রোববার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ৮ ১৪৩১   ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছর ঘুরে হৃদয় জুড়ে ভাষার মাস ২০২৩

করীম রেজা

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ১১:৪৮ এএম, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ বুধবার


 
বছর পরিক্রমায় আবার ফিরে এলো ভাষা শহীদের অমর স্মৃতি বিজড়িত ফেব্রুয়ারি মাস। আজ ১লা ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশরীরে উপস্থিত থেকে মেলা উদ্বোধন করবেন।  

 

 

উদ্বোধনের পরই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে মাসব্যাপী লেখক, প্রকাশক ও পুস্তক ব্যবসায়ীদের আকাঙ্খিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা। করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে গত দুইটি মেলা প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন।


 

এবারের বইমেলার প্রতিপাদ্য-‘পড় বই গড় দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষা ও বিকাশে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর বাংলা একাডেমির মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দরকার অনুভূত হয়। তৎকালীন পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসে ১৯৫৫ সালে  বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে।

 

 

প্রতিষ্ঠার দুই বছর পর এই প্রতিষ্ঠান স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা পায়। একুশের বইমেলার সঙ্গে বাংলা একাডেমির এক ধরনের অবিচ্ছেদ্য সংশ্লিষ্টতা তৈরি হয়েছে বলে বই প্রেমিদের ধারণা।


 

বইমেলার ইতিহাস সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, ১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির প্রধান ফটকের পাশে চট বিছিয়ে বই বিক্রি শুরু করেছিলেন ‘মুক্তধারা’র স্বত্ত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা। পরে তার সঙ্গে আরও অনেকে যুক্ত হন ১৯৭৭ সালে, ফলে বই বিক্রি অনেকটাই মেলার আকার পেতে শুরু করে।

 

 

১৯৭৮ সালে তৎকালীন মহাপরিচালক ড. আশরাফ সিদ্দিকীর উদ্যোগে বাংলা একাডেমি প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বইমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। পরবর্তী বছর বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি মেলার সঙ্গে যুক্ত হলে পর্যায়ক্রমে গ্রন্থমেলা আজকের একুশের বইমেলার রূপ এবং আকার পায়।

 

 

শুরু থেকে মেলার নাম ছিল অমর একুশে গ্রন্থমেলা। কয়েক বছর আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শে গ্রন্থমেলার বদলে বইমেলা নামকরণ করা হয়।

 

 

গত ২৯শে জানুয়ারি বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ একটি জাতীয় দৈনিকে এক সাক্ষাতকারে উল্লেখ করেন, “বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মর্যাদার দুটি স্মারক। একটি শহীদ মিনার, অন্যটি বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমি একটি অন্য রকম প্রতিষ্ঠান। এর স্বতন্ত্র মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

 

 

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে গুলি চলার পর যুক্তফ্রন্টের দেওয়া ২১ দফা দাবির অন্যতম ছিল, বাংলা ভাষার চর্চা ও বিকাশের জন্য একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে। যে প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ হবে বাংলা ভাষার সাহিত্য নিয়ে গবেষণা।”  

 



গত সপ্তাহে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয়ের সচিব মেলার কাজের অগ্রগতি দেখতে বাংলা একাডেমিতে আসেন। আমন্ত্রণ পত্রে সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের নাম না থাকায় সচিব বাংলা একাডেমির কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। কার্ডে মন্ত্রণালয়ের নাম থাকতে হবে বলে তিনি মৌখিক নির্দেশ দেন। তার নির্দেশ মত আগের ছাপা কার্ড বাদ দিয়ে নতুন করে সরকারী সিলসহ কার্ড ছাপার জন্য বলেন।

 



বিষয়টি নিয়ে মিডিয়া এবং যোগাযোগ মাধ্যমে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ দেখা যায়।  সংস্কৃতি সচেতন অনেকেই যৌথ বিবৃতি দিয়ে এমন অনাকাঙ্খিত হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ জানান।

 



পরবর্তীকালে এই প্রেক্ষিতে প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের নিকট আসন্ন কোনও পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি নেতিবাচক জবাব দেন। এই পরিস্থিতিতে বইমেলার আয়োজক হিসেবে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম যুক্ত হচ্ছে কি না- জানতে চাইলে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ গত মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কোনো পরিবর্তন আসছে না।

