শুক্রবার   ১৮ অক্টোবর ২০২৪   কার্তিক ৩ ১৪৩১   ১৪ রবিউস সানি ১৪৪৬

কোটা আন্দোলনকারীদের নিয়ে পুলিশ বেকায়দায়?

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ১১:৫২ পিএম, ১২ জুলাই ২০২৪ শুক্রবার

 

 

এ সপ্তাহে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে চার দিনই ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি দিয়ে রাজধানীতে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। প্রধান সব সড়কে তারা যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় রাজধানীবাসীকে নানারকম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। কোটা নিয়ে আদালতের স্থিতাবস্থার আদেশের পর আন্দোলনকারীদের সড়কে অবরোধে বাধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশ। কিন্তু তারা সফল হতে পারেনি খুব একটা। 

 

আন্দোলনের মূল পয়েন্ট শাহবাগে শত শত পুলিশ মোতায়েন করে, জলকামান এনে, ব্যারিকেড দিয়েও ঠেকানো যায়নি অবরোধ। ব্যারিকেড ভেঙে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ দখল করার সময় রীতিমতো অসহায় হয়ে পড়েন পুলিশ সদস্যরা। তারা সড়ক দখলে বাধাও দিতে পারেননি, আবার জনদুর্ভোগ কমাতে গাড়ি চলাচলও স্বাভাবিক করতে পারেননি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, আন্দোলনকারীদের নিয়ে পুলিশ বেকায়দায় পড়েছে কিনা।

 

গত রবি, সোম, বুধ ও গতকাল বৃহস্পতিবার ব্লকেড কর্মসূচি পালন করলেন কোটা আন্দোলনকারীরা। রবিবার বিকাল ৩টা থেকে, সোমবার বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে ৫-৬ ঘণ্টা করে এবং বুধবার সকাল-সন্ধ্যা ব্লকেড পালন করা হয়। বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত শাহবাগ অবরোধ করে রাখেন আন্দোলনকারীরা।

 

সরেজমিন দেখা যায়, আজ বিকাল ৪টার দিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে থেকে মিছিল শুরু করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের সামনে ঘুরে টিএসসি হয়ে মিছিল এগোতে থাকে শাহবাগের দিকে।

 

এর আগে বৃহস্পতিবার দুপুর থেকেই কয়েকশ’ পুলিশ সদস্য জলকামান ও এপিসি কার নিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। একপর্যায়ে শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের দিকের সড়কে ব্যারিকেড দেয় পুলিশ। আন্দোলনকারীদের ক্ষুদ্র একটি অংশ দৌড়ে গিয়ে সেই ব্যারিকেড নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করে। এসময় পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি ও ধাক্কাধাক্কি হয়। তবে পুলিশ কোনও মারমুখী আচরণ করেনি।

 

সংশ্লিষ্টরা জানান, সকালে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের যেকোনও মূল্যে সড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি সংখ্যক পুলিশও মোতায়েন করা হয়েছিল।

 

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার খন্দকার মহিদ উদ্দিন সকালে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, শিক্ষার্থীদের সড়কে বসতে দেওয়া হবে না। বসলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু বৃহস্পতিবার দুপুরের পর সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে পুলিশকে ধৈর্য ধরার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

 

গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পুলিশ কোনোভাবেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যেন সংঘর্ষে না জড়ায় সেজন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে যেতে পারে। এছাড়া কোটা নিয়ে আন্দোলন যেন সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত না হয় সেজন্য পুলিশকে শেষ মুহূর্তেও ধৈর্য ধারণ করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বলা হয়।

 

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) খন্দকার মহিদ উদ্দিন বৃহস্পতিবার বিকালে সাংবাদিকদের বলেন, কোটা নিয়ে আদালতের নির্দেশনার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের অবকাশ ছিল না। তাই তাদের রাস্তায় না নামতে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তারা নেমে পড়লেন। তারপরও পুলিশ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। আশা করি আজকেই এই আন্দোলন শেষ হবে। পুলিশ চায় না শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কিছু হোক। তাদেরও বোঝা উচিত। তাদেরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।

 

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা উচিত। পুলিশ কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ালে এই আন্দোলন আরও ছড়িয়ে যাবে। এজন্য পুলিশ কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েও সেই অবস্থান থেকে ফিরে এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এটি সমাধানের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

 

তবে বৃহস্পতিবারের কর্মসূচি পালনকালে কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। কুমিল্লার কোটবাড়িতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধে যাওয়ার পথে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাধা দেয় পুলিশ। একপর্যায়ে পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল ছোড়ে। বিপরীতে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল মেরেছেন শিক্ষার্থীরা। সংঘর্ষে দুই সাংবাদিকসহ আহত হয়েছেন অনেকে।

 

চট্টগ্রাম নগরীর টাইগারপাস মোড় থেকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে ষোলশহর ২ নম্বর গেট এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ লাঠিপেটা করে। পরে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা হাতাহাতিতে জড়ায়। এরপর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে সড়কের ওপর শুয়ে-বসে অবস্থান নেন। তাদের সড়ক অবরোধের কারণে নগরীর ষোলশহর, মুরাদপুর, জিইসিসহ নগরজুড়ে ব্যাপক যানজট সৃষ্টি হয়।


আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা জানান, বৃহস্পতিবার উচ্চ আদালত থেকে কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা দেওয়া রায়ের মূল অংশ প্রকাশ হয়েছে। সেই রায়ে বলা হয়েছে, সরকার চাইলে কোটা পদ্ধতি পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে পারবে। এতদিন সরকার আদালতের রায় বলে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও এখন তা সরকারের ঘাড়ে এসেই পড়েছে।

সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কোটা পদ্ধতি সংস্কার করার জন্য বলা হয়েছে। দুই-একদিনের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে নতুন করে একটি পরিপত্র জারি করা হতে পারে। আগামী দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি। সামনের সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে কোটা আন্দোলনকারীরা যাতে সড়কে না নামতে পারে সেজন্য আগেই এর সমাধান করা হবে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, পুলিশকে ‘ভুয়া ভুয়া’ বলেও স্লোগান দেওয়া এবং ধাক্কাধাক্কি করার পরও পুলিশ ধৈর্য ধরেছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সড়ক স্বাভাবিক রাখতে বললে ১০ মিনিটেই তা করা যেত। কিন্তু পরবর্তীতে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেওয়ার শঙ্কা ছিল। এজন্যই পুলিশ কোনও অ্যাকশনে যায়নি।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, সরকার যেহেতু কোটার বিষয়টি যৌক্তিকভাবে সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে, এ কারণেই পুলিশ অ্যাকশনে যায়নি। ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়েছে। অ্যাকশনে গেলে পুরো দায় এসে পড়তো পুলিশের ওপর। এমনিতেই সাধারণ মানুষ পুলিশের ওপর ক্ষুব্ধ। পুলিশের দুর্নাম হয় এমন যেকোনও বিষয়ে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে কোনোভাবেই আইন ভঙ্গকারীদের ছাড় দেওয়া হবে না।