শুক্রবার   ১৮ অক্টোবর ২০২৪   কার্তিক ৩ ১৪৩১   ১৪ রবিউস সানি ১৪৪৬

ছয়শো বছরের পুরনো ঐতিহাসিক শাহী মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হুমকিতে

রূপগঞ্জ প্রতিনিধি

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৮:৪১ পিএম, ৯ জুলাই ২০২৪ মঙ্গলবার


কারুকার্য ও নির্মাণশৈলীর বিবেচনায় মোগল স্থাপত্যের  অন্যতম নিদর্শন  প্রায় ৬শত বছরের পুরনো নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া বাজারের ঐতিহাসিক শাহী মসজিদ ঘিরে রহস্যের যেন শেষ নেই। অত্যাচারী জমিদারদের ধর্মীয় গোড়ামির বিরোধে মাটি চাপা দেয়া মসজিদ উদ্ধারের পর তৎকালীন দিল্লির আদালতের দেয়া রায়ে ফিরে পান স্থানীয় মুসলিমরা।

 

 

তবে সে দ্বন্দ্বে আজো লোমহর্ষকর স্মৃতিতে মৌলভী শমসেরের হত্যাকান্ড লোকমুখে। এদিকে কালের বিবর্তে মসজিদটির দেয়াল, ছাঁদে ও গম্বুজে ফাটল আর সামনের জমি বেদখলের ঘটনায় হুমকীর মুখে পড়েছে মসজিদটি।

 


সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের  মুড়াপাড়ার শাহি মসজিদ ঘিরে রয়েছে বিগত প্রায় ৬ শত বছরের ইতিহাস।  মোঘল শাসক বরবক শাহের নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয় শাহি মসজিদ। বর্গাকার মসজিদটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৪০ ফুট করে। চারপাশের দেয়াল ৬ ফুট ৮ ইঞ্চি চওড়া। পূর্বপাশে রয়েছে খিলান আকৃতির প্রবেশপথ। এর ইটের দৈর্ঘ্য ১২ ইঞ্চি, প্রস্থ ১০ ইঞ্চি এবং চওড়া ২ ইঞ্চি।

 


শাহি মসজিদের পাশে রয়েছে ৫টি কবর। যাদের মধ্যে চিরনিদ্রায় শায়িত এ মসজিদের জমিদাতা  পরগনার মালিক আছিয়া খাতুনও। আরেকজন মৌলভী শমসের মিয়া। মসজিদের বর্তমান মুয়াজ্জিন মৌলভী ইব্রাহিমের দেয়া তথ্যে জানা যায়, মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ির জমিদারদের লোকজন এক সময় স্থানীয় মুসলমানদের বিতাড়িত করতে নানা অত্যাচার করতন।

 

 

এক সময় মুড়াপাড়া বাজারের এ শাহী মসজিদটি তৎকালীন ১ গম্বুজ বিশিষ্ট অংশ হাতি দিয়ে মাটি রেখে পুরো মসজিদ মাটি চাপা দিয়ে রাখে। এরপর মাঝখানে প্রায় ৮০ বছর এ মসজিদ স্থানীয়রা ব্যবহার করতে পারেননি। তবে গত ২শ  বছর পূর্বে স্থানীয় মুসুল্লিরা মিলিত হয়ে মাটি চাপা সরিয়ে মসজিদ উন্মুক্ত করেন।

 

 

এরপর নাওড়া গ্রামের মৌলভী সমশেরসহ স্থানীয় মুসল্লিরা নামাজ আদায় করতে আজান দিলে জমিদারের লোকজন হাতি নিয়ে হামলা চালায়। এ সময় গ্রামের মুসলমান আর হিন্দু জমিদারের লোকজনের সাথে সংঘর্ষকালে মৌলভী শমসের মিয়াকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

 

 

পরে এ ঘটনায় প্রথমে কলকাতার আদালত পরে দিল্লির কেন্দ্রীয় আদালতে মামলা হলে ওই মামলার রায়ে শাহী মসজিদটি পুনরায় মুসলমানরা স্বাধীনভাবে নামাজ আদায় করেন। তবে আছিয়া খাতুনের স্মৃতি কিংবা মুসলিম বীর মৌলভী শমসের মিয়ার স্মৃতি রক্ষা চান এলাকাবাসী।  যদিও মসজিদের জমির বিরোধ কাটেনি এখনো।

 

 

