তীব্র শীতে ছিন্নমূলে বেঁচে থাকার লড়াই
যুগের চিন্তা রিপোর্র্ট
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০৬:২১ পিএম, ৮ জানুয়ারি ২০২৩ রোববার
একদিনের ব্যবধানে শৈত্য প্রবাহ আরও বিস্তৃত হয়েছে নারায়ণগঞ্জে। সকালে তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রীতে থাকলে দুপুরে সেটা ২৩ ডিগ্রীতে আবহমান থাকে, রয়েছে কুয়াশার দাপটও। তবে বেলা বাড়ার সাথে সাথে তাপমাত্রা কমতে থাকে ধীরে ধীরে। মানুষের জীবনযাত্রাকে বিপন্ন করে তুলছে।
শীতের তীব্রতায় সবচেয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন দরিদ্র ছিন্নমূল মানুষ, দিনমজুর ও চাকুরিজীবিদের। বিশেষ শীতের কাপড়ের অভাবে কষ্ট পোহাচ্ছে তারা। শীত যত বাড়ছে তাদের জীবন যেন তত দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।
এদিকে, রাতের গভীরতার সঙ্গে বাড়তে থাকে শীতের তীব্রতাও। প্রায় মানবশূন্য হয়ে যায় ফুটপাতগুলো। শীতের তীব্রতা ঠেকাতে সবাই চলে যায় নিজ নিজ বাসস্থানে। কিন্তু তার পরও ফুটপাতেই থেকে যেতে হয় কিছু মানুষকে।
কারণ ফুটপাতই তাদের স্থায়ী ঠিকানা। নগরীতে সন্ধ্যা নামতেই রাস্তার পাশে, পার্ক, শহীদ মিনার, রেল স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে দেখা মিলে মধ্য বয়সী নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ ও শিশু। এই সময় শীতজনিত নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে তারা। শীত মৌসুমে বৃদ্ধ ও শিশুদের ঠাণ্ডাজনিত নানা রকম রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়।
রাতভর ঘন কুয়াশায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন ফুটপাতে থাকা মানুষগুলো। মানবেতর অবস্থার মধ্যে যাচ্ছে তাদের জীবন। এই মানুষগুলোর শীতের পোশাক না থাকায় ছেড়া কাপড় জড়িয়ে শীত নিবারণ করে বেঁচে থাকার লড়াই করে যাচ্ছেন। শনিবার (৭ জানুয়ারি) সরেজমিন নগরজুরে এসব চিত্র এখন দৃশ্যমান।
ঠান্ডার কবল থেকে বাঁচতে কাগজ, পলিথিন, বাশঁ ও কাঠেঁর টুকরোতে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করছে এসব দরিদ্র ছিন্নমূল মানুষ। কারো কাছে এক দুটি কম্বলেই তীব্র শীতের রাত পারি দিচ্ছেন। কথা হয় শহীদ মিনারে এক শিশু ফালানির সাথে।
তিনি বলেন, ‘বিকাল সেস (শেষ) হয় তারাতাড়ি। সন্ধ্যার আগেই শীত বাইড়া যায়। রাস্তার থেইকা কাগজ আর পলিথিন টোকাইয়া আগুন জ্বালাই। অনেক মানুষ আগে আমাগো লগে আগুন পোহায়। শীতের থেইকা বাচনের লাইগা আমাগো আর কোন পথ নাই।’ বঙ্গবন্ধু সড়কে আইল্যান্ড এর মাঝখানে বসে আছে রাজন নামে এক কিশোর, সাথে আরও কয়েকজন তার সাথে।
