ভর্তি বাণিজ্যের কারিশমায় শওকতের হাতে আলাদিনের চেরাগ
যুগের চিন্তা রিপোর্ট
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০১:১২ পিএম, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ রোববার
# ম্যানেজ করেই ২০ বছর বদলি ঠেকিয়ে এক প্রতিষ্ঠানে
# তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে: এডিসি (শিক্ষা ও আইসি)
# খোঁজ-খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে : জেলা শিক্ষা অফিসার
# ‘সকল বিদ্যালয়ের স্যারেরাই কোচিং করান : শওকত আলী
টাকায় নাকি বাঘের চোখও মেলে। আর টাকার জোরে বদলি ঠেকিয়ে এক প্রতিষ্ঠানে ২০ বছর চাকুরি করা সেটি আর এমন কিছু কি! তবে সেই টাকার যোগান এসেছে শিক্ষকতার আড়ালে ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে। আর এই বাণিজ্যে তিনি যেমন ফুলেফেঁপে অগাধ সম্পত্তির মালিক বনে গেছেন, ঠিক তেমনি বিভিন্ন মহলে ভাগবাটোয়ারা দিয়ে একই প্রতিষ্ঠানে ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’র মতো দিব্যি টিকে রয়েছেন। গেল কয়েকবছর ভর্তি বাণিজ্যের রমরমা ব্যবসায় ভাটা আসলেও হাত পাকিয়ে ফেলা সেই ব্যক্তি শিক্ষার্থীদের ঢাল বানিয়ে কোচিং বাণিজ্যের সিন্ডিকেট করে এখনো পিরামিডের মতোই একই প্রতিষ্ঠানে অটল রয়েছেন।
বহু শিক্ষা অফিসার বদল হতে দেখেছেন, সাথে দেখেছেন জেলা প্রশাসনের শিক্ষা ও আইসিটি কর্মকর্তার বদলি। তবে নিজের বদলি ঠেকিয়েছেন সেই আলাদিনের চেরাগের মাধ্যমেই। এই থিঁতু হয়ে বসাকে নিজের সফলতা হিসেবে দাবি করতেই পারেন নারায়ণগঞ্জ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের (গভর্মেন্ট গার্লস) ইংরেজি শিক্ষক শওকত আলী। গেল কয়েকবছর লটারির মাধ্যমে ভর্তি হওয়ার সুযোগ তৈরির আগে এই স্কুলের ভর্তি বাণিজ্যের শাহেনশাহ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন এই শিক্ষক। একই প্রতিষ্ঠানের বহু শিক্ষকের বদলি নিজ চোখে দেখলেও তিনি এখনও সেই আগের মতোনই আছেন। শুধু পদ্ধতিটা বদলে ফেলেছেন। অভিভাবকদের অভিযোগ, নানা কায়দা করে শিক্ষার্থীদের চাপে ফেলে কোচিং বাণিজ্যের সিন্ডিকেটে অর্থ কামান এই শিক্ষক।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় যেসব আইন করেছেন সেসবের তোয়াক্কা না করে নিজের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দিয়ে কোচিং খুলে বসেছেন এই শিক্ষক। তার কোচিং সেন্টারের নাম ‘মহসিন লার্নং পয়েন্ট’। এই কোচিং সেন্টারে ৬ষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের দুই হাজার টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হয়। এছাড়া ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন হিসেবে ১ হাজার ৫০০ টাকা করে দিতে হয়। সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছাত্রীদের মাসিক বেতন হিসেবে ১ হাজার ৮০০ টাকা করে নেন। এছাড়া অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেন ২ হাজার টাকা করে। সেই সাথে নবম এবং দশম শ্রেণির ছাত্র ছাত্রীদের কাছ থেকে ২ হাজার ৫শ’ টাকা করে নেন। তার কোচিং সেন্টারে যারা প্রাইভেট পড়ে তাদের ১০ তারিখের মাঝে বেতন পরিশোধ করতে হয়।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবককের অভিযোগের বরাত থেকে জানা যায়, এইভাবে কোচিং বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য করে সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক শওকত অঢেল সম্পদের মালিক বনে গেছেন। তিনি অতীতের ভর্তি বাণিজ্য ও বর্তমানে কোচিং বাণিজ্যের সিন্ডিকেট করে কয়েক কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে গেছেন। তিনি নারায়ণগঞ্জ সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন থাকায় এই ভাবে অপকর্ম করে যাচ্ছে। তাছাড়া অভিযোগ রয়েছে তার বদলী না হওয়ায় এই ভাবে তিনি নানা অপকর্ম করে অঢেল টাকার মালিক বনে গেছেন। অথচ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, ৩ বছর পর শিক্ষকদের বদলী হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি ২০ বছর যাবৎ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে যাচ্ছেন। তিনি সিন্ডিকেট করে বিশালভাবে কোচিং বানিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শওকত আলী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ক্লাস টিচার। তিনি ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে পাঠ দান করে থাকেন। তিনি নবম গ্রেডে ২০ হাজার টাকা বেতন পেয়ে থাকেন। সরকারি বিদ্যালয়ের ভেতর বসবাস করেন তিনি। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, শওকত আলী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভর্তি বাণিজ্য করে ফতুল্লার টাগারেরপাড় এলাকায় প্রায় ৪ শতাংশ জায়গায় চারতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। যার বর্তমান আনুমানিক মূল্য আছে প্রায় দুই কোটি টাকা। ফতুল্লায় তিনি একাধিক জায়গা ক্রয় করেছেন। এছাড়া সোনারগাঁয়ে তার নিজের গ্রামে বাড়ি নির্মাণের পাশাপাশি একাধিক জায়গা জমি ক্রয় করেছেন নিজ নামে। অথচ ছাত্র জীবনে তিনি ছিলেন অনাথ এবং হতদরিদ্র একজন মানুষ। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে লটারি পদ্ধতিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগের আগ পর্যন্ত তিনি ভর্তি বাণিজ্যে নিজের পকেট ভারী করেছেন। আর সেটি করেই মূলত তিনি কয়েক কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে গেছেন। সবপক্ষকে ম্যানেজ করে নির্বিঘ্নে এসব করতে পারায় বদলী তো দূরের কথা তাকে কেউ ছুঁয়েও দেখতে পারেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক অভিভাবক জানান, শওকত স্যার ইংরেজি শিক্ষক হওয়ায় তার কোচিংয়ে ছেলে-মেয়েদের বাধ্যতামূলক পড়তে হয়। তার কোচিং না পড়লে সন্তানদের নাম্বার কমিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া ক্লাসে ঠিক মত না পড়ানোর কারণে তার কাছে প্রাইভেট পড়তে হয়। আর এতে করে আমাদের অনেক কষ্ট হয়ে যায়। কেননা আমাদের সন্তানরা কম খরচের জন্য সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এখানে খরচ কম হলেও শওকত স্যারের মতো শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়িয়ে তা উসুল করে নেন।
তারপাশে আরেকজন বলেন, এমনিতেই এখন দেশের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। যা মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। যা মরার উপর খাড়ার ঘা। তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ সহ সকল জিনিস পত্রের দাম বেড়েছে। তাও আবার তার কাছে দুই হাজার টাকা দিয়ে সন্তানকে প্রাইভেট পড়াতে হয়। আমরা কই যামু। এই সকল অভিযোগের বিষয়ে সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক শওকত আলী বলেন, ‘সকল বিদ্যালয়ের স্যারেরাই কোচিং করান। নিজ কর্মস্থলের ছাত্র ছাত্রীদের পড়ানো যাবে না এমন প্রজ্ঞাপন আমার জানা নেই। তাছাড়া অন্যান্য অভিযোগের বিষয় তিনি অস্বীকার করেন।’
জেলা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শিক্ষা ও আইসিটি ইসমত আরা যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে অভিযোগ পেলে আমরা তা তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিবো। তার পরেও যেহেতু আপনাদের মাধ্যমে জেনেছি। আমরা খবর নিয়ে ব্যবস্থা নিবো।’ জেলা শিক্ষা অফিসার শরিফুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে দৈনিক যুগের চিন্তাকে বলেন, ‘আমরা এ্ই বিষয়ে অবগত নই। তবে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জেনে-শুনে তার পর ব্যবস্থা নিবো।’ এদিকে শিক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে ৭ মাস আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক তাঁর নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না বলে উল্লেখ রয়েছে।
শিক্ষামন্ত্রী দিপু মনি এই আইন প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের সাথে ব্রিফিংকালে বলেছেন, অনেক শিক্ষক ক্লাসে ঠিকমতো না পড়িয়ে তাঁদের কাছে শিক্ষার্থীদের কোচিং বা প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন, যা অনৈতিক। মূলত তা বন্ধ করতেই এই পদেক্ষপ। তবে কোচিং বাণিজ্যে কি ধরণের সিন্ডিকেট তৈরি করলে শওকত আলীর মতো শিক্ষক একই প্রতিষ্ঠানে বদলি ব্যতিত ২০ বছর যাবৎ দায়িত্বে রয়েছেন তা শিক্ষা নিয়ে চিন্তাবিদদের নিঃসন্দেহে কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন শিক্ষক বলেন, শওকত আলীর মতো এমন শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ। শিক্ষকরা হলেন জাতির মেরুদণ্ড। তারাই যখন নানা অপকর্ম করে অর্থ কামিয়ে অঢেল সম্পদের মালিক হন, তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে প্রশ্ন রাখেন তারা।
এস.এ/জেসি