স্বাধীনতা ও অসম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত: বীর মুক্তিযোদ্ধা বকুল
এন. হুসেইন রনী
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০৮:৩৪ পিএম, ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ বৃহস্পতিবার
“১৯৭১ সালে আমি মোগড়াপাড়া হাইস্কুলের ছাত্র, বাবা আঃ রাজ্জাক সরকার একই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ আজীবন আপোষহীন সংগ্রামী একজন চমৎকার মানুষ। স্বাধীনতার জন্য বাবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা, অসম্প্রদায়িক চেতনা ও আদর্শ আমাদের ভাই-বোনদের ও বাবার সকল ছাত্রদের হৃদয়ে সর্বদা আলোড়ন সৃষ্টি করতো। তিনি ছিলেন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের অঞ্চলের সকলের নিকট একজন জনপ্রিয় শিক্ষক। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচন, ৭১’র সাতই মার্চে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণে আমার বাবা ও ভাইদের সক্রিয় কার্যক্রমের সাথে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। যা আমাকে পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রেরণা জুগিয়েছে- যুগের চিন্তা’র আয়োজনে ২০ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা’ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুল ইসলাম বকুল এভাবেই স্মৃতিচারণ করেন, তুলে ধরেন তার জীবনে ঘটে যাওয়া মু্িক্তযুদ্ধকালীন ঘটনাবলী।
পরিচিতি:
মাহফুজুল ইসলাম বকুল এর জন্ম ০১ জুন, ১৯৫২ সালে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানার আওতাধীন চরগোয়ালদী গ্রামে। তার পিতা: মরহুম আব্দুর রাজ্জাক মাস্টার, এবং রত্নাগর্ভা মাতা: মরহুমা রাহিমুন বেগম। এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ১৯৭০ সনে জাতীয় নির্বাচনে মরহুম সাজেদ আলী মুক্তার পক্ষে আমি ও আমার পিতা নির্বাচনে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছি।
মানবতা:
হানাদার বাহিনী '৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে অতর্কিতে ঢাকাসহ সারা পূর্ব-বাংলার বিভাগীয় শহরগুলোতে ও ক্যান্টনমেন্টে আক্রমণ শুরু করলে ঢাকার অনেক মানুষ আমাদের গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করে। সেসময় আমার পিতা এই অসহায় নিপীড়িত মানুষ আশ্রয় দেন ও দ্ইু বেলা খাবারের ব্যবস্থা করেন। বাবার সাথে ফটিক চান বেপারী, নুরুল ইসলাম, নুরা খলিফা, আমানউল্লাহ, আমানুল্লা খলিফাসহ গ্রামের অনেকেই অর্থ সাহায্য ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগীতা করেছিলেন। কেউ কাউকে চেনে না, জানে না, কিন্তু মানুষ সেদিন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল, জীবন যেনো জীবনের জন্য বিলীন হয়ে যেতো।
রুদ্রমূর্তি ধারণ:
বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুল ইসলাম বকুল বলেন, আমরা যারা তরুণ-যুবক ছিলাম; বড়দের এমন মহতি কার্যক্রম দেখে অভিভূত হয়ে যেতাম, গর্ব অনুভব করতাম। আবার যখন শহর থেকে পালিয়ে আসা মানুষের কাছ থেকে স্বজন হারানোর হৃদয় বিদারক বর্ণনা শুনতাম এবং মেঘনা নদীতে লাশ ভেসে আসতে দেখতাম; তখন শরীরের রক্ত টগবগিয়ে ফুটতো, প্রতিশোধের আগুনে রুদ্রমূর্তি ধারণ করতাম। তরুণ বয়সের সে অনুভূতি, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, যুদ্ধে যাওয়ার উন্মাদনা এসব কিছুই ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমি এবং আমার বড় ভাই ও বন্ধুরা কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম তখন; দেশকে শত্রুমুক্ত করার শপথ নিলাম এবং বড় ভাইদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হলো: প্রশিক্ষণ নিতে ভারত যাবো। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীরা আমাদের বৈদ্দারবাজার এলাকা দিয়েই প্রতিদিন ভারত যাচ্ছিল সেসময়।
প্রশিক্ষণ গ্রহণ:
বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুল ইসলাম বকুল বলেন, বড় ভাইদের সাথে আমরা ১০ জন একদিন ফজরের আজানের পর আমরা মোগড়াপাড়া মেনিখালী নদী দিয়ে বৈদ্যেরবাজার ঘাটে গেলাম। আমাদের লিডার বজলুর রহমান এলাকার এক ভদ্র লোকের সঙ্গে আলাপ করে, সেই ভদ্রলোক আমাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেন। পরের দিন ঐ ভদ্রলোক নাগরআলী পাঠান নামে এক দালাল দিয়ে ভোরবেলা অন্য নৌকায় করে আমাদের বর্ডারের উদ্দেশ্যে রওনা করতে সাহায্য করেন। সেই দালালের মাধ্যমে বর্ডারের রেললাইন পার হয়ে অন্য নৌকায় বর্ডারের উদ্দেশ্যে রওনা হই। বর্ডারের রেললাইন পার হয়ে কিছুক্ষণ হাটার পর আগরতলার এক বাজারে গিয়ে পৌঁছি। সেখান থেকে হাঁটতে হাটতে আগরতলা টাউনে যাই। সেখানে আমরা সাজেদ আলী মোক্তারের সঙ্গে দেখা করি। সাজেদ আলী মোক্তার সাহেব আমাদের বিশ্রাম নিতে বললেন এবং দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর বিকালে শিশির মাস্টারকে দিয়ে কংগ্রেস ভবনে নাম রেজিষ্ট্রেশন করার জন্য পাঠালেন। রেজিষ্ট্রেশন করার পর কংগ্রেস ভবন থেকে লোক মারফত বিজন হোল্ডিং ক্যাম্পে পাঠানো হয়। সেখানে আমাদের ঠিকানা নিয়ে ক্যাম্পে ঢুকান। সেখানে বেশ কিছু দিন থাকার পর আমাদের সোনার বাংলা ইয়ুথ ক্যাম্পে নেওয়া হয়। তিনি বলেন, কিছুদিন পর আমরা ট্রাকে করে ট্রেনিং সেন্টারে যাই। তখন আমাদের ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন মোঃ ওয়ালীউল্লাহ নওজোয়ান (এম.এন) এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন ক্যাম্পেট বিভূুরঞ্জন চ্যাটার্জী। ট্রেনিং শেষে বজলুর রহমানকে গ্রুপ কমান্ডার করে তার সাথে আমাদের দেশে পাঠানো হয়।
দেশ শত্রুমুক্ত:
আসার পথে আমরা কুমিল্লায় আমাদরে গ্রুপ কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুর রহমানের নেতৃত্বে একটি সফল অপারেশন পরিচালনা করি। পরবর্তীতে নিজ এলাকায় আসার পর আমরা অন্যান্য গ্রুপের সঙ্গে একত্রিত হয়ে পানাম সর্দার বাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করি। শম্ভুপরা মেঘনা নদীতে হানাদার বাহিনীর গানবোট হতে পার্শ্ববর্তী গ্রামে শেল মারতো। কমান্ডার আমাদের নির্দেশ দেন পাকিস্তানি গানবোট মোকবিলা করার জন্য। আমরা সেই নির্দেশ মোতাবেক ২/৩ গ্রুপ মিলে শঙ্তুপুরা গ্রামের নদীরপাড়ে বাংকার বানিয়ে হ্যান্ড গ্রেনেড ছোড়তাম। পরবর্তীতে মিত্রবাহিনী আকাশপথে আক্রমণ করে, ওদের গানবোটগুলো ধ্বংস করে।
অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে নাটকীয়ভাবে বাবার সাথে আমার দেখা হয়ে যায়, তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তুই যে বেঁচে ফিরবি ভাবতে পারিনি; তোকে খুঁজতে-খুঁজতে আমি রামচন্দ্ররপুর পর্যন্ত গিয়াছিলাম। বিজয়ের দিন, বাবার কাছ থেকে পুনরায় বিদায় নিয়ে, আমরা সোনারগাঁ অঞ্চলের সকল মুক্তিযোদ্ধারা কমান্ডারদের নির্দেশক্রমে মিত্রবাহিনীর সাথে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই।
কৃতজ্ঞতা:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে আমি ও আমরা সকল মুক্তিযোদ্ধরা কৃতজ্ঞ। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বে আমরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি এবং সফলভাবে দেশ শক্রমুক্ত করি। আজ আমরা স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের নাগরিক, তাই একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি গর্বিত।
পরিশেষে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুল ইসলাম বকুল বলেন, “আমরা যে চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম তা হলো, অসম্প্রদায়িক স্বাধীন-সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র, যেখানে কথা বলার স্বাধীনতা থাকবে, সকলের সমান সুযোগ-সুবিধা থাকবে, নাগরিক অধিকার নিশ্চিত হবে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে স্ব-পরিবারে হত্যা করার পর, আমাদের সকল স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতা করছেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধারা তার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।”
এস.এ/জেসি