রওনা হবে। আমার সাথে আরও চারজন মুক্তিযোদ্ধাকে বাছাই করে দেয়া হলো। সেই চারজন ছিলেন বন্দর থানার চর সৈয়দপুরের অধিবাসী। তারাও মেলাঘরে  ট্রেনিং নিয়েছিলেন।

 



বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার আগে আমাকে একটি স্টেনগান, কয়েকটি গ্রেনেড এবং বেশ কিছু বিস্ফোরক দেয়া হলো। আমরা এসব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিকেলের দিকে ত্রিপুরা সীমান্তে আসি। সীমান্ত থেকে এক মাইল ভিতরে একটি ক্যাম্পে এসে আমরা অবস্থান নেই। সেখানে আমরা অপেক্ষা করতে থাকি সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার গাইডের ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার জন্য।

 

 

সন্ধ্যার কিছু পর গাইড এর নির্দেশ মতো আমরা নিরাপদেই বাংলাদেশে প্রবেশ করি। কয়েক মাইল ভিতরে ঢুকে আমরা একটি বাড়িতে আশ্রয় নেই। সেখানে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালবেলা আমরা একটি নৌকা ভাড়া করে রামকৃষ্ণপুর চলে আসি। সেখান থেকে আবার নৌকায় আমরা ডেমরা পর্যন্ত আসি। তখন বিকেল হয়ে গেছে। আমাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সিদ্ধিরগঞ্জ-ঢাকা ৩৩ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ লাইন ধ্বংস করার অপারেশন কি করতে হবে মধ্যরাতে, যাতে পাকিস্তান বাহিনী টের পেয়ে বাধা দিতে না পারে।

 



আমরা ডেমরা পর্যন্ত পৌঁছে অপেক্ষা করি অপারেশন এলাকা মামুদ পুর আসার জন্য। সন্ধ্যা হওয়ার পর শীতলক্ষ্মা নদী পেরিয়ে আমরা মামুদপুরে (বর্তমনা ঢাকা-নারায়নগঞ্জ সড়কের পূর্ব পাশে) বিদ্যুৎ লাইনের কাছাকাছি গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি। আমরা পুরো প্রস্তুতি নিয়ে রাত বারোটার পর বিদ্যুৎ টাওয়ারের  কাছে যাই। সেকানে গিয়ে টাওয়ারের এঙ্গেলের সাথে বিস্ফোরক বেধে দেই, যাতে সেগুলো টাওয়ারের এঙ্গেল থেকে নিচে পড়ে না যায়।

 



টাওয়ারের এঙ্গেলে বিস্ফোরক বাধার পর ৩০ মিনিটের ফিউজ দিয়ে ম্যাচের কাঠি দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেই। ফিউজে আগুন দেওয়ার পরপরই আমরা দ্রুত প্রায় আধা মাইল দূরে চলে যাই। আমরা দূরে যাওয়ার সাথে সাথেই বিস্ফোরকগুলো বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয় এবং বিদ্যুতের বিশাল টাওয়ার ভেঙ্গে একদিকে হেলে পড়ে যায়।

 



টাওয়ার ধ্বংস হওয়ার সাথে সাথেই আমরা চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখি পুরো এলাকা অন্ধকারে ঢেকে গেল। মামুদপুর  থেকে ঢাকা সোজাসুজি তিন/চার কিলোমিটারের পথ। তখন ঢাকা নারায়ণগঞ্জ ডেমরা সেচ (ডিএমডি) প্রকল্পের ভিতরে বাড়িঘর ছিল না বললেই চলে। জালকুড়ি এবং সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে ঢাকার বিভিন্ন বিল্ডিংয়ের বাতিগুলো দেখা যেত। আমরা তাকিয়ে দেখলাম আমাদের অপারেশনের ফলে বিদ্যুতের বিশাল টাওয়ার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই ঢাকা শহরের সব বাতি নিভে গেল। পুরো শহর অন্ধকারে তলিয়ে গেল।  

 



অপারেশন সফল হওয়ার পর আমরা আনন্দে-উল্লাসের সাথে হেঁটে হেঁটে জালকুড়ির দিকে চলে আসি। আমার সাথে থাকা চার মুক্তিযোদ্ধা, যারা বন্দরের চর সৈয়দপুরের বাসিন্দা, তারা অস্ত্র-শস্ত্র আমার কাছে দিয়ে তাদের গ্রামের দিকে দিকে চলে যায়। আমি আমাদের গ্রাম জালকুড়িতে আসতে আসতে ভোর হয়ে যায়। বাড়িতে এসে  আমার সাথে থাকা স্টেনগান, গুলী, গ্রেনেড ও বিস্ফোরক আমার বাড়িতে লুকিয়ে রাখি।

 



সেই অপারেশনের পর ৮-১০ দিন বিশ্রাম নিয়ে আবার ভারতে চলে যাই। মেলাঘর ক্যাম্পে গিয়ে ক্যাপ্টেন হায়দারের সাথে দেখা করে বিদ্যুৎ টাওয়ার ধ্বংস করার অপারেশন যে সফল হয়েছে তা লিখিতভাবে জানাই। ক্যাপ্টেন হায়দার সেই অপারেশন সফল হওয়ার খবরে অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করেন।

 

 

আমি যখন ক্যাপ্টেন হায়দারের সঙ্গে কথা বলছিলাম তখন সেই অফিসে ভিতরে বসে কাজ করছিলেন সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশারফ। তিনি আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি তার রুম থেকে বের হয়ে আমাদের সামনে আসেন এসে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, শফি তুমি ফিরে এসেছো, অপারেশন কেমন হলো? তখন আমি বললাম, স্যার আমাদের অপারেশন সম্পূর্ণ সাকসেসফুল।

 

 

এ কথা শুনে খালেদ মোশারফ একটু হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ‘ধন্যবাদ শফি’। খালেদ মোশারফের মুখে ‘ধন্যবাদ শফি’ কথাটি শোনার সাথে সাথে আমার আমার বুক গর্বে ভরে গেল।  মুক্তিযুদ্ধের এতদিন পরও সেই কখা মনে পড়ে। খালেদ মোশারফ যে আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন তা মনে হলে এখনও গৌরববোধ করি।

 



১৯৭১ সালে আমি ছিলাম তোলারাম কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। রাজনীতির সাথে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলাম। অবশ্য তখন বাংলাদেশের সবাই ছিল আওয়ামী লীগের সমর্থক। ২৫ শে মার্চের কালো রাতে ঢাকায় পাকিস্তানিরা নিরীহ বাঙালিদের গণহত্যা শুরু করার পরই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সবাইকে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। তার সেই নির্দেশের পর সারা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আমি এলাকার অনেকের সঙ্গে ভারতে চলে যাই প্রশিক্ষন নিতে।

 

 


মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায় ৩২টি অপারেশন করেছি। কয়েকটি অপারেশন করার পর আবার ভারতে চলে যেতাম এবং ফিরে এসে নতুন অপারেশনের মেতে উঠতাম। প্রতিবারই ভারতে যাওয়ার সময় আমাদের এলাকা থেকে পরিচিত অনেককে ভারতে নিয়ে প্রশিক্ষন ক্যাম্পে নাম লিখিয়ে দিতাম। এভাবে যুদ্ধে যুদ্ধে কেটে যায় মুক্তিযুদ্ধের ৯মাস । এরপরই আমরা পাকিস্তান বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হই।