ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্য এখন ডিএনডি সড়ক
যুগের চিন্তা রিপোর্ট
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০৮:০৫ পিএম, ৬ জানুয়ারি ২০২৩ শুক্রবার
# টহল পুলিশের তৎপরতা কমায় মাত্রা বেড়েছে কয়েকগুণ
# গুরুত্ব সহকারে বিষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছেন দুই থানার ওসি
অপরাধ এবং নারায়নগঞ্জ দুটো শব্দ পরস্পরের উপর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারায়নগঞ্জ যেন অপরাধ জগতের স্বর্গরাজ্য। কোন ধরনের অপরাধ নেই এই শহরে? চুরি ছিনতাই থেকে শুরু করে কিশোরগ্যাং এর তান্ডব। ধর্ষণ থেকে খুন। অপরাধ যেনো নিত্যদিনের রুটিন হয়ে দাড়িয়েছে এই বৈচিত্রময় শহরে। আর যত অপরাধ হয় তার সিংহভাগই রাতে সংগঠিত হয়। বর্তমান সময়ে এমন পরিস্থিতি দাড়িয়েছে যে রাত বাড়ার সাথে সাথে অপরাধ মাত্রার তীব্রতা ও বেড়ে যায়। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে রাতের নারায়ণগঞ্জ। রাত যত গভীর হয় সড়ক মহাসড়কে অপরাধীদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। ভোর পর্যন্ত এ আতঙ্ক বিরাজমান থাকে। মধ্য রাত থেকে ভোর পর্যন্ত সড়ক মহাসড়কে ফাঁদ পেতে থাকে ছিনতাইকারীরা। বর্তমান সময়ে অধিকাংশ অপরাধীরা বেছে নিয়েছে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) সড়ককে।
তাদের মূল টার্গেটে থাকে পথচারী, মালবাহী পরিবহন ও ইজিবাইকের চালক এবং যাত্রীরা। পথচারী, মালবাহী পরিবহন ও ব্যাটারিচালিত গাড়ি কৌশলে গতিরোধ করে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নেয়। কখনো বা ছিনতাই এ ব্যর্থ হয়ে খুন ও করে বসে তারা। এই সড়কেই অর্থনৈতিক অঞ্চল ইপিজেড অবস্থিত হওয়ায় এ অঞ্চলে গার্মেন্টস কর্মীদের আনাগোনা সবসময়ই পরিলক্ষিত হয়। গার্মেন্টস পণ্যবাহী কার্ভাড ভ্যান ও প্রচুর পরিমানে চলাচল করে ডিএনডি সড়কে। এর ফলে সবসময় মানুষের আনাগোনা থাকে এ সড়ক ঘিরে। তবে সে তুলনায় এ সড়ক ঘিরে তেমন একটা তৎপর দেখা যায় না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহীনিকে। এই সুযোগ কে কাজে লাগিয়ে বেশ কয়েকটি পয়েন্টে ছিনতাইকারীরা তাদের শিকারে পরিনত করছে সাধারন মানুষ ও ব্যবসায়ীদের।
এমন বেশ কয়েকটি ঘটনার মধ্যো ফতুল্লার ফেইম অ্যাপারেলস লিমিটেডের কর্মচারী জনি কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার জন্য ২৯ অক্টোবর ভোরে কুষ্টিয়া থেকে চাষাড়া এসে বাড়ি যাওয়ার পথে মহিলা কলেজের সামনে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়ার ঘটনা এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এছাড়াও এমন আহত নিহতের পরিসংখ্যান নেহাত কম নয়। পুলিশের কাছে যেসকল অভিযোগ আসে তার চেয়েও কয়েকগুন বেশি অপরাধ হয়ে থাকে। অধিকাংশ মানুষ এসব চুরি ছিনতাই এর অভিযোগ থানায় জানায় না। কিন্তু তারা এর ফলে তাদের যানমাল ঠিকই কিন্তু খোয়ায়। ছিনতাইকারীদের আরেক মুখ্য টার্গেট হলো রাতের ইজিবাইক চালক।
ইজিবাইক চালকদের হত্যা করে ইজিবাইক ছিনতাইয়ের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে সাম্প্রতিক সময়ে। অর্থাৎ রাতের নারায়নগঞ্জ যেনো এক আতঙ্কের জনপদের নাম। পঞ্চবটি থেকে চাষাড়া, সাইনর্বোড থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ কিংবা চাষাড়া থেকে সাইনর্বোড। সর্বত্রই এমন অপরাধীদের আনাগোনা। গলি মহল্লার কথা তোলা থাক আজ। রাতের অপরাধের যে চিত্র প্রকাশ্যে আসে, বাস্তবে এর চেয়ে কয়েকগুন বেশি অপরাধ সংগঠিত হয়ে থাকে। অনেক মানুষ আছে এমন ঘটনার ভুক্তভোগী কিন্তু তারা অভিযোগ করে না। ফলে প্রকাশ্যে আসেনা অনেক ঘটনা।
