‘অস্ত্র জমা দিয়েছি, ট্রেনিং জমা দেই নাই’
যুগের চিন্তা রিপোর্ট
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০৮:১৬ পিএম, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ শুক্রবার
নারায়ণগঞ্জে বর্তমানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে হকার ইস্যু। শহরের বহুল পরীক্ষিত প্রেস ক্লাবে আয়োজিত জনপ্রতিনিধিদের গোলটেবিল বৈঠকের মাধ্যমে দীর্ঘ ১৪ দিন যাবৎ ফুটপাত হাত ছাড়া হওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে শহরের হকার ও তাদের নেতারা। ফুটপাতের রাজত্ব আবারো ফিরে পেতে প্রশসান ও জনপ্রতিনিধিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছে হকাররা। আর তাদের সাথে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন শহরের কিছু বাম রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দরা। এদিকে তারা জনপ্রতিনিধিদের কাছে পূনর্বাসনের আহ্বান জানাচ্ছে আবার তার পাশাপাশি তাদের রক্ত চক্ষু গরম করে নানাভাবে নানা হুঁশিয়ারী দিচ্ছে।
গতকাল ১৫ ফেব্রুয়ারি হকার সংগ্রাম পরিষদের আয়োজনে সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের নিকট স্মারক লিপি জমা দেওয়ার পূর্ব মুহুর্তে চাষাড়া শহিদ মিনারে সংক্ষিপ্ত অবস্থান কর্মসূচিতে জেলা হকার সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আসাদুল ইসলাম আসাদ হকারদের পূর্নবাসন ও তার আগমুহুর্ত পর্যন্ত ফুটপাতে হকারদের বসার আহ্বান জানিয়েছেন। আর জনপ্রতিনিধির উদ্দেশ্য হুঁশিয়ারী দিয়ে বলেছেন, আমরা যুদ্ধ চাই না। অন্ত্র জমা দিয়েছি, ট্রেনিং জমা দেই নাই। অবস্থান কর্মসূচি থেকে আসাদ বলেন, মাননীয় মেয়র মহোদয় আমরা যুদ্ধ চাই না, আমরা আলোচনা চাই, আলোচনার টেবিলে বসেন। আমাদের এই সমস্যা সমাধান করেন। বর্তমানে আমরা কর্মহীন হয়ে গেছি আমাদের বাচ্চাদের আবদার পূরণ করতে পারি না।
তিনি আরো বলেন, আমরা কর্মহীন হয়েছি কিন্তু ব্যর্থ না। অস্ত্র জমা গিয়েছি, ট্রেনিং জমা দেই নাই। আমরা চাই না আমাদের ছেলে মেয়েদের কষ্ট দেখতে। আমি আবারো অনুরোধ করছি অতি শীঘ্রই আমাদের নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসেন, আমাদের পূর্নবাসনের ব্যবস্থা করেন। পূর্নবাসনের পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত আমাদের একটি নির্ধারিত সময় করে দেন, একটা নির্ধারিত টাইম দেন। আমরা সেই টাইম মোতাবেক শৃঙ্খলা সহিত আমরা আমাদের ব্যবসা পরিচালনা করতে চাই। তিনি আরো বলেন, আমার হকার ভাইয়েরা আমার কাছে অনুরোধ করে বলেছে আগামীকাল থেকে ব্যবসা পরিচালনা করতে ফুটপাতে বসা ছাড়া আর কোন বিকল্প ব্যবস্থা নেই।
এর আগে ও ১০ ফেব্রুয়ারি হকার নেতারা নাসিক মেয়র এমপিদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, আমাদের অধিকার আমরাই আদায় করবো। হয় মরবো নয় অধিকার আদায় করবো। অধিকার আদায় করেই ঘরে ফিরবো তার আগে রাজপথ ছাড়বো না। এটা হকারদের যৌক্তিক আন্দোলন, পুনর্বাসন ছাড়া হকার উচ্ছেদ চলবে না। পরবর্তীতে হকাররা একই দাবিতে সোমবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) জেলা প্রশাসকের কাছে স্বারকলিপি জমা দেয়। সেদিন ও সকালে নানাভাবে হকার নেতারা আগের দিনের ন্যায় নাসিক মেয়র এমপিদের হুঁশিয়ারি দিয়ে নানা বক্তব্যে দেন। কিন্তু গতকাল সর্বশেষ জানিয়ে দিয়েছেন সকল বাধা উপেক্ষা করেই ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে হকাররা আবারো ফুটপাত দখল করে বসবেন তা ছাড়া কোন বিকল্প নেই।
সূত্র মতে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ শহওে ফুটপাতের চাঁদাবাজ হিসেবে পরিচিত আসাদুল ইসলাম ওরফে আসাদ। এক সময় হকারি করা আসাদ প্রভাবশালী রাজনীতিকদের সাথে সখ্যতা তৈরি করে বনে গেছে নারায়ণগঞ্জ জেলা হকার সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়রের উপর হামলা, প্রকাশ্যে তরুণ হকারকে ছুরিকাঘাতে হত্যা, পুলিশের উপর হামলা, সড়কে অগ্নিসংযোগের অভিযোগে কয়েকটি মামলা আসামী এই হকার নেতা আসাদ। তবুও শহরের ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করা হকারদের কাছ থেকে প্রকাশ্যে নিয়মিত চাঁদা তোলে তার নেতৃত্বে থাকা চাঁদাবাজরা।
জানা গেছে, ২০১৮ সালে সিটি করপোরেশন ও প্রশাসনের ফুটপাত হকারমুক্ত করার যৌথ উদ্যোগের বিরোধীতা করে আন্দোলন করা নেতাদের অগ্রভাগে ছিল আসাদও। একই বছরের ১৬ জানুয়ারি এই হকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে সিটি মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর উপর হামলার ঘটনা ঘটে। এতে আইভী ও সাংবাদিকসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। ওই ঘটনায় সিটি করপোরেশনের আইন কর্মকর্তা আব্দুস সাত্তার বাদী হয়ে সিটি মেয়রের পক্ষে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে একটি মামলা করেন।
