রথযাত্রা উৎসব আজ : ভক্ত ভগবানের মিলনমেলা
রণজিৎ মোদক
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০৯:১৮ পিএম, ২০ জুন ২০২৩ মঙ্গলবার
শ্রীল প্রভূপাদ নিভৃতে তার শিষ্যদের সাথে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, পুরীতে জগন্নাথ দেবের বিগ্রহের সম্মুখে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু এত ভাব বিহবল হয়ে নৃত্য করতেন যে কন্ঠে জগঃ জগঃ আর কিছু বলতে পারতেন না। আজ সেই কাংখিত শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা মহোৎসব। সনাতন বৈষ্ণব ধর্মালম্বী হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় মহা মিলন উৎসব।
শ্রীধাম বৃন্দাবনে ব্রজ গোপিকাদের ছেড়ে নন্দ নন্দন শ্রী কৃষ্ণ যখন রথে আরোহন করেন, তখন বৃন্দাবনবাসী অশ্রু সজল নয়নে মিনাক্ষী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। দীর্ঘদিন পর প্রিয়জনকে কাছে পেয়ে আনন্দে হৃদক্রীয়া বন্ধ হতে পারে। সে কারণে প্রথমে বলদেব পরে ভগ্নি সুভদ্রা দ্বারকায় গিয়ে দ্বারকাবাসীকে শান্তনা প্রদান করেন।
এইতো শ্রীকৃষ্ণ অচিরেই আপনাদের সম্মুখে এসে সমস্ত দুঃখ যন্ত্রনা মোচন করবেন। রাজ কর্মচারী আর স্বয়ং রাজার আগমন এক কথা নয়। রাজা আসছেন প্রজা দর্শনে আর প্রজারা দর্শন পাবেন রাজার। রাজা প্রজার মিলন মেলার নাম হচ্ছে রথ মেলা। তাই বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ তার কবিতায় বলেছেন, আমরা সবাই রাজা আমাদের এ রাজার রাজত্বে। নইলে মোরা রাজার সাথে মিলবো কি সত্ত্বে।
রাজার সাথে প্রজার মিল না হলে কি হয়? শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেব হচ্ছেন কৃপাময়। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভূ হচ্ছেন মহাভাবের ভাবিনী শ্রীমতি রাধা রাণীর অঙ্গকান্তি। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভূ শ্রী জগন্নাথ দেবকে গুন্ডিচা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া এবং শ্রীমতি রাধা রাণী কৃষ্ণকে বৃন্দাবন নিয়ে যাওয়ার লীলা। ভগবানের সাথে ভক্তের এবং ভক্তের সাথে ভগবানের মিলন এক ঐশ্বর্য লীলা।
শ্রীমৎ ভক্তি চারু স্বামী মহারাজ রথযাত্রা উৎসব ভগবানের করুণার প্রকাশ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সুন্দরের সুন্দরতম ভক্তের অন্তরের বাসনাসহ রথ যাত্রার ইতিহাস তুলে ধরেছেন। দ্বারকার কৃষ্ণ আর বৃন্দাবনের কৃষ্ণ এক নয়। কুরুক্ষেত্র থেকে রাজধানী ফিরছেন শ্রী কৃষ্ণ বলরাম বোন সুভদ্রা। ও চারপাশে অনেক রাজপুরুষ সৈনিক। কৃষ্ণের বেশ অন্যরকম। গোপ বেশের পরিবর্তে রাজবেশ। হাতে বাঁশির পরিবর্তে ধনুর্বাণ।
