শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১৩ ১৪৩১   ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মহান ভাষা শহীদ দিবস স্মরণে

করীম রেজা

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ১২:৫৯ পিএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ মঙ্গলবার

 

একুশে ফেব্রুয়ারি, আগুনে ফাগুন, ভাষা শহীদ দিবস। বাংলার ব্যাপ্তি ছাড়িয়ে তা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার প্রদীপ তুলে ধরেছে বিশ্ব নামক গ্রহের আনাচ-কানাচে। তবে বলা হয়ে থাকে আমরা বেশি আবেগপ্রবণ, জাতি হিসেবে। কোনও উপলক্ষ এলেই আমরা স্মৃতি কাতর হই। প্রগলভতায় বীরত্বের ফানুস উড়াই। তারপর বিস্মরণের খেয়া ভরা পালে যেন কোথায় হারিয়ে যাই।

 

 

যতই দিন যাচ্ছে আমাদের যেন  বাকবিলসিতা স্বভাবের অংশ হয়ে ওঠছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় - বাঙ্গালী কর্মবীর। শক-হুণ-পাঠান-আর্য-অনার্য কেউই বাঙালির মাথার উপর শাসনদন্ড চিরস্থায়ী করতে সক্ষম হয়নি। তারপরও আমরা নিজেদের গৌরব, ঐতিহ্য, আত্মমর্যাদার বিষয়ে কখনও কখনও এক ধরনের উদাসীনতা দেখাই।

 

 

ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা বাংলা ভাষা নিয়ে যত কথা, যত কাজ, যত ভাব - বলি, করি আর দেখাই, পরের মাসেই কিন্তু আমাদের আচরণে সেই সচেতনতার প্রভাবের অনুপস্থিতি লক্ষ্য করি। সারা বছরের বাকি এগারো মাস বাংলা ভাষার প্রতি যথাসম্মান দেখাই, এমন কথা বুক ফুলিয়ে বলা কঠিন।

 

 

বীরের মত যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি। এমন নজির পৃথিবীতে খুবই কম। যোদ্ধৃ জাতিরূপে আমাদের গৌরবের স্থানটি অতুলনীয়। ভাষার জন্য যুদ্ধ - এমন জাতিগোষ্ঠী বা জাতি রাষ্ট্র পাওয়া দুষ্কর। সভ্যতার ইতিহাসে এমন ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রের অভ্যূদয়-ঘটনা বিরল।

 

 

ভাষা আন্দোলন আমাদের আত্ম পরিচয়কে সুস্থিরতা দিয়েছে। তারপরও ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত আমাদের রাষ্ট্র-জাতি নির্মাণের জন্য প্রতীক্ষা করতে হয়েছে। আত্মচেতনা কেন্দ্রীভূত করে স্বাধীনতা অর্জনের মহান আকাঙ্খা উদ্দীপ্ত করার দ্বারা স্বাধীনতা লাভের আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় লেগেছে।

 

 

এখনও সেই ভাষার মর্যাদা কি আমরা সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেছি, পেরেছি, এই রকম প্রশ্ন আজ আমাদের বিবেচনা করা দরকার? আমাদের কি আরও দীর্ঘকাল অপেক্ষার প্রত্যাশা নিয়ে দিন গুনতে হবে?

 

 

একটি প্রবাস স্মৃতির কথা উল্লেখ করা যায়। সৌদি আরবে প্রচুর ভারতীয় কর্মব্যপদেশে রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বোধ করি - কেরালা রাজ্যের মালয়ালামভাষী লোকজন। কেরালা রাজ্য ১০০% স্বাক্ষর এবং শিক্ষিত বলে দাবী করে। জানা যায় ঐ রাজ্যে ভাষা হিসেবে হিন্দীর ব্যবহার ও প্রয়োগ প্রায় অচ্ছ্যুৎ।

 

 

