রোববার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১   ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ সড়কের যানজটে নাকাল জীবন

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৬:০৫ পিএম, ১২ জানুয়ারি ২০২৩ বৃহস্পতিবার

 

নারায়ণগঞ্জে যানজট নিত্যদিনের সঙ্গী। এই শহরে যানজট ছাড়া যেন কিছুই কল্পনা করা যায়না। আর ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ সড়কের যানজট যেন গলার কাটা হয়ে দাড়িয়েছে। এই সড়কে যানজটে আটকা পরে সাধারন মানুষের জরুরী মহূর্তে চরম ভোগান্তিতে পরতে হয়। সংকীর্ন এই সড়কে যানজটের কারন গুলোর মধ্যে অন্যতম কারন হলো বিসিকের গেট দিয়ে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি প্রবেশ ও বাহির হওয়া। এতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে অবৈধভাবে ইজি বাইক বা অটো রিক্সাগুলো থামিয়ে যাত্রী ওঠানো এবং নামানোর কারন। এই সড়কের সৃষ্ট তীব্র যানজটে বেশি ভোগান্তিতে পরেন অসুস্থ ব্যক্তিরা। সব থেকে বেশি যানজটের সৃষ্টি হয় পঞ্চবটি থেকে মুক্তারপুর পর্যন্ত। সংকীর্ন এই সড়কের যানজট নিরসনে পঞ্চবটি থেকে মুক্তারপুর পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও দোতলাকরণ প্রকল্পের কাজ চলমান।

 

এই প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ১ জানুয়ারি ২০২১ থেকে ৩০ জুন ২০২৫ পর্যন্ত। যা ইতমধ্যে শুরু হয়েছে। কিন্তু কাজের অগ্রগতি নিয়ে সন্তুষ্ট নন এলাকাবাসী। এলাকাবাসীরা বলেন, প্রকল্প শুরু হয়েছে এক বছর হয়ে গেছে কিন্তু কাজের কোন অগ্রগতি নেই। ফতুল্লার শাসনগাও এলাকার বাসিন্দা মমিনুল ইসলাম বলেন, “গত কয়েকদিন আগে মাটি পরীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের এক বছর ইতমধ্যে হয়ে গেছে কাজের তেমন কোন অগ্রগতি দেখি না। এক বছর যদি লাগে মাটি পরীক্ষা করতে তাহলে বাকি কাজ কখন করবে”। গার্মেন্টস কর্মী মিন্টু মিয়া বলেন, “প্রতিদিন আলীগঞ্জ থেকে বিসিকে আসি অফিসে। রাস্তার জ্যামের কারনে অনেক সময় নষ্ট হয়”। আরেক বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, যেভাবে কাজ এগুচ্ছে তাতে মনে হয় না ২০২৫ সালে শেষ করতে পারবে।

 

তিনি আরোও বলেন, গত ৮ তারিখের দৈনিক যুগের চিন্তা পত্রিকায় দেখলাম এই সড়ক দোতলা করতে ৫২০ আপত্তি জমা পরেছে। জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ জেলার অধিনে ৮৩২ টি পরিবারের ৩৫.৬০৮ একর জমি অধিগ্রহনের প্রস্তাব পাঠানো হয়। গত বছরের ২৭ জুন ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনকে ৩১.৬৯২৫ একর জমি অধিগ্রহণের চূরান্ত অনুমতি দেওয়া হয়। অনুমতি পাওয়া জমিতে ৭ ধারায় নোটিশ জারি হলে তার প্রেক্ষিতে ৫২০ টি আপত্তি জেলা প্রশাসকের নিকট জমা পরে। সূত্রে জানা যায়, রাস্তা নির্মাণে বাঁধা ৫২০ টি আপত্তি নিষ্পত্তি করতে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন কাজ করছে।‘পঞ্চবটি থেকে মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় বা সেতু বিভাগের উদ্যোগে বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ।

 

এতে মোট খরচ প্রস্তাব করা হয়েছে দুই হাজার ২২৭ কোটি ৭৭ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। তার মধ্যে সরকার দেবে দুই হাজার পাঁচ কোটি ৭৬ লাখ ৮৮ হাজার এবং সেতু কর্তৃপক্ষ দেবে ২২২ কোটি ৫৭ হাজার টাকা। প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রমগুলোর মধ্যে ৪৪ দশমিক ৫০ একর ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনে ৮৩৬ কোটি ৩৮ লাখ, সাত লাখ এক হাজার ১৪০ দশমিক ২০ ঘন মিটার মাটির কাজে ৩৩ কোটি পাঁচ লাখ ৭১ হাজার, ১০ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার পেভমেন্ট ও আনুষঙ্গিক কাজে ১৮৮ কোটি ৪৬ লাখ ৭২ হাজার, ১৪ দশমিক ৭৯ কিলোমিটার মধ্যবর্তী প্রতিবন্ধক নির্মাণে ১১ কোটি ৮০ লাখ ৬৪ হাজার, ৯ দশমিক ০৬ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ৯০৬ কোটি ৭৩ লাখ ২১ হাজার, ২৫ মিটার সেতু নির্মাণে পাঁচ কোটি, ২৪৮ ঘনমিটার বক্স কালভার্ট নির্মাণে ৯৩ কোটি ৪৫ লাখ, ২৫ দশমিক ৩১ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণে ৩৩ কোটি ৪৪ লাখ ১২ হাজার, ২০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৭৫ মিটার রোড মার্কিংয়ে দুই কোটি ২৪ লাখ ৯৬ হাজার, টোল প্লাজা, টোল মনিটরিং ভবনসহ ১৩ ওজন স্টেশন নির্মাণে ৩৮ কোটি ১৯ লাখ ৯৫ হাজার, ১৫১ মিটার সেতু প্রশস্তকরণে ২২ কোটি ৬৫ লাখ, ছয় হাজার ১৭৫ মিটার ট্রাক স্ট্যান্ড নির্মাণে ছয় কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার এবং ৯ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার অস্থায়ী সড়ক নির্মাণে ১২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা খরচ করা হবে। প্রকল্পের প্রধান অঙ্গ সমূহ সম্পর্কে বাবিএ সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় এ্যাট-গ্রেড সড়ক প্রশস্তকরণ ১০.৩৭ কিলোমিটার। ৬২০ মি. এ্যাট-গ্রেড সড়ক ৬-লেনে উন্নীতকরণ যা পঞ্চবটি মোড় থেকে ফতুল্লার দিকে ৩১০মি. ও চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ এর দিকে ৩১০ মি. করা হবে।