শীতের তীব্রতায় কষ্ট পোহাচ্ছে তারাও। তাদের সবার সম্বল ২টা কম্বল। রাতে কিভাবে কাটায় জিজ্ঞাসা করলে তারা জানান, ‘আমাগো ২ডা কম্বল আছে আমরা ভাগ কইরা গায়ে দেই। আমাগো যাগো (যাদের) শীত বেশী করে। ডাস্টবিন থেকে পলিথিন কাগজ টোকাইয়া আগুন জ্বালাই।’
নগরীর ২নং রেলগেইট এলাকায় বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য সামনে খালি জায়গায় দেখা মিলে এক বৃদ্ধ ও তার স্ত্রীর। তারা ২ বছর যাবত এখানে রাত কাটায়। বৃদ্ধ স্বামী মানসিক ভারসাম্যহীন, কিন্তু বৃদ্ধ স্ত্রীর মানসিক অবস্থা ঠিক থাকলেও চিকিৎসার অভাবে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তারা।
বিগত বছরে শীতের ত্রান পেয়েছিলো দুটি কম্বল, তার স্বামীও পেয়েছিলো ২টি কম্বল। তীব্র এই শীতের কম্বল দুটিই তাদের একমাত্র শীতবস্ত্র। ২নং রেলগেইট এলাকার খুচরা ভাসমান দোকানদার মো. মাসুম জানান, তারা স্বামী-স্ত্রী এখানেই থাকে। স্বামীটা পাগল বউও কিছুটা পাগলের মতো। দিনের বেলা মানুষের কাছ থেকে ভিক্ষা করে খায়, রাতে এখানে ঘুমায়। আর তার স্বামী পাগলামি করে বেড়ায়।
এই শীতের মধ্যেও তারা এখানে মাটিতে শুয়ে থাকে। মাঝে মাঝে বৃদ্ধ পুরুষ পাগল বৃদ্ধ মহিলাকে মারে আমরা তাদের ধমক দিয়ে ছাড়িয়ে দেই। কিন্তু এই শীতের তারাও রাতে অনেক কষ্ট করে। তীব্র শীতে বেশি সমস্যায় পড়েছেন দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলো ও চাকুজীবিদের। জীবিকা নির্বাহের জন্য সকাল সকাল কর্মস্থলের উদ্যেশে বের হয় বাসা থেকে।
শীতের পর্যাপ্ত কাপড় পরিধান করে রওনা হয় পেটের তাগিদে। এলাকার বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে শীত নিবারণের চেষ্টায় আগুন জ্বালিয়ে উত্তাপ নিতে দেখা গেছে নিম্ন আয়ের মানুষদের। কাজ করতে শারীরিকভাবে অসমক্ষ হওয়ায় অন্যের ওপরে নির্ভর করেই চলে অনেকের জীবন। রিকশা চালক বশীর মিয়া জানান, শীত বেড়ে যাওয়ায় রিকশা চালানো যাচ্ছে না।
পেটের দায়ে বাড়ি থেকে বের হলেও যাত্রী কম। শীতের কারণে সকালে বের হতে পারি না। সন্ধ্যার আগে ফিরে আসতে হয়। শীতের কাপড় না থাকায় রাতভর শীতে কাঁপতে থাকি। যে কাপড় আছে তা দিয়ে শীত মানে না। নারায়ণগঞ্জ টার্মিনাল ঘাটে দেখা হয় রেখা বেগমের সাথে। খাবারের বাটি হাতে গার্মেন্টসের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন তিনি।
তরিঘড়ি করে যাচ্ছিলেন, কথা হয় রেখা বেগমের সাথে। তিনি জানান, ফজরের নামাজের আগে ঘুম থেকে উঠে রান্না করেন তিনি। তাঁর বাসায় দুই মেয়ে আর তিনি থাকেন।
সকালে রান্না করে ছোট মেয়েকে ঘুমে রেখে, বড় মেয়েকে স্কুলের জন্য তৈরি করেই কর্মস্থলে জন্য বের হয় বাসা থেকে। শীতের মধ্য কষ্ট ছাড়া আর কি করার আছে আমাদের। কাজ না করলে পেট চালাইবো কে? এন.এইচ/জেসি