রূপগঞ্জে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় অবৈধ কয়েল কারখানা যেন বিষ ফোঁড়া
রূপগঞ্জ প্রতিনিধি
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০৮:১৪ পিএম, ১৩ জুলাই ২০২৩ বৃহস্পতিবার
রূপগঞ্জ উপজেলার মৈকুলী এলাকায় সানমুন জাম্বো কয়েল নামে একটি অবৈধ কয়েল ফ্যাক্টরী স্থানীয়দের কাছে যেন বিষফোড়া হয়ে আছে। জনবসতিতে কয়েল ফ্যাক্টরী থাকার কারণে স্বাস্থ্য ঝুকিতে রয়েছে স্থানীয় প্রায় অর্ধলক্ষ্য মানুষ। কয়েল ফ্যাক্টরীটির কোন বিএসটিআই অনুমোদন নেই।
এছাড়া কারখানাটির পরিবেশের ছাড়পত্র, কলকারখানা অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিসের কোন সার্ভিসের অনুমোদন নেই। এছাড়ার কারখানার ভেতরে শিশু শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে কারখানাটির বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ থাকলেও ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না। এছাড়া কারখানা মালিকপক্ষের দাবি প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই তারা কয়েল কারখানাটি চালাচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তারাব পৌরসভার মৈকুলী এলাকায় অবস্থিত সানমুন জাম্বো কয়েল ফ্যাক্টরীটির মালিক খাদুন এলাকার মকবুল হোসেন ভুইয়া নামে একজন। মকবুল হোসেন ভুইয়া খাদুন এলাকার স্থানীয় বড় বড় কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ীর শেল্টার দাতা হিসেবেও কাজ করে বলে জানা গেছে।
মকবুল হোসেন ভুইয়া কারখানাটির মালিক হলেও কারখানাটি নিয়ন্ত্রণ করেন তারাব পৌরসভার ৫ নং ওয়ার্ডের মহিলা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফাতেমা আক্তার। তার প্রভাবেই প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে ম্যানেজ করে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে কারখানাটি চালিয়ে আসছে মকবুল হোসেন ভুইয়া ও ফাতেমা আক্তার।
সানমুন নামের কয়েল ফ্যাক্টরীটির কোন প্রকার অনুমোদন নেই। এছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তর ও কল-কারখানা অধিদপ্তরেরও কোন প্রকার ছাড়পত্র নেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। কারখানাটির ভেতরে নেই কোন প্রকার অগ্নি নির্বাপনের ব্যবস্থা। একারণে কারখানাটিতে প্রতিনিয়ত অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে আসছে।
গত ৬ মে দুপুরে কারখানাটিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটনা। পরে গত ১০ জুলাই রাতেও কারখানাটিতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ১০ জুলাই অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর থেকেই বেরিয়ে আসতে থাকে কারখানাটির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিস্তর অভিযোগ।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে জানান, কারখানাটির আশেপাশে প্রায় অর্ধলক্ষ্য মানুষের বসবাস। কারখানাটিতে কয়েল তৈরী ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্বমানের মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক। এসকল নিম্বমানের রাসায়নিক মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দীর্ঘদিন ধরে কয়েল কারখানাটি চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মাদক ব্যবসায়ীদের শেল্টারদাতা মকবুল ও মহিলা লীগ নেত্রী ফাতেমা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ সাহস কেউ পায় না। এছাড়া কারখানাটির পাশেই রয়েছে মৈকুলী ইসলামীয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসা। যেখানে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কোর-আন শিক্ষা গ্রহণ করে।
কয়েল কারখানার রাসায়নিকের ধোঁয়ায় শিক্ষার্থী অসুস্থ্য হয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। চিকিৎসকদের মতে, কয়েল ফ্যাক্টরীতে ব্যবহৃত নি¤œমানের রাসায়নিক থেকে ফুসফুসের ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, চোখে জালাপোড়াসহ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগ হতে পারে।
