আপন টেক্সটাইলের ক্যামিকেলের বর্জ্যে ২২ গ্রামের মানুষের দুর্ভোগ
রূপগঞ্জ প্রতিনিধি
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০৮:৪২ পিএম, ২৪ মার্চ ২০২৪ রোববার
# ইটিপি ছাড়াই পাউবোর খালে ফেলা হচ্ছে
ক্যামিকেল মিশ্রিত দূষিত পানির দূর্গন্ধে কেউ নাকে মুখে কাপড় গুজে রাখছে কেউবা দূর্গন্ধ থেকে বাচঁতে মুখে মাষ্ক পড়ে চলাচল করছে। ক্যামিকেল মিশ্রিত পানি দেখলে যে কারো মনে হবে যেনো রক্ত ঢেলে রেখেছে। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে নারায়গঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পাড়াগাঁও এলাকার আপন টেক্সটাইলের ডাইংয়ের ক্যামিকেল মিশ্রিত পানি খালে ফেলার কারণে। ক্যামিকেল মিশ্রিত পানি ইটিপি ছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের খালে ফেলার কারণে দূর্ভোগ ও স্বাস্থ্য ঝুকিতে রয়েছে ২২ গ্রামের প্রায় ২ লাখ বাসিন্দা।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, উপজেলা ভুলতা এলাকা থেকে মুড়াপাড়া হয়ে শীতলক্ষ্যা নদী পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি খাল রয়েছে। এ খালটির দুইপাশে মর্তুজাবাদ, ভুলতা, পাচাইখা, ভায়েলা, সোনাব, মাছুমাবাদ, পেরাব, হাটাব, আমলাবো, গোলাকান্দাইল, মুড়াপাড়া, ঋষিপাড়া, ত্রিশকাহনীয়া, আমলাবো, কালি, আওখাবো, বলাইখাসহ প্রায় ২২ গ্রামের মানুষের বসবাস। এ খালের পানি দিয়ে কৃষকরা কৃষি জমিতে পানি দেওয়া ও সেচ কাজ পরিচালনা করতো। এসকল গ্রামের মানুষ বেশিরভাগই কৃষি পেশার নির্ভরশীল ছিল। ভুলতা ইউনিয়নের পাড়াগাঁও এলাকায় আপন টেক্সটাইল নামে কারখানাটি গড়ে উঠে।
এ কারখানা কর্তৃপক্ষ কোন প্রকার ইটিপি ছাড়াই তাদের ডাইংয়ের বিষাক্ত বর্জ্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের খালে ফেলতে শুরু করেন। এ কারখানায় ডাইংয়ের জন্য বিভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। যা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। ক্যামিকেলের বিষাক্ত গ্যাস এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়াসহ নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ক্যামিকেলের পানি ফেলার কারণে কৃষকরা সেচ কাজ করার ফলে তাদের ফলন কমতে থাকে। বিষাক্ত পানি দিয়ে সেচ বন্ধ করে দেওয়া হলে কৃষি জমিতে ফসল ফলা বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে কৃষকরা বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।
এতে করে ওই এলাকার কৃষি জমি দিনদিন কমে যাচ্ছে। কারখানার বিষাক্ত ক্যামিকেলের গন্ধে সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে পড়ছে। ক্যামিকেল মিশ্রিত পানি ছড়িয়ে পুরো এলাকার পরিবেশ বিষাক্ত করে তুলেছে। এতে বিষাক্ত পানির গন্ধে মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। মানুষের পাশাপাশি পাশাপাশি গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি, গাছপালাও মরছে। এমনকি মরে ভেসে উঠেছে এলাকার বেশ কয়েকজনের খামারের মাছ। এ অবস্থায় পুরো এলাকার মানুষ আপন টেক্সটাইলে ক্যামিকেলের পানির আতঙ্কে ভুগছেন। এছাড়া বিষাক্ত পানি শীতলক্ষ্যা নদীতে গিয়ে সৃষ্টি করছে ভয়াবহ দূষণ।