ইব্রাহিম আরও জানান, মসজিদের ছাঁদে ফাটল,মূল গম্বুজেও ফাটল দেখা দিয়েছে। পুরনো ভবনের সাথে নতুন ভবনের স্থাপত্য মিলানো যায় না। ফলে পুরনো এই স্মৃতি রক্ষার চেষ্টাও ব্যর্থ হচ্ছে।  তবে জমির বিরোধ এখনো বিদ্যমান। মসজিদের নামে থাকা জমি সব মসজিদের দখলে নেই। দখলদারা বাড়ি ঘর করে,পাকা স্থাপনা করে স্থায়ীভাবে দখলে নিয়ে নিচ্ছে।

 


 বর্তমানে  মসজিদের রয়েছে খাঁজকাটা ৩টি গম্বুজ। ছাঁদে রয়েছে মোটা ৬ টি এবং চিকন ৬ টি মিনার। তবে মুল মসজিদটির সামনের অংশে মুসুল্লিদের জায়গা বাড়ানোর জন্য করা হয়েছে অস্থায়ী বারান্দা সাদৃশ্য টিনের চালা।

 

 

যাতে অনেকটাই ঢেকে গেছে মসজিদের সৌন্দর্য। এমনি প্রধান ফটক অক্ষত থাকলেও তা ব্যবহার হচ্ছে না। মাটি চাপা থেকে উদ্ধার করায়  স্থানীয়দের কাছে এ মসজিদ গায়েবী মসজিদ হিসেবেও পরিচিত। তবে তাদের দাবী, মসজিদটি রক্ষায় সরকারী, বেসরকারি উদ্যোগ।

 


স্থানীয় বাসিন্দা ও মুসুল্লিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ির হিন্দু জমিদারদের পাইক পেয়াদা ও স্থানীয় হিন্দুদের অত্যাচারে স্থানীয় মুসুল্লিরা এ মুড়াপাড়া অঞ্চলে ছাতা মাথা, পায়ে জুতা পড়ে আসতে পারতেন না। নদী পার হয়ে কেউ এ এলাকার তাদে প্রয়োজনে এলেও মাথা নত করে যাতায়াত করতে হতো। ফলে এ মসজিদের নিয়ন্ত্রণ ছিলো না।

 

 

তবে এক সময় মুসলমানদের আন্দোলনের মুখে এ মসজিদ উদ্ধার হয়। সে সময় মুয়াজ্জিন শমসের আন্দোলনে যোগ দেয়ায় আছরের নামাজের আজানের সময় তাকে গুলি করে হত্যা করে হিন্দুদের মাঝে হামলাকারীরা৷ এ ঘটনায় কলকাতা আদালতে মামলা হয়।

 

 

পরে তা দিল্লিতে বিচারাধীন হলে শহীদ শমসেরের মাকে তৎকালীন ম্যাজিস্টেট ছেলে হত্যার বিচার কিংবা মসজিদ মুসলিমদের কাছে ছেড়ে দেয়ার যে কোন একটি শর্ত মানার কথা বলেন। কিন্তু শমসেরের মা মসজিদ মুসুল্লিদের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার শর্তে মামলা তুলে নেয়। ফলে শমসেরের অমর স্মৃতি রক্ষা স্থানীয়রা একটি পাঠাগার গড়ার উদ্যোগ নেয়৷ মসজিদের পাশে পাঠাগার গড়তে একটি জমি নির্বাচন হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।  

 



এদিকে  ইতিহাস বই থেকে জানা যায়, ১৪৬৫ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়ের ইলিয়াস শাহি বংশের উত্তরাধিকার নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের ছেলে রুকনউদ্দিন বরবক শাহ তৎকালীন আছিয়া খাতুনের পরগনা শীতলক্ষ্যা তীরের মুড়াপাড়া এলাকায় আসেন। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন জৌনপুরের শাসনকর্তা মাহমুদ শর্কী, মুসলমান সাহিত্যিক আমীর জয়েনউদ্দীন, আমীর শিহাবউদ্দীন কিরমানী, মনসুর সিরাজী ও দেহরক্ষী বাসুদেব বসু।  মোগল রীতি অনুযায়ী বরবক শাহ আছিয়া খাতুনের পরগনায় মসজিদ নির্মাণ করেন।

 


নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর বরবক শাহের নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয় শাহি মসজিদ। আছিয়া খাতুন তার পরগনা থেকে ১৮ বিঘা জমি এ মসজিদের নামে দিয়ে দেন। তাই আছিয়া খাতুনের মসজিদ নামেও জানেন স্থানীয়রা।   এন. হুসেইন রনী  /জেসি