হোন্ডাবাহিনীর তাণ্ডবে উত্তপ্ত শহর-বন্দর
যুগের চিন্তা রিপোর্ট
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০৬:৫৬ পিএম, ১৮ মার্চ ২০২৩ শনিবার
# হোন্ডাবাহিনীর নেতা পিজা শামীম গ্রেপ্তার না হওয়ায় ভয় কাটেনি: তানভীর
# ছয় জন গ্রেপ্তার, বাকিদের গ্রেপ্তারের অভিযান অব্যাহত রয়েছে : এসপি রাসেল
নারায়ণগঞ্জের বন্দরে হোন্ডাবাহিনীয় নিয়ে জায়গা দখলের অভিযোগ উঠেছে। এসময় জমি দখলে বাধা দেওয়ায় সন্ত্রাসী বাহিনীর গুলি চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেকেন্ড ইন কমান্ড আলী হায়দার শামীম ওরফে পিজে শামীমকে প্রধান আসামী করে বন্দর থানায় মামলা করা হয়। ১৪৩/৪৪৭/৩২৩/৩০৭/৩২৫/৩২৬/৪৩৬/৪২৭/৫০৬ পেনাল কোডে বন্দর থানায় মামলা হয়।
এই ঘটনায় মামলার বাদিব তানভীর আহম্মেদ ভাবী সুমা আক্তার গুলিবিদ্ধ হয়েছে। একই সাথে তার মা মাহমুদা হক সহ পরিবারের কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে ৪ জন আহত হয়েছেন। এদিকে এই ঘটনায় টান টান উত্তেজনার পাশা পাশি নারায়ণগঞ্জ সদর বন্দরের মানুষের সাঝে আতঙ্ক চলমান রয়েছে।
এছাড়া মামলার প্রধান শহরের সন্ত্রাসী পিজে শামীম গ্রেপ্ত্রা না হওয়ায় ভুক্তভোগী পরিবার ভয়ে আছে বলে জানান তারা। তাছাড়া ৫০ টি হোন্ডা দিয়ে এই সন্ত্রাসীরা জমি দখলের জন্য যান বলে যান এলাকাবাসি। অভিযোগ রয়েছে, পিজা শামীমের পক্ষে জায়গা দখলের জন্য তার প্রধান সহযোগি মুকিত ও মনির হোসেন কন্ট্রাক্ট করে থাকেন।
তারাই বিভিন্ন এলাকাতে তাদের অনুসারীদের হোন্ডা নিয়ে এই ধরনের জায়গা দখলে অপারেশন চালান। তাদেরকে এর আগে দুই জন জনপ্রতিনিধি হোন্ডাবাহিনী নামে অবহিত করেন। সেই সাথে এই হোন্ডাবাহিনীর লাগাম টেনে ধরার জন্য আহ্বান জানা প্রশাসনের প্রতি।
খোঁজ নিয়ে জানাযায়, গত বছরে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভী এবং নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য শহরের হোন্ডাবাহিনী নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য রেখেছেন। সেলিম ওসমানের গত বছরের চেম্বার অব কমার্সের এক সভায় বলেছেন, বর্তমানে কিছু উশৃঙ্খল ছেলে পেলের জন্ম হয়েছে নারায়ণগঞ্জ শহরে।
আবার আরেকটি ভাইজান গ্রুপ হয়েছে। এই ভাইজান গ্রুপের ছেলে পেলেরা লম্বা লম্বা চুল রেখে শহরে হোন্ডা দিয়ে মহড়া দেয়। এই হোন্ডাবাহিনীর সদস্যরা কে কবে কোথায় থেকে মোটর সাইকেল কিনল, আর তা নিয়ে কিভাবে রাস্তায় মহড়া দেয়। নারায়ণগঞ্জে হোন্ডা বাহিনী চলবে না।
লম্বা লম্বা চুল রেখে আমার ফ্যাক্টরিতে মোটর সাইকেল দিয়ে গিয়ে মালিকদের ধমকা ধমকি করে তারা কারা। ডিসি-এসপি সাহেব আপনারা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। অন্যথায় আমরা লাল পতাকা নিয়ে রাস্তায় মিছিল করবো। তখন সাংসদের এই বক্তব্য শহরে টক অব দ্যা টাউনে পরিণত হয়েছে। তখন ১৫ দিনে মাঝে এই হোন্ডাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আল্টি মেটাম দেন সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান।
নাসিক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেছেন, নারায়ণগঞ্জ শহরে হোন্ডা বাহিনীর আবির্ভাব হয়েছে। বিশ-পঁচিশজন হোন্ডা নিয়ে শহরে ঘুরে বেড়ায়। আমি প্রশাসনের কাছে জানতে চাই এ হোন্ডা বাহিনী কারা ? যারা রাতের আঁধারে একসাথে ছুটে বেড়ায়? নারায়ণগঞ্জ শহরকে কি আবার খুনের শহরে পরিণত করতে চায় ? এই শহরে কি আমাদের ভয়ে ভীতু হয়ে থাকতে হবে? নিশ্চয়ই না।
জানা গেছে, রাত হলেই হোন্ডা বাহিনীর তৎপরতা বেড়ে যায়। শহীদ জিয়া হলের গেটের সামনে, কলেজ রোড, খানপুর, রেলগেইট, চাষাড়া বালুর মাঠসহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে মহড়া দেয় হোন্ডা বাহিনী। প্রতিটি বাহিনীর কাছে একাধিক অবৈধ অস্ত্র রয়েছে যা বিভিন্ন সময় প্রদর্শনও করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।
মামলা সূত্রে জানাযায়, ১৬ মার্চ বন্দরে জাতীয় পার্টি নেতা আলী হায়দার শামীম ওরফে পিজা শামীমের নেতৃত্বে নাসির, মুকিত, ডালিম, সিজারসহ ৪০-৫০ জন সন্ত্রাসী হামলায় অংশ নেয়। তারা অন্তত ১৫-২০ রাউন্ড গুলি ছোড়েন। ঘটনার সময় পুলিশও সেখানে উপস্থিত ছিলেন বলে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান।
এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ফরাজিকান্দা এলাকার প্রয়াত চেয়ারম্যান রাইসুল হকের ছেলে মঈনুল হক পারভেজ (৪২), তার স্ত্রী সোমা আক্তার (৩২), মা মাহফুজা হক (৬৫) এবং বিল্লাল হোসেন (৪৫) নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। গোলাগুলির ঘটনার পর এলাকাবাসী ২টি মোটরসাইকেলে আগুন দেয়। তার মাঝে পিজে শামীমের প্রধান হাতিয়ার মনিরের হোন্ডা একটি।