 

 

“সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তো আয়োজকই, মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় তো বইমেলা হয়। আগে যেভাবে ছিল, সেভাবেই সবকিছু হবে। বাংলা একাডেমিই সব দায়িত্ব পালন করবে। নতুন করে কিছু হচ্ছে না।” কিন্তু বাস্তবে তা আর হয়নি। সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের লোগো সম্বলিত নতুন দাওয়াত পত্র ছাপা হয়েছে শেষ পর্যন্ত।

 



সাবেক মহাপরিচালক এই প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে জানান, “ঘটনা এখনই প্রথম নয়। একাডেমির ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখবেন, একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তান আমল বা স্বাধীন বাংলাদেশ বলুন, অনেকবার নানা রকম প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনের সময় বাংলা একাডেমির ওপর বিচিত্র সব চাপ তৈরি হয়েছিল। ১৯৬১ সালে ঢাকা শহরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী পালন করা গেলেও বাংলা একাডেমি তা উদ্যাপন করতে পারেনি।

 



আশির দশকের আরেকটি ঘটনা বলি। একাডেমি কর্তৃপক্ষ আহমদ শরীফকে একটি বিশেষ বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। যে ভাষণটি তিনি দেবেন, সেটা আগে ছাপা হচ্ছিল প্রেসে। সেই ভাষণে বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে আহমদ শরীফ দুজন বাঙালি নেতাকে বিশেষ সাহসী বলে মন্তব্য করেছিলেন। সুভাষ বসু ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছাপার সময় মন্ত্রণালয় জানতে পারে সেটি এবং ওই বক্তৃতা আর আহমদ শরীফের দেওয়া হয়নি। ...

 



বাংলা একাডেমির নির্বাহী কমিটিতে সরকারি প্রতিনিধি সব সময়ই ছিল। ... এতে কোনো ক্ষতি দেখি না। আসলে বুঝতে হবে, হস্তক্ষেপ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? অনুষ্ঠানে কোন গান বাজানো হবে অথবা সেমিনারে কে প্রবন্ধ পাঠ করবেন, সেটা নিয়ে মন্ত্রণালয়ের মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। ...

 

 

আবার দেখুন, অনেক সময় আমরাই কিন্তু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তদের কারণে-অকারণে ডেকে ডেকে এনেছি। তাঁদের খুশি করতে চেষ্টা করছি বিভিন্ন সময়। আমরা যাঁরা বিভিন্ন জাতীয় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকি, তাঁদেরও এটার মর্যাদা রক্ষা করার জন্য সতর্কভাবে চলা নৈতিক কর্তব্য। আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি যে বাংলা একাডেমির মর্যাদা রক্ষা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত সব নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব।”

 



তিনি স্মৃতিচারণ করে নানা ঘটনার কথা বলেছেন। “এরপর ২০০২ সালে সরকারের কারও মাথায় ঢুকেছিল যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী অথবা প্রতিমন্ত্রী একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করবেন। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে একাডেমির সভাপতির পদ থেকে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান পদত্যাগ করেছিলেন। তবু সরকার তার সিদ্ধান্ত বদলায়নি।

 

 

সরকার ওই সময় থেকে মন্ত্রী দিয়েই সভাপতিত্ব করানো শুরু করে। ২০০৭ সাল পর্যন্ত এ রকম চলে। এমনও হয়েছে যে বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানে একাডেমির মহাপরিচালককে মঞ্চেই স্থান দেওয়া হয়নি।

 



 ২০০৮ সালে আমি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলাম। তখন প্রধানমন্ত্রী নন, ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রস্তুতি সভায় আলোচনা হলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের যিনি উপদেষ্টা ছিলেন, তিনি বইমেলার উদ্বোধনী অধিবেশনের সভাপতিত্ব করবেন। তখন আমরা এ সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলাম এবং সরকার সেটা মেনেও নিয়েছিল। ফলে ২০০৮ সাল থেকে আবার বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করার দায়িত্ব পান সভাপতি।”(প্রআ ২৯/১/২৩)

 



বইমেলা সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্নের লক্ষ্যে ১৯ জানুয়ারি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে একটি টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করা হয়েছে জানিয়েছেন অমর একুশে বইমেলার সদস্যসচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম।

