ছিনতাইয়ের সহজ টার্গেটে ইজিবাইক
লতিফ রানা
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ১১:৩৩ এএম, ১৪ মে ২০২৩ রোববার
# খুব সহজেই ছিনতাই করা যায় বলে এগুলো সহজ টার্গেট হয় : ওসি বন্দর
# দশ পনের হাজার টাকার জন্য তারা এদের টার্গেট করে : ওসি ফতুল্লা
# দোষীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা হলে কমিয়ে আনা সম্ভব : সচেতন মহল
অবৈধ হিসেবে পরিচিতি থাকলেও বর্তমানে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা দিনদিন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অল্প টাকার মধ্যে মিশুক এবং ইজিবাইক কিনতে পারার কারণে প্রায় পরিবারকেই দেখা যায় কিস্তিতে কিংবা ধার করে টাকার জোগাড় করে ব্যাটারী চালিত মিশুক বা ইজিবাইক কিনে জীবীকা নির্বাহ করতে।
তবে নারায়ণগঞ্জে বর্তমানে এই অটো ইজিবাইকের চালকেরাই ছিনতাইকারীদের সহজ টার্গেটে পরিণত হয়েছে। কখনো যাত্রী বেশে, কখনো ছল-চাতুরী করে আবার কখনোবা সরাসরি আক্রমণের মাধ্যমে গাড়ি চালককে ঘায়েল করে ইজিবাইকটি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে তারা। অটো ছিনতাই কিংবা অটোচালকের মরদেহ উদ্ধার এখন মিডিয়ার ধারাবাহিক সংবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আর এসব ঘটনায় প্রতিনিয়তই পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে এই পেশায় জড়িত থাকা পরিবারগুলো। অভিযোগের বেশিরভাগ সময়ই পুলিশের বিরুদ্ধে গুরুত্ব না দেওয়া এবং উদাসীনতার অভিযোগ আসে। আবার বেশ কিছু ঘটনায়ই আসামীদের গ্রেফতার এবং জবানবন্দীতে ওঠে আসে ঘটনার রোমহর্ষক বিবরণ।
যেখানে ২০/৩০ হাজার টাকার লোভের কারণে খুব সহজেই কেড়ে নেওয়া হয় একটি মানুষের প্রাণ। এসব ঘটনার মধ্যে ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ ও বন্দর এলাকায়ই বেশি ইজিবাইক ছিনতাইয়ের খবর পাওয়া যায়। তবে বন্দর উপজেলায় এই ছিনতাইয়ের হার চোখে পড়ার মতো। তবে বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে কোন প্রকার ত্রুটি রাখেন না বলে পুলিশ প্রশাসন থেকেও জানানো হয়।
মিডিয়াসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, গত ১৮ এপ্রিল মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে রূপগঞ্জের ভোলাবো স্বর্ণখালি সড়কের পূবেরগাঁও (মানিকের সড়ক) এলাকায় অটোরিকশা ছিনতাই করতে না পেরে চালক মোবারক আলীকে (৫৩) গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
পরে বাজারের পাশে গলাকাটা লাশ পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয়রা পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায়। গত ১২ মার্চ বন্দরের কাইকারটেক ব্রিজ এলাকায় ব্যাটারিচালিত একটি অটোরিকশায় যাত্রীবেশে উঠে রতন মিয়া নামক এক চালককে নেশাদ্রব্যযুক্ত শরবত পান করিয়ে অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে যায় অজ্ঞাত ৩ যুবক।
তারা বন্দর ঘাট হতে গাড়িতে উঠে বলে জানায় ভুক্তভোগী রতন। গত ১১ মার্চ রাত ১২ টায় ফতুল্লার চর কাশিপুর নাজিমুদ্দিনের বাড়ীর সামনের ফাঁকা রাস্তায় ইউসুফ (৪০) নামের এক ব্যাটারী চালিত অটো রিকশা চালককে রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে অটো রিকশাটি ছিনতাই করে পালিয়ে যাওয়ার পথে তিন ঘাতককে গ্রেফতার করে পুলিশ।
নিহত ইউসুফ লক্ষীপুরের কমলনগর থানার কালকিনি গ্রামের আলী হোসেনের ছেলে। সে ফতুল্লার পশ্চিম দেওভোগ চুনকা আলী সড়কের খানকা মোড়ে ভাড়া বাসায় করতো বলে জানা গেছে। সে পশ্চিম দেওভোগ এলাকায় সুমন মহাজনের ইজিবাইক ভাড়ায় চালাতো। গত তিন মাস পূর্বে তার স্ত্রী টিউমারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ফতুল্লার পূর্ব ইসদাইর এলাকায় রাস্তার উপর অজ্ঞাত দুষ্কৃতিকারীরা অটো রিকশা চালক দুলাল (১৯)কে হত্যা করে তার গাড়িটি ছিনতাই করে নিয়ে যায়। এই ঘটনায় ফতুল্লা থানায় মামলা দায়ের হলে বিশ্বস্ত সোর্স ও তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে ঘটনার সাথে জড়িত আসামীমের শনাক্ত করে পিবিআই নারায়ণগঞ্জ।
গত বছরের ৭ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের নাসিক ৪ নং ওয়ার্ডের আটি এলাকার ওয়াপদা কলোনী থেকে মো. সুজন মিয়া (৪৫) নামের এক ইজিবাইক চালকের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সুজন চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানার গোবিন্দপুর গ্রামের সুরুজ মিয়ার ছেলে।