এই ঘটনায় বন্দর মডেল থানায় ১১ জনের নাম উল্লেখ্য করে ৩০জন অজ্ঞাত করে মামলা হয়। মামলার আসামীরা হলেন, মৃত রোস্তম আলীর ছেলে আলী হায়দার শামীম ওরফে পিজা শামীম, সেকান্দার মিয়ার ছেলে নুর মোহাম্মদ,রায়হান জাদা রবি,মামুন,মনির হোসেন মনা,কবির,আমির হোসেন,উৎসব,মুকিত,মুহিদ, পাঠান রনি সহ অজ্ঞাত ৩০ জনের মত।
জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল জানান, এজহার নামীয় ৫জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সচেতন মহলের মতে তাদের এই বক্তব্যের পরেও নারায়ণগঞ্জ প্রশাসন নিরব থাকায় তার মাশুল দিতে হয় বন্দরের কলাগাছিয়া ইউনিয়নের ফরাজিকান্দা এলাকাবাসিকে। কেননা এর আগে এমপি মেয়র হোন্ডাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলেছেন প্রশাসনকে।
কিন্তু প্রশাসনের নিরবতায় আজকে কয়েকজনকে সম্পদ হারা হতে হচ্ছে। অপরদিকে জীবন নিয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে হচ্ছে। তাই এই হোন্ডাবাহিনীর গুন্ডাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানান।
মামলার বাদি তানভীর আহমেদ বলেন, 'একমাস আগে পিজা শামীমের নেতৃত্বে আমাদের জায়গায় একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়। পরে কে বা কারা সাইনবোর্ডটি খুলে ফেলে। দুইদিন আগে রাত ১টায় পিজা শামীম ও তার হোন্ডা বাহিনী আমাদের বাড়িতে এসে সাইনবোর্ড খুলেছি কেন জানতে চেয়ে হুমকি-ধমকি দেয়।
এক কোটি টাকা চাঁদাও দাবি করে। ১৬ মার্চ সকালে সাড়ে ১০টার দিকে এসে তারা বাজারের চারদিকে বাঁশের বেড়া দিতে থাকে। চারদিকে তাদের হোন্ডা-বাহিনী। পরে আমার ভাই ৯৯৯ এ পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে আইসাও তাদের থামাতে পারেনি।
পুলিশের সামনেই সোয়া ১টার দিকে তারা হামলা করে। গুলি লাগে আমার ভাইয়ের বা পায়ে। তাকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হন ভাবীসহ আরও কয়েকজন। তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।'
পারভেজের চাচা আবু তালেব বলেন, তার ভাই প্রয়াত রাইসুল হক ছিলেন জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক ও কলাগাছিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। সেতুর উত্তর পাশের জমিতে এখন ফরাজিকান্দা বাজার। এই জমিটির মালিক ছিলেন হাজী জহুরা বেগম। নিঃসন্তান এই নারী তার দুই সন্তানের নামে জমি লিখে দেন।
জমিটি ৩০-৪০ বছর আগে তাদের কাছ থেকে কেনেন রাইসুল হক। এ জমিটি ক্রয়সূত্রে মালিক বলে দাবি করছেন প্রয়াত সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের স্ত্রী পারভীন ওসমান ও তার মেয়ে। তাদের পক্ষ হয়ে আজমেরী ওসমানের সহযোগী আলী হায়দার শামীম ওরফে পিজা শামীম সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে জমিটি দখল নিতে আসেন।'
ক্রয় করার সময় জমির পরিমাণ ৬৬ শতাংশ থাকলেও পরে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু ও সড়ক নির্মাণের জন্য সাড়ে নয় শতাংশ অধিগ্রহণ করা হয়। বাকি সাড়ে ৫৬ শতাংশ জমি দীর্ঘদিন ধরে রাইসুল হকের পরিবার ভোগদখল করে আসছেন বলেও জানান আবু তালেব।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বন্দর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) তসলিম উদ্দিন বলেন, ‘জমি সংক্রান্ত বিরোধে ২ পক্ষের মধ্যে মারামারি হয়েছে। সেখানে গোলাগুলির মতো ঘটনা ঘটেছে বলেও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। একজন এখন পর্যন্ত গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে তথ্য পেয়েছি। এই ঘটনায় বন্দর থানায় মামলা হয়েছে।
মামলার এজহার ভুক্ত আসামীদের ১১ জনের মাঝে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত আসামীরা হলেন, রায়হান জাদা রবি, মামুন, মনির হোসেন মনা,কবির,। এছাড়া অজ্ঞাত নামা আসামীদের মাঝে সিয়াম, পাঠান রনি নামের আরও দুজন গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ ঘটনাস্থলে ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৯৯৯ এ ২ পক্ষের ঝামেলার খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। প্রথমে অল্পসংখ্যক পুলিশ সেখানে ছিল, পরে আরও পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। এন.হুসেইন/জেসি