রূপগঞ্জ উপজেলায় আপন টেক্সটাইলের মত আরো বহু ডাইং কারখানার রয়েছে। এসব কারখানার বেশিরভাগই ইটিপি প্ল্যান নেই। অবৈধ ভাবে সরাসরি কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ্য বিভিন্ন খালে প্রকাশ্য দিবালোকে ফেলা হচ্ছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পাড়াগাওয়ের মতো জনবহুল এলাকায় আপন টেক্সটাইল কারখানাটি স্থাপন করা হয়েছে। এ কারখানায় সোডা, পারঅক্সাইড, স্টেবিলাইজার, ডিটারজেন্ট, সিকুস্টারিং এজেন্ট, সোপিং এজেন্ট, রিডাকশন, এজেন্ট, এসিটিক এসিডসহ বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিকারক ক্যামিকেলের ব্যবহার হয়। এসকল ক্যামিকেল জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। স্থানীয়রা বেশকয়েকবার কারখানা কর্তৃপক্ষকে এভাবে অবাধে ক্যামিকেল মিশ্রিত পানি খালে ফেলতে নিষেধ করলেও কোন কাজ হয়নি। বরং কারখানা কর্তৃপক্ষ স্থানীয় বাসিন্দাদের মিথ্যা মামলা ও হামলার ভয় দেখায়।
এদিকে, ভুলতা ইউনিয়ন ৫ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হোসেন মিলটি দেখাশুনা করেন। আবুলের ভয়ে কারখানার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস টুকু পায় না। তবে এলাকাবাসী প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলে আবুল হাসান জানান, প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই তারা কারখানা চালাচ্ছেন।
শিক্ষার্থী সালমা আক্তার জানান, এ খালের পাশ দিয়ে গেলে নাকে মুখে হাত অথবা কাপড় গুজে দিয়ে যেতে হয়। পানির দূর্গন্ধে যেন দম বন্ধ হয়ে যায়। খালের পানির রক্তে মতো লাল হয়ে গেছে। শুনেছি আপন টেক্সটাইল এ খালে বিষাক্ত পানি ফেলছে এ খালের।
কথা হয় কৃষক চান মিয়া, আবেদ আলী, সুলতান মাহমুদ ও আসলাম মিয়ার সঙ্গে। তারা বলেন, বাবাগো কয় বছর আগেও জমিতে ধান লাগাইলে অনেক ফলন পাইতাম। কিন্তু আপন টেক্সটাইলের ডাইয়িং কারখানার ক্যামিকেলের পানির কারণে ফলন আর আগের মতন হয় না। তাই লাইগ্যা চাষাবাদ ছাইড়া দিয়া ভ্যান চালাইয়া সংসার চালাইতাছি।
আরেক কৃষক মোক্তার ভুইয়া জানান, শীতলক্ষ্যার নদীর সাথে এই খালের সরাসরি সংযোগ। আপন টেক্সটাইল কারখানা কর্তৃপক্ষ বিষাক্ত পানি ছাড়ার কারণে খাল নষ্ট হচ্ছে। আর এ খালের পানি নদীতে মিশে শীতলক্ষ্যা নদীকেও দূষিত করছে।
স্থানীয় জেলে শোকলাল বলেন, আগে শীতলক্ষ্যা নদী থেইকা কত্তো রহমের মাছ ধরছি কিন্তু অহন নদীতে কোন মাছ নাই। আপন টেক্সটাইলের মতন কিছু কারখানার ময়লা পানি ফেলানোর কারণে নদীর পানি অহন আলকাতরার মতন হইয়া গেছে। তাই নদীতে এখন আর কোন মাছ পাওন যায় না।
এ ব্যাপারে আপন টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান মিলন গাজীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
আপন টেক্সটাইল দেখাশুনার দায়িত্বে থাকা ভুলতা ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হোসেন বলেন, আমরা ইটিপি ব্যবহার করেই খালে পানি ফেলি। তবে মাঝে মাঝে ইটিপি বন্ধ থাকলে বর্জ্যসহ পানি ফেলা হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হাফিজুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোনটি রিসিভ করেননি।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আইভী ফেরদৌস বলেন, ক্যামিকেল মিশ্রিত পানি পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক এবং এটি মানবদেহের হুমকি সরূপ। ক্যামিকেলে মিশ্রিত পানির সংস্পর্শে গেলে চর্মরোগ, আলসার, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন দূরারোগ্য রোগ মরনব্যাধি হতে পারে। এস.এ/জেসি
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আহসান মাহমুদ রাসেল বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। যেহেতু আপনার মাধ্যমে জেনেছি বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।