 

৬ কি.মি. এ্যাট-গ্রেড সড়ক ২-লেনে উন্নীতকরণ যা পঞ্চবটি হতে ৩য় শীতলক্ষ্যা সেতু পর্যন্ত হবে। ৩.৭৫ কি.মি. এ্যাটগ্রেড সড়ক ৪-লেনে উন্নীতকরণ যা ৩য় শীতলক্ষ্যা সেতু হতে মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত হবে। দোতলা রাস্তা বা এলিভেটেড রোড ৯.০৬ কিলোমিটার। এলিভেটেড রোড ৬.২৬০ কিলোমিটার যা পঞ্চবটি হতে কাশিপুর পর্যন্ত ৩.৫ কিমি. এ্যাট-গ্রেড সড়কের উপর ও কাশিপুর হতে চর সৈয়দপুর পর্যন্ত ২.৭৬ কিমি. নিচু ভূমির উপর করা হবে। র‌্যাম্প হবে ২.৮০৫ কিলোমিটার। ড্রেন নির্মাণ করা হবে ১৭.৬১ কিলোমিটার। এছাড়া ৪ টি টোল প্লাজা নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কারন ও উদ্দেশ্য হল, পঞ্চবটি হতে মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত বিদ্যমান সড়কটি দুই-লেনে উন্নীতকরণ ও দুই-লেন দোতলা রাস্তা নির্মাণের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জ জেলার সাথে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলাসহ অন্যান্য জেলার সড়ক যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন, সহজতর ও ব্যয় সাশ্রয়ী করা।

 

মুন্সীগঞ্জ জেলার সাথে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলাসহ অন্যান্য অংশের সরাসরি সড়ক যোগাযোগে বিদ্যমান সড়কটি ব্যবহৃত হয়। মুক্তারপুর হতে পঞ্চবটি পর্যন্ত সড়কটি খুব সংকীর্ণ যার গড় প্রশস্ততা ৫.৫ মিটার, আঁকাবাঁকা ও রাস্তার উভয় পাশে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, বসত-বাড়ি, দোকানপাট ইত্যাদি থাকায় যানবাহন চলাচলে প্রায়ই দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুরে ৫ টি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এবং আলু সংরক্ষনের জন্য বেশ কয়েকটি কোল্ড স্টোরেজ থাকায় ২৪ টন হতে প্রায় ৫০ টন পর্যন্ত ওজনের ভারী যানবাহন চলাচল করায় প্রায়ই দূর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় এবং এর ফলে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। প্রকল্পাধীন এলাকাটি বিসিক শিল্পাঞ্চল-এর অন্তর্ভূক্ত এবং এ এলাকায় কয়েকটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী থাকায় প্রতিদিন প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক তিনবেলা রাস্তাটি ব্যবহার করে। ফলে রাস্তায় যানজটের সৃষ্টি হয়।

 

তাছাড়া এ এলাকায় বেশ কয়েকটি রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যার উৎপাদিত পন্য পরিবহনের জন্যও রাস্তাটি ব্যবহার করা হয়। প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, এ সড়কে বিদ্যমান গড় বার্ষিক দৈনিক ট্রাফিক (এএডিটি) ১৭৯১০ টি। ট্রাফিক পূর্বাভাস অনুযায়ী এ যানবাহনের সংখ্যা চলতি বছরে অর্থাৎ ২০২৩ সালে দৈনিক ২৩৯২০ টি, ২০২৫ সালে দৈনিক ২৭০০০ টি, ২০৩৩ সালে দৈনিক ৩৯০০০ টি এবং ২০৪৩ সালে দৈনিক ৬৩৫৮০ টি। প্রকল্প বলছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ভ্রমণ সময় ৬২.৮৯% হ্রাস, যানবাহনের গতিসীমা ৪.৪৫ গুণ বৃদ্ধি এবং যানবাহনের বিলম্ব সময় ৭৪.৭৪ শতাংশ হ্রাস পাবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে মুন্সিগঞ্জের সঙ্গে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের অধিকতর উন্নত ও নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে এবং দক্ষিণাঞ্চলের যানবাহনগুলো ঢাকা শহরে প্রবেশ না করে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলাচল করতে পারবে।

এস.এ/জেসি