 



জানা গেছে, বাংলাদেশ শিল্পীকল্যাণ ট্রাষ্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অসীম কুমার দে কে আহবায়ক করে সাত সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটি কপিরাইট আইন ও বইমেলা নীতিমালার প্রতিপালন পর্যবেক্ষণ এবং কপিরাইট আইন ও বইমেলা নীতিমালা লঙ্ঘনকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

 



এবার বইমেলায় কিছু আঙ্গিকগত পরিবর্তন হয়েছে উল্লেখ করে সদস্যসচিব বলেন,  মেলার পুরো বিন্যাসই পরিবর্তন করা হয়েছে। মেলায় মূল মঞ্চ থাকবে বাংলা একাডেমি অংশে। আর গ্রন্থ উন্মোচন ও লেখক বলছি মঞ্চ থাকবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশে। বেশি স্টল ও প্যাভেলিয়ন থাকছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।

 



অন্যদিকে  ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউট সংলগ্ন  ১৮২টি স্টল ও ১১টা প্যাভেলিয়ন এবার সরিয়ে আনা হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মূল কেন্দ্রে। সেই জায়গায় ফুডকোর্ট সহ অন্যান্য সেবাদাতা সংস্থাকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এবার  মেলার প্রধান প্রবেশ পথ পরিবর্তন করে বাংলা একাডেমির উল্টো দিকে রাখা হয়েছে ।

 

 

আগেকার সেই প্রবেশ  ফটক এবার প্রস্থানের  জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে।   মন্দিরের প্রবেশদ্বার দিয়ে আগতরা  মেলায় প্রবেশ করবে। নির্দিষ্ট স্টল খুঁজে পেতে ডিজিটাল বোর্ডসহ প্ল্যাকার্ড এর ব্যবস্থা থাকছে। সেখানে ম্যাপ এবং বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হবে।  

 



এবারের মেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মোট ৪৭০ টি স্টলের মধ্যে ৩৬৭ টি সাধারণ প্রতিষ্ঠান, শিশু চত্ত্বর ৬৯ টি প্রতিষ্ঠান এবং প্যাভেলিয়ন আছে ৩৪ টি। অন্যদিকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সাধারণ প্রতিষ্ঠান ১০৩ টি ও প্যাভেলিয়ন আছে ১৪৭ টি। সবমিলিয়ে ৫৭৩ টি প্রতিষ্ঠান এবং সর্বমোট ৭০৪ টি (প্যাভেলিয়ন বাদে) স্টল থাকছে।

 

 

এছাড়া ফুডকোর্ট, নামাজের জায়গা, ওয়াশরুম পর্যাপ্ত পরিমাণে রাখা হয়েছে। বইমেলার চারপাশে সিসি টিভি ক্যামেরাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সর্বস্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকছে। এবার মূল গেট দিয়ে ঢুকলেই শিশু চত্বর যেখানে সিসিমপুরসহ শিশুদের আনন্দ ও বিনোদনের নানা আয়োজন থাকবে। মাসব্যাপী  অমর একুশে বইমেলা বিকাল ৩টা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত চলবে।

 



নবীন, প্রবীণসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে মেলায় আসার আহ্বান জানিয়ে গ্রন্থমেলার সদস্য সচিব বলেন, ‘বই মেলায় আসুন, ভালো লাগবে, নতুন কিছু শিখবেন, উপভোগ করবেন, সাথে ভালো বই সংগ্রহ করবেন।’ একটি সুন্দর এবং সুশৃঙ্খল গ্রন্থমেলার অপেক্ষায় লেখক-পাঠকসহ সারা দেশের মানুষ।

 

 

কাগজের দাম দ্বিগুন, তিনগুন; তাছাড়া আনুষঙ্গিক ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবুও আশা করোনার প্রাবল্য কম বিধায় এই রকম পরিবেশেও লেখক-পাঠকের সমাগম হবে অন্যান্যবারের চেয়ে আরও বেশি। শেষ পর্যন্ত সব রকম প্রতিকূলতা অতিক্রম করে বইমেলা সবার মিলনমেলায় পরিণত হবে এমন প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট সকলের। এন. এইচ/জেসি