তারা সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি শাহী মসজিদ এলাকায় মনসুর মাস্টারের বাড়িতে পরিবারসহ ভাড়া বাসায় বসবাস করতো। এর আগে ১ অক্টোবরে বন্দরের কলাগাছিয়া ইউনিয়নের নরপর্দী এলাকার একটি ধান ক্ষেত থেকে মো. কায়েস (১৫) নামে কিশোর ইজিবাইক চালকের হাত-পা ও মুখ বাঁধা গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এর চার দিন আগে ইজিবাইক নিয়ে নিজ বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয় কায়েস। বন্দর থানার নাসিক ২৪ নং ওয়ার্ডের নবীগঞ্জ অলিম্পিক হাউজিং এলাকার আবুল কাশেমের ছেলে। গত ১২ সেপ্টেম্বর বন্দরের কলাগাছিয়া ইউনিয়নের কান্দিপাড়া এলাকা থেকে ফেরদৌস (২২) নামের এক অটোরিকশা চালকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তাকে হত্যা করে তার অটোরিকশাটি দুর্বৃত্তরা ছিনিয়ে নিয়েছে বলে জানা যায়। ফেরদৌস কলাগাছিয়া ইউনিয়নের শুভকরদী এলাকার নজরুল ইসলামের ছেলে।
গত ২৯ আগস্ট সিদ্ধিরগঞ্জের ধনকুন্ডা মদিনাবাগ এলাকা থেকে সড়কের পাশ থেকে রোকন (২৪) নামে এক ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চালকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তার গলা, বুক ও হাতে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলে জানায় পুলিশ। রোকন এর আগের দিন রাত দশটার দিকে ইজিবাইক নিয়ে বের হয় বলে জানা যায়।
কিন্তু তার মরদেহের পাশে ইজিবাইকটি পাওয়া যায়নি। ২৬ এপ্রিল সদর উপজেলার চর সৈয়দপুর এলাকায় গলায় দড়ি প্যাচানো অবস্থায় মো. আপন (১৭) নামের এক ইজিবাইক চালকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আপন জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জের আনন্দবাড়ি এলাকার আব্দুল সাত্তারের ছেলে। সে পরিবারের সাথে চর সৈয়দপুরের ফকিরবাড়ি এলাকায় ভাড়াবাড়িতে থাকতো।
সবকিছু মিলিয়ে নারায়ণগঞ্জে ছিনতাইকারীদের কাছে এই ইজিবাইক এখন জীবনের চেয়েও বেশি মূল্যবান হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রতি মাসেই ইজিবাইক ছিনতাইকারী চক্রের হাতে খুন হয়েছেন ইজিবাইক চালক এবং ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে তাদের গাড়িগুলো। তবে চুরি কিংবা ছিনতাই হওয়ার অভিযোগ করা হলে পুলিশ প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করে বা গুরুত্ব দেয় না বলে অনেক ভূক্তভোগীই অভিযোগ কারেন।
তাদের মতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিনতাই ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর পুলিশ প্রশাসনকে সরব হতে দেখা যায়। এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটের সদস্যসহ ছিনতাইকৃত ইজিবাইক, আশ্রয়দাতা এবং যে সব গ্যারেজ মালিকেরা এই ইজিবাইক কিনে নেয় তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারলে এবং কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারলে এই ঘটনা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব বলে সচেতন মহলের ধারণা। কিন্তু এই বিষয়ে পুলিশ যথেষ্ট আন্তরিক বলে পুলিশ প্রশাসন থেকে জানানো হয়। তারপরও থামানো যাচ্ছে না এ চক্রকে।
বন্দর থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) আবু বকর সিদ্দীক বলেন, অটো ইজিবাইক কিংবা অটো রিকশার উপর ছিনতাইকারীদের টার্গেট আজকে নতুন কিছু না। এটা বহু বছর যাবতই। এই গাড়িগুলো খুব সহজেই ছিনতাই করা যায় তাই এদের উপর টার্গেট বেশি। তাই এসব গাড়ির চালকদেরও সচেতন থাকতে হবে। গভীর রাতে এই গাড়িগুলো চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে, কোন নিরিবিলি জায়গায় যাত্রী নিয়ে যাওয়া যাবে না। একটু সচেতন থাকলে এসব ঘটনা অনেকটাই এড়ানো সম্ভব হবে।
ফতুল্লা থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) রিজাউল হক দিপু বলেন, অটো ইজিবাইক কিংবা অটো রিকশার কোন লাইসেন্স থাকে না, কোন কাগজপত্র থাকে না, এগুলোর মধ্যে কয়েকটি ব্যাটারী থাকে যেগুলো একজন দুষ্কৃতকারী খুব সহজেই খুলে নিয়ে পাঁচ দশ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিতে পারে।
এই দশ পনের হাজার টাকার জন্য তারা এসব গাড়ি চালকদের খুব সহজেই টার্গেট করে। আমাদের এই থানায় গত এক বছরে এ ধরণে ঘটনায় যতগুলো মামলা হয়েছে, আমরা তার প্রত্যেকটি মামলার ডিটেকশন করেছি। দুষ্কৃতকারীদের ধরে আইনের আওতায় এনেছি। আমাদের এই এলাকাটি খুব ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় এখানে অপরাধা প্রবণতা একটু বেশি। তবে আমরাও তা শক্ত হাতে হ্যান্ডেল করাসহ জোরদার টহলের ব্যবস্থা করে থাকি। আমরা একই সাথে এই বিষয়ে খুবই আন্তরিক। এন.হুসেইন রনী /জেসি