এ কৃষ্ণ দর্শন করে গোপীদের মন ভরেনি। শ্রীমতি রাধা রাণী বললেন এ কৃষ্ণ আমাদের কৃষ্ণ নয়। আমাদের কৃষ্ণের গলে বনফুলের মালা, হাতে বাঁশি, পীতবসন, মাথায় ময়ূর পাখা। আর এ কৃষ্ণের পরনে তো রাজবেশ। রাজবেশে তোমায় মানায় না। শ্যাম রাখাল বেশে মানায় ভালো।
রাধা রাণীর মনের ভাব বুঝতে পেরে গোপীরা নিজেরাই রথের দড়ি ধরে, ঘোড়া ধরে রথ টেনে বৃন্দাবনের দিকে চললেন। পুরীর এই রথযাত্রাটি হচ্ছে গোপীদের সেই কুরুক্ষেত্র রথযাত্রার দ্যোতক। রথের সময় জগন্নাথ বা কৃষ্ণকে নিয়ে যাওয়া হয় নীলাচল থেকে সুন্দরাচলে। অর্থাৎ গুন্ডিচা মন্দিরে সেটিই বৃন্দাবন।
পুরীর জগন্নাথ মন্দির থেকে গুন্ডিচা মন্দির যাতায়াত হচ্ছে রথ উৎসব। শ্রী কৃষ্ণ ভক্তি পরায়ণ চির শুভাকাঙ্খী জয় পতাকাস্বামী বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে রথযাত্রা এমন একটি উৎসব যেখানে শ্রী শ্রী জগন্নাথদেব স্বয়ং পথে নেমে আসেন এবং সকলকে কৃপা করেন। যে কেউই বিগ্রহ দর্শন, রথটানা, নৃত্য এবং মহা প্রসাদ গ্রহন করে এ রথে অংশ নিতে পারেন।
শিব শংকর চক্রবর্তী তার কৃষ্ণ ও জগন্নাথ প্রবন্ধে শাস্ত্র উল্লেখ করে বলেছেন, রথস্থং বামনং দৃষ্টা পূর্ণজন্ম ন বিদ্যতে। রথে যদি বামনকে দেখা যায় তবে পূর্ণজন্ম হয় না। নারদ পূরান এবং স্কন্দ পুরানে উল্লেখিত। উড়িষ্যার রাজা ইন্দ্রদুন্ন্য মন্দির তৈরি করেন, বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করার জন্য। কি বিগ্রহ স্থাপন করবেন সে বিষয় তিনি স্থির করতে পারলেন না।
ব্রহ্মলোক থেকে এসে দেখে তার মন্দির বাসগৃহ কিছুই নেই। পূনঃ মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন। কিন্তু বিগ্রহ তৈরি করবে কে? মহানামা নামে এক বৃদ্ধ শিল্পী রূপে শর্ত দিয়ে ২১ দিনের মধ্যে বিগ্রহ নির্মাণ করে দিবেন। চৌদ্দ দিন বাদে বিগ্রহ নির্মাণে কোন প্রকার শব্দ শোনা যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত কোমলমতি মহারাণীর অনুরোধে মন্দিরের দরজা খোলা হলো, দেখা গেল শিল্পী অদৃশ্য।
হাত পা বিহীন তিনটি বিগ্রহ রয়েছে। ন তস্য কার্যং করণং চ বিদ্যতে, ন তৎ সমশ্চাভ্যবিকশ্চ দৃশ্যতে। সে ভগবানের প্রাকৃত ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে কোন কার্য নেই। যেহেতু তাঁর প্রাকৃত দেহ ও প্রাকৃত ইন্দ্রিয় নেই। চিন্ময় শরীর ও চিন্ময় ইন্দ্রিয় রয়েছে। তিনটি দারু ব্রহ্ম থেকে এ তিনটি বিগ্রহ নির্মিত।
শ্রীমদ্ভগভদ গীতায় ভগবান বলেছেন, আমি যার তার হাতে খাই না। কেউ যদি ভক্তি ভরে তুলসী পাতায় একটু জলও দান করে, তা আমি সাদরে গ্রহণ করি। শুধু তাই নয় আমি শুদ্ধ ভক্তের কাছে ঋণী হয়ে থাকি এবং সেই ঋণ পরিশোধের জন্য সদা তার কাছে কাছে থাকি। কলি যুগে ভগবান তার ভক্তের হাতে খান।
