বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১   ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৯:৩৩ পিএম, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ বুধবার

 

ক্রমাগত ভাবেই বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ। শহরটিতে এখন রাম রাজত্ব কায়েম হয়েছে বলে মনে করেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীসহ সমগ্র নারায়ণগঞ্জবাসী। নারায়ণগঞ্জবাসীর মতে, নগরীর প্রধান সড়ক তথা বঙ্গবন্ধু সড়কটিতে চলছে হরিলুটের রাজত্ব। যে যেভাবে পারছে সড়কটিকে ব্যবহার করছে নিজ নিজ ফায়দা হাসিলে, যার কারণে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে শহরবাসীকে।

 

শহরবাসীর সাথে আলাপ করে জানা গেছে, শহরের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, হকারদের কারণে সড়ক ও ফুটপাত দখল হওয়া, পরিবহন চালক ও শ্রমিকদের অসচেতনতা, যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী উঠানামা করা, দিনের পাশাপাশি রাতেও তীব্র যানজট সৃষ্টি করে রাখা, বঙ্গবন্ধু সড়কের পার্শ্বে নির্মিত ভবনগুলোর প্রায় ৯০% ভবনেই কার পার্কিংয়ের জায়গা না রাখা, অবৈধ ইজিবাইক ও অটোরিক্সার চাপে সড়কের প্রত্যেক মোড়ে মোড়ে অবৈধ স্ট্যান্ড, অদক্ষ চালকদের কারণে অযথাই যানজটের মাত্রা বৃদ্ধি, সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতাসহ অসংখ্য কারণে বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ শহরটি বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হয়ে যাচ্ছে।

 

আর এসবের অধিকাংশই হচ্ছে মোটা অংকের চাঁদাবাজির কারণে। হকার বসিয়ে ফুটপাত থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা, অবৈধ অটোরিক্সা ও ইজিবাইক থেকে পুলিশ, কথিত সাংবাদিক সহ বড় ভাইরা মোটা অংকের চাঁদাবাজি করছে। এক শ্রেণীর লোক ফুলে ফেপে কলা গাছ হলেও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে শহরবাসীকে।

 

ফুটপাতের হকারদের অনেকের সাথেই কথা বলা জানা যায়, শহরের অধিকাংশ ফুটপাতই রয়েছে প্রভাবশালী এক এমপির চ্যালা চামচাদের দখলে। এসব ফুটপাতে কারা বসবে, কত টাকা সালামি দিয়ে বসবে, দৈনিক কত টাকা ভাড়া দিবে এসবই নির্ধারণ করে ঐ এমপির চামচাদের চামচারা। এখান থেকে মাস শেষে মোটা অংকের একটি ভাগ যায় গডফাদার খ্যাত ঐ এমপির পকেটেও।

 

তবে, নগরীর ১৫নং ওয়ার্ডের ১নং রেলগেইট থেকে পোস্ট অফিসের মোড় পর্যন্ত ফুটপাতটি আবার নিয়ন্ত্রণ করেন সিটি কর্পোরেশনের একজন কাউন্সিলর ও তার লোকজন। যদিও প্রকাশ্যে কেউ তার নাম বলে না। কিন্তু ফুটপাতের দোকানীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মূলত ঐ কাউন্সিলরের বিভিন্ন মিটিং মিছিলে যেতে হবে, এমন শর্তে এখানে হকারদের বসতে দিয়েছেন তিনি।

 

অটোরিক্সা ও ইজিবাইক চালকরা জানান, শহরে ইজিবাইক চালাতে হলে চাঁদা দিতে হয় ৩ স্তরে। প্রথমে গ্যারেজ মালিক বলে প্রতিদিন ৬০ টাকা দিলে বিশেষ পেশার মানুষদের একটি কার্ড দিবো, যেটা দেখালে পুলিশ আর অটোরিক্সা আটকাবেনা। শহরে ঢোকার পর, আবার ট্রাফিক পুলিশ ও তাদের কথিত সহযোগীরা গাড়ি আটকায় এবং বলে ৫০ টাকা দে, সারাদিন শহরে গাড়ি চালাবি কেউ কিছু করবে না, গাড়িও ধরবে না।

 

তারপর আবার রাত ৮টার পর যখন ট্রাফিক পুলিশের ডিউটি পরিবর্তন হয়, তখন যে ট্রাফিকরা আসেন তাদের আবার ট্রিপ প্রতি দিতে হয় ৩০ টাকা। কি করবো ভাই, আমরা তো গরীব মানুষ কাজ করে খাই। টাকা না দিলে কোনো না কোনো বাহানায় গাড়ি ডাম্পিংয়ে নিয়ে যাবে। তাই বাধ্য হয়েই টাকা দিয়ে দেই।

 

এছাড়া, শহরের চাষাড়া মোড়, গলাচিপার মোড়, ২নং রেল গেইট মোড় ও জিমখানা মোড়ে অত্যন্ত ১০টি অবৈধ স্ট্যান্ড গড়ে তুলেছে এক শ্রেণীর চাঁদাবাজ লোকেরা। যাদের অধিকাংশই প্রভাবশালী ঐ এমপি ও সরকার দলীয় সমর্থক বলে জানা গেছে। এছাড়া, শহরের চিহ্নিত সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত এক নারী কাউন্সিলরের স্বামী ও তার ভাসুর নিয়ন্ত্রণ করে শহরের সবচেয়ে বড় অবৈধ স্ট্যান্ড।