হারুন নামের এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য জানান, গত মাসে তিনি চাষাড়া থেকে পঞ্চবটি যাচ্ছিলেন। কিন্তু ঈদগাহ সংলগ্ন এলাকায় পৌছালে ৪ জনের এক ছিনতাইকারী চক্র তার গতি রোধ করে সব কেড়ে নেয়। কিন্তু তিনি থানায় অভিযোগ করেননি। কারন তিনি যানেন অভিযোগ করে তার মাল ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। হারুন সাহেবের মতো আরো এমন অনেক ভুক্তভোগী আছে যারা তাদের সাথে হওয়া অন্যায় প্রকাশ্যে না এনে মুখ বুজে সহ্য করে নিয়েছেন। এদিকে সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) রোডের ডিসি বাংলোর শেষ মাথা বরফকল পেরুলেই ড্রেজার পরিদপ্তর থেকে হাজীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের আখড়া। রাত ৯টার পর থেকেই ছিনতাইকারীদের আনাগোনা বাড়ে। শীতের রাত বলে রাস্তা অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যায়, সেকারণে ছিনতাইকারীদের জন্য পোয়াবাড়ো।
হাজীগঞ্জ ফেরীঘাট থেকে আইটিস্কুল মোড় পর্যন্ত পুলিশের টহল থাকেনা বলে ছিনতাইকারীদের চক্রটা এখানেও সক্রিয়। পাঠানটুলির আগে পুলিশবক্স থাকলেও পুলিশবক্সের সামনে নতুন সড়ক নাগিনা জোহা সড়ক ফাঁকা থাকায় এখানেও ছিনতাইকারীদের নতুন আখড়া। হোন্ডাতে দ্রুত গতিতে ঝড়ের বেগে এসে অটোরিক্সার যাত্রীদের অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা এখন নৈমত্তিক হয়ে পড়েছে। পাঠানটুলি থেকে চৌধুরীবাড়ির মাঝে জাউল্লাপাড়া ব্রীজ পর্যন্ত ছিনতারীদের আরেকটি আখড়া। চৌধুরীবাড়ি থেকে ২নং ঢাকেশ্বরী পর্যন্তও ছিনতাইকারীরা বাইক যোগে ছিনতাইকরে সর্বোস্ব লুটে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা এখন অটোচালকদের মুখে মুখে। ২নং ঢাকেশ্বরী থেকে আদমজী কদমতলী পর্যন্ত ছিনতাইয়ের ঘটনাও আছে। মাঝে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এবং র্যাব-১১ এর সদর দপ্তর থাকায় এখানে ছিনতাইকারীদের আনাগোনা কম।
তবে সিদ্ধিরগঞ্জ পুলের আগে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাউজের পর থেকে চিটাগাংরোড শিমরাইল পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যে প্রতিনিয়ত মালামাল খোয়াচ্ছে চলাচলরত মানুষ। পুলিশের টহল কমে যাওয়ায় ছিনতাইকারীদের উপদ্রব বেড়েছে বলে মনে করে এই রোডে চলাচল করা সাধারণ মানুষ ও অটোচালকরা। ফলে রাতের এই জনপদ নিয়ে আতঙ্কিত শহরবাসী। সিদ্ধিরগঞ্জ অঞ্চলের রাতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি মশিউর রহমানের সাথে কথা বললে তিনি জানান, আমরা এ সড়কে নিয়মিত টহল দিচ্ছি। আগে যেমন ভাবে টহল দিতাম বর্তমানেও তেমনভাবেই দিচ্ছি। আমাদের কেউ ছিনতাই সম্পর্কে কোনোরকম অভিযোগ করেনি। তবে আপনি যেহুতু বলেছেন আমরা এ ব্যাপারটা সম্পর্কে অবগত হলাম। আমরা টহল জোরদার করেবো। জননিরাপত্তা প্রশ্নে আপোশহীন ভাবে কাজ করতে আমরা তৎপর।
এছাড়াও সদর থানার ওসি আনিচুর এর সাথে কথা বললে তিনি জানান, এই সড়কটিতে আমাদের টহল টিম নিয়মিতভাবে টহল দিচ্ছে। এছাড়াও শীতকালের শুরু থেকে আমরা টহলের পরিমান বৃদ্ধি করেছি। যে কোনো অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা সর্বদা প্রস্তুত। তবে প্রশাসন যতই তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার বুলি ফুটাক র্সবস্তরের জনগণের শঙ্কা কাটার উপায় নেই। কারণ বিগত দিনে ছিনতাই, খুন, ধর্ষণ গুলো পুলিশের ডিউটির মাঝেই হয়েছে। জনগন প্রশাসনকে আরো তৎপর ও ক্রিয়াশীল দেখতে চায় কারন প্রশ্নটা নিরাপত্তার। এ নিয়ে ঝুঁকি নিতে চায়না কেউ।
এস.এ/জেসি