পুরীতে রথযাত্রা উৎসবে লোকে-লোকারণ্য তিল ঠাঁই ধারণের জায়গা নেই। স্বয়ং শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভূ রথ ধরে ক্রন্দন করছেন। উড়িষ্যার এক ভক্ত মহিলা শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভূর কাধে পা রেখে রথের শ্রীশ্রী জগন্নাথ দর্শন করতে ব্যাকুল। এ দৃশ্য দেখে অনেক ভক্তই ঐ মহিলার ওপর কুপিত হলেন। কিন্তু চৈতন্য দেব বললেন, “ভক্তের ভগবান দর্শনে ব্যাকুলতাকে অনুসরণ করো, অপরাধকে নয়।” এ হচ্ছে ভক্তের ভাবাশ্রীত প্রয়াস।
পুরীর রথকে নিয়ে বিভিন্নজনের ভিন্নমত থাকলেও গীতার সাংখ্য যোগের তথ্য কথা এসে যায়। দেহ এবং দেহীকে নিয়েই রূপায়িত এই রথ। মানবদেহ গঠিত দুইশত ছয়টি হাঁড় দিয়ে এবং দশ ইন্দ্রিয় ছয় রিপু। তাই পুরীর রথে দুইশত ছয়টি কাঠ ও ষোলো চাকা বিশিষ্ট এই রথ নির্মাণ করা হয়। আত্মারূপী রয়েছেন জগন্নাথ।
অজিত কুমার দত্ত তার রথ যাত্রা একটি দর্শন সমীক্ষায় বলেছেন, নারায়ণের তিন অংশ, কৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রা। মানবদেহ রূপ রথে পরমাত্মার অবস্থান এবং নির্গম প্রক্রিয়াই মূলতঃ রথযাত্রা অনুষ্ঠান। জীব দেহ রথ আর জীবদেহে যিনি অবস্থান করেন তিনি রথী। রথযাত্রা উৎসব হচ্ছে ভগবানের মিলন মেলা।
তাই এই উৎসবকে শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের মহোৎসব বলা হয়েছে। রথ পরে অবস্থান রথ জগন্নাথ দেবের যতদূর দৃষ্টি যায়, ততদূর শান্তির বাতাস বইতে থাকে। স্বামীবাগ আশ্রম একটি পারমার্থিক চর্চার প্রাণ কেন্দ্র। নয়দিন ব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে রথ উৎসব। সাভারের ধামরাই যশ মাধবের রথ মেলা।
তাছাড়া নারায়ণগঞ্জস্থ দোওভোগ ইস্কন মন্দির, বালাজি মন্দির, নিতাই গৌর আখড়া, পাগলার পাগল নাথ মন্দির, ব্রাহ্মণগাঁও শ্রী শ্রী দূর্গা মন্দির, ঢাকার বনগ্রাম শ্রী শ্রী রাধা গোবিন্দ জিউ মন্দির, ২২২ লালমোহন সাহা ষ্ট্রীট শ্রী শ্রী রাধা কান্ত জিউ মন্দির, টাঙ্গাঈলের নারান্দিয়া সংঘের উদ্যোগে রথ উৎসব পালিত হচ্ছে।
জগন্নাথ দেবের রথযাত্রায় অংশগ্রহন করে যে সকল ভক্ত ভক্তি ভরে রথের রশি টানেন। নৃত্য কীর্তণ করেন। এমন কি শোভা যাত্রায় অংশগ্রহন করেন। কোন না কোনভাবে রথোপবিষ্ট জগন্নাথদেবকে দর্শন করেন। তারা জড় জগতের ক্লেশ মুক্ত হয়ে চিন্ময় বৈকুষ্ঠ জগতে ফিরে যাবেন। তাতে কোন সন্দেহ নাই।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ, হিন্দু কল্যাণ সংস্থা, হিন্দু মহাজোট ও নারায়ণগঞ্জ ইসকন রথযাত্রা মহ্ৎোসবে বিশ্ব শান্তি ও দেশের কল্যাণে সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। জগন্নাথ স্বামী নয়ন পথগামী ভবতুমে। নীলা চলে মহা প্রভূ জয় জগন্নাথ। যেই গৌর সেই কৃষ্ণ সেই জগন্নাথ। হরে কৃষ্ণ। এন. হুসেইন রনী /জেসি