নাম প্রকাশ না শর্তে এক যুবক জানান, কয়েল ফ্যাক্টরীরর ধোয়ার কারণে প্রায় সময়ই আমাদের শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এমন জনবসতিপূর্ণ এলাকায় কয়েল ফ্যাক্টরী করেছে তারা প্রভাবখাটিয়ে। কয়েল কারখানার জন্য আমাদের সাধারণ মানুষের অনেক সমস্যা হচ্ছে।
মহিলা লীগ নেত্রী ফাতেমা ও মকবুল প্রভাবশালী হওয়ার কারণে আমরা এলাকার মানুষ তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করতে পারছি না। প্রশাসন ম্যানেজ করেই এ কারখানাটি চলছে বলেই অবৈধ কারখানাটি কেউ সিলগালা করতে আসছে না।
স্থানীয় বাসিন্দা রেজাউল করিম বলেন, কয়েল কারখানার ধোঁয়ার কারণে আমরা শান্তিতে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে পারছি না। যেখানে ডাক্তাররা বলে থাকে একটি কয়েলের ধোঁয়া ১’শ সিগারেট থেকেও বিপজ্জনক সেখানে মৈকুলীর মতো একটা জনবসতিপূর্ণ এলাকায় কয়েল কারখানা করে রেখেছে। এতে পরিবেশের যেমন ক্ষতি হচ্ছে তেমনি স্থানীয় মানুষরা অসুস্থ্য হয়ে পড়ছে।
কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা রমজান, মঈন মিয়াসহ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, এই কয়েল কারখানার পাশে একটি মাদ্রাসা ও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। একই কয়েল কারখানার ধোঁয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো ক্লাস করতে পারছে না। বিষাক্ত ধোঁয়ায় শিশুরা শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যদি অবিলম্বে এ অবৈধ কয়েল কারখানা সিলগালা না করা হয় তাহলে আমরা আন্দোলনসহ মহা-সড়ক অবরোধ করবো।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (টিএইচও) আইভী ফেরদৌস বলেন, কয়েলের ধোয়া একটা বিষ। কয়েল কারখানা যদি নির্দিষ্ট না মেনে কয়েল তৈরী করে তাহলে এটি মানুষের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। এটার ধোয়া থেকে প্রাথমিকভাবে মাথা ঘুরানো, বমিভাব, ফুসফুসের সমস্যা ও পরে ক্যান্সারসহ জটিল রোগ মানুষের শরীরে বাসা বাধতে পারে।
ফায়ার সার্ভিসের ইন্সপেক্টর (রূপগঞ্জ) শফিকুল ইসলাম বলেন, সানমুন কয়েল নামে কোন কয়েল ফ্যাক্টরীর কেউ এখনো আমার কাছে ফায়ার লাইসেন্সের জন্য আসেনি।
নারায়ণগঞ্জ কল-কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক রাজীব চন্দ্র দাস বলেন, সানমুন কয়েল ফ্যাক্টরী নামে কোন কয়েল ফ্যাক্টরীর আমাদের কাছ থেকে লাইসেন্স নেয়নি। যেহেতু কারখানাটি লাইসেন্স নেই তাদের কারখানা পরিদর্শন করে আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
ঢাকা বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক জিসান আহমেদ তালুকদার বলেন, চনপাড়ায় সানমুন একটি কয়েল কারখানা আমাদের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়েছে যার মালিকের নাম আবু বক্কর সিদ্দিক। তবে গোপন সূত্রে জানতে পারলাম মৈকুলী এলাকায় মকবুল নামে একজন সানমুন নামে নকল কয়েল ফ্যাক্টরী গড়ে তুলেছে। শীঘ্রই আমরা প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে ব্যবস্থা করবো। কয়েল ফ্যাক্টরীর বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্সে রয়েছি।
নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, সানমুন নামে কোন কয়েল ফ্যাক্টরী আমাদের কাছ থেকে অনুমোদন নেয়নি। কারখানাটি হয়তো চুরি করে তাদের কারখানা চালাচ্ছেন। আমরা এই কারখানাটির বিরুদ্ধে আমরা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
এ ব্যাপারে রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফয়সাল হক বলেন, আমরা তদন্ত করে দেখবো। যদি কারখানাটির কোন প্রকার কাগজপত্র না থাকে তাহলে অবৈধভাবে উৎপাদনের দায়ে কারখানাটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ ব্যাপারে মহিলা লীগ নেত্রী ফাতেমা আক্তারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ব্যবহৃত ফোনটি রিসিভ করেননি।
এ ব্যাপারে কারখানাটির মালিক মকবুল হোসেন ভুইয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমার কারখানার সবকিছু কাগজপত্র আছে। আপনি আমার সাথে সরাসরি এসে দেখা করেন। এন.হুসেইন রনী /জেসি