সাইন বোর্ডে হিন্দী ও ইংরেজি ভাষার ব্যবহার নাই বলা চলে। কোনও কেরালা রাজ্যের বাসিন্দাকে যদি প্রশ্ন করা যায়, সে কোন দেশ থেকে এসেছে - দ্বিধাহীন উত্তর ‘কেরালা’। নবীন বা যারা বই-পুস্তক কিংবা লোকমুখে কখনই ‘কেরালা’ নামের কোনও দেশ পৃথিবীতে আছে বলে জানে না - তারা খুব অবাক হয়, এমন উত্তর শুনে আমি নিজেও খুব অবাক হয়েছি। নিজের কাছে লজ্জা অনুভব করেছি।

 

 

মনে হয়েছে ভূগোল সম্পর্কে কত কম জানি। ভাল কওে জানা-বোঝার আগ্রহে আবার প্রশ্ন কওে, জানা গেল কেরালা হচ্ছে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য। অর্থাৎ এরা শুরুতেই নিজেকে ভারতীয় বলে পরিচয় দেয় না। চেন্নাই বা মাদ্রাজের লোকজনও এমনতরো আচরনই করে। প্রাচীন অস্ট্রিক সভ্যতা-সংস্কৃতির উত্তরাধিকার নিয়ে খুব গর্ববোধ করে।

 

 

কাবাডি বা কানামাছি জাতীয় খেলাগুলি স্বনামে অথবা ভিন্ন নামে অস্ট্রিক সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা বহন করছে ওদের সমাজ-জীবনে। আমরাও অস্ট্রিক সংস্কৃতির ধারক। আমরা কিন্তু বাঙ্গালি পরিচয়ে অকুন্ঠ হতে কুন্ঠাবোধ করি।

 

 

রিয়াদের রাস্তায় বের হলেই এখানে সেখানে ভাড়ার ট্যাক্সি বা স্থানীয় ভাষায় লিমুজিন দেখা যাবে। অধিকাংশ লিমুজিনের ড্রাইভার পাকিস্তানি। উর্দু হচ্ছে তাদের অধিকতর যোগযোগের অগ্রাধিকার প্রাপ্ত ভাষা।

 

 

কোথায় যাব, কত ভাড়া ইত্যাদি বিষয়ে আরবী বা ইংরেজিতে কথাবার্তা বলে লিমুজিনে উঠে বসলেই - অবধারিত একটি প্রশ্ন শুনতে হয়। প্রথম প্রশ্ন, কোন দেশী? বাংলাদেশী শুনলে তো ড্রাইভার উৎসাহে লাফিয়ে ওঠবে। আর সঙ্গে সঙ্গেই কন্ঠে অনুযোগ ঢেলে জিজ্ঞেস করবে - উর্দু জানতে নেহি?

 

 

কিউ নেহি! কিউ নেহি! আলবৎ। গাড়ির আরোহী তৎক্ষণাৎ সাড়া দেয়। বা বলতে হয় সাড়া দেয়ার চেষ্টা করে। আলবৎ উর্দু বলতে না পারলেও আমরা বাঙ্গালিরা প্রায়ই বলি জান্তা হায়, কইতা হায় কিংবা পারতা হায়’ ইত্যাদি বলে উর্দু বলার চেষ্টা করি।

 

 

আমরা ভুলে যাই এই উর্দুভাষীদের চরম বিরুদ্ধাচরণ, বাংলা ও বাংলা ভাষার বিপক্ষে। ভুলে যাই যে বাংলা ভাষার গুণ-গৌরবে আমরা খুব সহজেই পৃথিবীর অধিকাংশ ভাষার শব্দ নিঁখুতভাবে উচ্চারণ করতে সক্ষম। আর এজন্যই আমরা চমৎকার আরবী, ইংরেজী, উর্দু, হিন্দী বা অন্য কোনও ভাষা অল্প আয়াসে প্রায় খুব সঠিক উচ্চারণে বলতে পারি।

 

 