 

যেটি জিমখানায় গড়ে তুলেছে ঐ সন্ত্রাসীরা। এসব স্ট্যান্ড থেকে মাসে প্রায় অর্ধকোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়, যার একটি বড় অংশ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সন্ত্রাসী প্রকৃতির লোক ও পুলিশের অসাধু সদস্যদের পকেটে যায় বলে জানায় চাঁদাবাজ চক্রের অনেকে। এ সকল স্ট্যান্ডের কারণে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয় নগরবাসীকে।

 

এছাড়া, বঙ্গবন্ধু সড়কের পার্শ্ববর্তী ভবনগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ ভবনেই নেই কার পার্কিং। অধিক লাভের আশায় কার পার্কিং কে বাণিজ্যিক প্লেস হিসেবে ব্যবহার করছে তারা। ফলে প্রায় প্রতিটি ভবনের সামনেই সারি সারি গাড়ি দাড়িয়ে থাকে এবং যানজটের কবলে পড়ে নগরবাসী।

 

বিশেষ করে পপুলার ডায়াগনষ্টিকের সামনে এসেই থমকে যায় গাড়ির চাকা। তবে, কোনো প্রতিকার মিলে না নগরবাসীর। এর পেছনেও রয়েছে বড় ভাইয়ের হাত। পপুলারের মালিক পক্ষ আবার ঐ বড় ভাইয়ের মুরিদ বলে জানা গেছে। আর সেই জোরেই কারো কথায় কোনো কর্ণপাত করে না এবং কোনো ব্যবস্থাও নেয় না কর্তৃপক্ষ।

 

অপরদিকে, বঙ্গবন্ধু সড়ক দখল করে রাখা অবৈধ ব্যবসায়ী তথা হকাররা তাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন ময়লা আবর্জনা প্রতিদিন সড়কের উপরেই ফেলে যায়। এসব ময়লা আবর্জনা একসময় গিয়ে ড্রেনে পড়ে, ড্রেনেজ ব্যবস্থায় বাধা সৃষ্টি করে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই শহরের মূল সড়ক হিসেবে পরিচিত বঙ্গবন্ধু সড়কটিতে হাঁটুপানি জলাবদ্ধতারও সৃষ্টি হয়।

 

সর্বশেষ, গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ঘন্টা দুয়েকের বৃষ্টিতেই তলিয়ে গেছে নগরী। বঙ্গবন্ধু সড়কের ২নং রেল গেইট এলাকা থেকে চাষাড়া মোড় পর্যন্ত রাস্তার দু পাশেই হাঁটু পানি জমে। রাস্তার পাশের কয়েকটি মার্কেটেও এই পানি প্রবেশ করে।

 

সবচেয়ে বেশী পানি দেখা যায়, নুর মসজিদের সামনে থেকে মার্ক টাওয়ার মার্কেট পর্যন্ত সড়কের দু পাশেই। এতো বৃষ্টি এবং সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হওয়ার পরেও নগরীতে যানজটের মাত্রা ছিলো তীব্র। ২নং রেল গেইট থেকে চাষাড়া আসতে সময় লেগেছে প্রায় ঘন্টা খানেকেরও বেশী। একদিকে জলাবদ্ধতা, অপরদিকে তীব্র যানজটে অসহনীয় ভোগান্তি পোহাতে হয় শহরবাসীকে।

 

নগরবাসী বলছে, প্রায় ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে আওয়ামীলীগ। দীর্ঘ এই সময়ে উন্নয়নের ছোয়া লেগেছে দেশের সর্বত্র। অজপাড়া গাঁয়ে ও বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে হয়েছে অভূতপূর্ব উন্নয়ন। পাল্টে গেছে, অনেক শহরের চিত্র। কিন্তু কাঙ্খিত উন্নয়ন হয়নি নারায়ণগঞ্জে।

 

নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য, প্রভাবশালী এমপি শামীম ওসমান, তার ভাই দানবীর খ্যাত নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান ও ন্যায়ের মূর্ত প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর মতো জাদরেল ও জনপ্রিয় রাজনীতিবীদরা থাকতেও নারায়ণগঞ্জে কেন হয়নি কাঙ্খিত ও পরিকল্পিত উন্নয়ন, কেন এই শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে জানতে চায় নগরবাসী।

 

তারা বলছে, অচিরেই নারায়ণগঞ্জের উন্নয়নে, নারায়ণগঞ্জ শহরকে বসবাস যোগ্য শহরে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে ভুমিকা রাখতে হবে এমপি-মেয়রসহ সকল জনপ্রতিনিধি, জেলা ও পুলিশ প্রশাসনকে। জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে প্রতিটি সরকারী প্রতিষ্ঠানকে। নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলে এই নগর আবারও ফিরে পেতে পারে তার হারানো সৌন্দর্য্য। তাই সকলকে এক টেবিলে বসে নারায়ণগঞ্জের প্রধান প্রধান সমস্যাগুলোর দিকে নজর দিতে এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানিয়েছে নারায়ণগঞ্জবাসী। এস.এ/জেসি