ওই মামলার তদন্ত শেষে ২০২২ সালের ২৩ নভেম্বর আদালতে মামলাটির অভিযোগপত্রে ১২ আসামির মধ্যে জেলা হকার সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আসাদের নামও রয়েছে। এরপর ২০২১ সালের ৯ মার্চ ফুটপাতে বসার দাবিতে বিক্ষোভ করে হকাররা। ওই সময় হকারদের নেতৃত্ব দেয় আসাদ। ওইদিন বিকেলে সড়কে আগুন দিয়ে যানবাহনে ভাঙচুর চালায় হকাররা। বাধা দিলে পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ বাধে। ওই ঘটনায় পুলিশের উপর হামলা, অস্ত্র লুটের চেষ্টা, যানবাহন ভাঙচুর ও সড়কে আগুন দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয় আসাদ।
পরদিন পুলিশের এক মামলায় আসাদসহ ২৫০ জনকে আসামি করা হয়। এই মামলা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয় তাকে। একই বছরের ১৪ অক্টোবর ফুটপাতে দোকান বসানোকে কেন্দ্র করে তর্কের জেরে খুন হন ১৮ বছর বয়সী তরুণ জোবায়ের হোসেন। ওই তরুণও ফুটপাতে হকারি করতো। তাকে পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়। ওই হত্যা মামলারও আসামি এই আসাদ। মামলাটির অভিযোগপত্রেও রয়েছে এই হকার নেতা আসাদের নাম।
শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাতে বসা কয়েকজন হকারের সাথে কথা বলে জানা যায়, নিজেকে হকার নেতা বলে পরিচয় দেওয়া আসাদুল ইসলাম ওরফে আসাদ মূলত চাঁদাবাজি করে বেড়ায়। এই সড়কের ফুটপাতে বসতে হলে আসাদকে দৈনিক চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদার একটি অংশ সখ্যতা বজায় রাখা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে পৌঁছে দেয় আসাদ। হত্যা, সিটি মেয়র ও পুলিশের উপর হামলার মামলার আসামি আসাদ একাধিকবার গ্রেপ্তার হলেও শহরে তার বিচরণে রয়েছে বেপরোয়া ভাব।
এবার ও এই হকার নেতা তার সেই পুরনো সন্ত্রাসী কায়দায় শহরে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা হকার ও তার সাথে থাকা কিছু গুন্ডাবাহিনী নিয়ে শোডাউন দিয়ে যাচ্ছেন। আর নিয়মিত আবারো ২০২১ সালের ৯ মার্চ ফুটপাতে বসার দাবিতে বিক্ষোভ সড়কে আগুন দিয়ে যানবাহনে ভাঙচুর পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ এই ধরনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে এই বিতর্কিত হকার নেতার নানা জ্বালাময়ী বক্তব্যের মাধ্যমে। তিনি বর্তমানে আতঙ্ক ছড়িয়ে যাচ্ছেন শহর জুড়ে।
প্রসঙ্গত, গত ৩ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ শহরে হকার সমস্যা ও যানজট নিরসন ও বিভিন্ন নাগরিক সমস্যা নিয়ে নরায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের আয়োজনে একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে শহরে যানজট নিরসনের জন্য বেশ কয়েকটি উদ্যোগ দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা বলা হয়। এর মধ্যে শহরের ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদের বিষয়টি ছিলো অন্যতম। এ সময় সেখানে উপস্থিত থাকা নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ সদস্য একে.এম শামীম ওসমান, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাংসদ সদস্য সেলিম ওসমান, নাসিক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী।
শহরের সকল সমস্যা সমাধানে পরস্পরকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তারপর থেকেই শহরের অন্যতম সমস্যা হকার সমস্যা সমাধান হতে দেখা গেলে ও আবারো হরকাররা আন্দোলন ও হুঁশিয়ারি দিয়ে পুলিশের সাথে নিয়মিত দৌড়াদৌঁড়ি খেলা খেলে ও অবৈধভাবে আবরো হকাররা ফুটপাত দখল করছে। তা ছাড়া ৪ ফেব্রুয়ারি বেপরোয়া আসাদ তাঁর লোকজনকে নিয়ে ‘অবৈধ আবদার’ জানিয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের দ্বারস্থ হয়।
তারা আবারও ফুটপাতে বসার ব্যবস্থা করে দিতে শামীম ওসমানের কাছে আবদার করে। কিন্তু শামীম ওসমান তাদের জানিয়ে দেন, শহরের সকল ফুটপাতই হকারমুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আর আমি স্থানীয় হকারদের বিষয়টা দেখছি বলে আশ্বাস দিয়ে চলে যান। কিন্তু সেই আশ্বাসে এখনও কাজ না হওয়ায় আসাদ বর্তমানে বাম নেতাদের সঙ্গে নিয়ে শহরে শোডাউন ও নানা হুমকির মাধ্যমে আবারো অবৈধভাবে ফুটপাত দখলের পায়তারা করছে। এস.এ/জেসি