প্রবাসী বাংলাদেশী ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় রয়েছে সৌদি আরবসহ বিশ্বেও বিভিন্ন দেশে। রিয়াদের তেমন একটি প্রতিষ্ঠানের বার্ষিকী প্রকাশনার সঙ্গে সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে বক্ষ্যমান লেখক জড়িত ছিলেন। ইতিপূর্বেকার প্রকাশিত স্কুল ম্যাগাজিনে মুদ্রিত সব লেখা ছিল ইংরেজি ভাষায়।

 

 

পরিচালনা পর্ষদকে দু’য়েকটি পৃষ্ঠা বাংলা ভাষায় লেখা মুদ্রনের জন্য সংরক্ষন করাতে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করি। বিভিন্ন দেশের অনুরূপ বিদ্যালয় বার্ষিকী এবং অন্যান্য যুক্তির কারনে তাঁরা অনুরুদ্ধ হন। ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে এই উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় লেখা আহ্বান করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্কুল ম্যাগাজিনে দুই এক পৃষ্ঠা বাংলা লেখা রাখার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।

 

 

কয়েকজন অভিভাবকের প্রবল আপত্তির কারনে তা আর সম্ভব হয়নি। তাদের যুক্তিÑ ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের বার্ষিকীতে বাংলা ভাষায় কোনও লেখা ছাপা হতে পারে না। পরিচালনা পর্ষদ বিনা প্রতিবাদে তা মেনে নেয়। বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের এইরূপ গর্হিত ঔদাসীন্য কমবেশি অনেক ক্ষেত্রেই পাওয়া যায়।

 

 

সেই আপত্তিকারী অভিভাবকদের একজন কোনও এক অনুষ্ঠানে আমাকে জনান্তিকে ডেকে নিয়ে বোঝালেন যেন আমি এই প্রস্তাবের পক্ষ ত্যাগ করি। অভিভাবকদেও পক্ষ থেকে আমার এক বন্ধুর মাধ্যমেও পরে  একই অনুরোধ পাঠানো হল আমার কাছে। সেই ভদ্রলোক একদিন কোনও কাজে স্কুলে এসেছিলেন। আমার দেখা পেয়ে বেশ কিছুক্ষণ নসিহতও করেছিলেন। তবে আমি অর্বাচীন।

 

 

আজও পর্যন্ত বুঝে ওঠতে পারিনি ছাত্রছাত্রীরা দু একটি লেখা বাংলায় লিখলে কী ক্ষতি হতো। আবারও বার্ষিকী প্রকাশের উদ্যোগ চলবে। তবে বাংলা ভাষার কোনও প্রস্তাব নিয়ে কেউ আসবে এমন দুঃস্বপ্নই থেকে যেতে বাধ্য বা যাবে। তাছাড়া আমি যতদিন ছিলাম ততদিন গোষ্ঠী দ্বন্ধ বা দলীয় কোন্দলে কোনও স্কুল বার্ষিকী কমিটি প্রকাশ করতে পারে নাই।

 

 

বাঙ্গালির গর্বের বিষয় বা বস্তুর আকাল নেই। কিন্তু সেই গল্পের মত অন্ধ সেজে স্বর্নপিন্ড এড়িয়ে যাওয়ার চর্চা বাঙালির জাতীয় জীবনে-মননে বর্তমানে বোধ করি যথেষ্ট জনপ্রিয়। তাই আত্মবীক্ষন নাই। আছে বাকসঞ্চালনের কারুকৃতি।

 

 

বাক্যবাগীশতার চর্যায়,চর্যার শিল্প-কুশলতায় যেন নিদ্রামগ্ন। যেন দুয়ো রানীর সোনার কাঠি রূপার কাঠির জাদুমন্ত্রবলে নিজের গৌরব,মান-মর্যাদা সম্পর্কে উদাসীনতা। আমাদের এই দূরবস্থা থেকে বের হতে হবে, জনে জনে মনে মনে দরকার হলে জাত্যভিমান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে হবে ।  এন.হুসেইন/জেসি