শুক্রবার   ১৮ অক্টোবর ২০২৪   কার্তিক ৩ ১৪৩১   ১৪ রবিউস সানি ১৪৪৬

ভয় দেখিয়ে বিপুল অর্থবাণিজ্য

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৪:১০ পিএম, ১৬ অক্টোবর ২০২৪ বুধবার

#  সোনারগাঁয়ে মান্নান ও ছেলে সজিবের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়
 

সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপির সভাপতি আজাহারুল ইসলাম মান্নানের বিরুদ্ধে এলাকায় দুঃশাসনের স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলার অভিযোগ উঠেছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত ও হতাহতের ঘটনায় থানায় দায়েরকৃত মামলায় আসামীর তালিকায় অন্তরর্ভূক্ত করার ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন তিনি। তাছাড়া মান্নান, তার ছেলে জেলা যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহবায়ক খায়রুল ইসলাম সজিব ও তাদের লোকজন উপজেলার বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৩৮টি শিল্প কারখানায় দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের হুমকি ধামকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে ঝুট, স্ক্রাবসহ বিভিন্ন ব্যবসা নিয়ন্ত্রনে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। বাপ ছেলের দুঃশাসনের খবরে নিজ দলের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে উপজেলার সর্বত্র আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠেছে। লোক মূখে শোনা যায় ক্ষমতায় না গিয়েই বাপ ছেলে মিলে যে লুটতরাজ শুরু করেছেন ক্ষমতায় গেলে পরে সাধারন মানুষের অবস্থায় আরো ভয়ানক হবে। সোনারগাঁ উপজেলার সুশিল সমাজের লোকজন ও দলীয় কর্মীসমর্থকদের দাবী এখনই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা মান্নান ও তার ছেলের এহেন কর্মকান্ডের লাগাম টেনে না ধরলে আগামী সংসদ নির্বাচনে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। মান্নান ও তার ছেলের বির্তকিত বিভিন্ন কর্মকান্ডের বিষয়ে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে মান্নান তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের সত্যতা অস্বীকার করে তিনি বলেন একটি কুচক্র মহল তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে তিনি দাবী করেন।


স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মুখে গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগের পর স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও এর সহযোগি সংগঠনের নেতাকর্মীরা গাডাকা দেয়। এ সুযোগে আজহারুল ইসলাম মান্নান, ছেলে খায়রুল ইসলাম সজিব ও তার সহযোগিরা বেপেরোয়া হয়ে উঠে। বিভিন্ন লোকজনের বাড়ি-ঘরে হামলা, পিরোজপুর ইউপির সাবেক মহিলা সদস্য মমতাজ বেগমকে তার বাড়ি থেকে জোর পূর্বক বের করে দেওয়া, সোনারগাঁ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আশরাফুজ্জামান অপু ও সহকারি অধ্যাপক খন্দকার দিল আফরোজকে জোরপূর্বক পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর নেওয়াসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। এমনকি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় থানায় দায়েরকৃত মামলায় আসামি করার হুমকি দিয়ে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন মান্নান ও তার লোকজন। 

 

তাছাড়া মামলা করার পর বাদীকে দিয়ে আদালতের মাধ্যমে আসামীর তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার কথা বলে আরেক দফা অর্থ হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। আরো অভিযোগ রয়েছে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় সোনারগাঁ থানায় যে ৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে তা স¤পূর্ন উদ্দেশ্য প্রনোদিত। উল্লেখিত মামলা গুলোর প্রকৃত ঘটনাস্থল ছিল নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জের মাদানীনগর ও রাজধানী ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকা। অথচ হতাহতের পবিবারের লোকাজনকে টাকা দিয়ে ঘটনাস্থল সোনারগাঁ দেখিয়ে মামলা দায়ের করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। উল্লেখিত মামলার প্রত্যেকটিতে শেখ হাসিনাকে প্রধান করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সাধারণ ব্যবসায়ী ও দিনমজুর লোকজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ৪ হাজার সাধারণ মানুষকে আসামী করা হয়েছে। এতে মান্নান ও তার লোকজন ক্ষান্ত না হয়ে লাঠি-সোঠা নিয়ে মিছিলের মাধ্যমে প্রথমে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে। একই সাথে মামলায় আসামী করে তাদের ঘরবাড়ি দখল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল, শিল্প কারখানার ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রনে নেয় মান্নান পুত্র খাইরুল ইসলাম সজীব। অন্যদিকে মান্নানের নির্দেশে উপজেলার পিরোজপুর এলাকায় নীরহ মানুষের জমি দখল করে নিচ্ছে মান্নানপন্থী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুর রহমান কসাই ও সেলিম হোসেন দীপুসহ তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী। তাছাড়া সম্প্রতি চাঁদাবাজীর অভিযোগে যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন মোগরাপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ স¤পাদক আতাউর রহমান। এদিকে থানায় দায়েরকৃত মামলার বাদিরা জানেন না তাদের মামলায় কাদেরকে আসামি করা হয়েছে। এরকম ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে বাদীর সরল স্বীকারোক্তি ভাইরাল হতে দেখা গেছে। 

 

এনিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে আজহারুল ইসলাম মান্নান নিজের দুঃসাশনের রাজত্ব ধরে রাখতে নিজ দলের কর্মী সমর্থকদেরও কোনো কোনো মামলায় আসামী করেছেন। এনিয়ে নিজ দলের নেতাকর্মীদের অনেকই তার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করতেও দেখা গেছে। তাছাড়া বিপুল পরিমান অর্থবানিজ্যের মাধ্যমে আদালত কর্তৃক বাদিকে মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সজিব পদত্যাগ পত্র রিসিভ করেছে, ভিডিও রয়েছে এরই মধ্যে মান্নান ও তার ছেলে সজিবের বিতর্কিত কর্মকান্ডে সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বিএনপির সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রেজাউল করিম তার সমর্থিত নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে এলাকায় বিএনপির সমর্থন আদায়ে কাজ করতে দেখা গেছে।


মান্নান সম্পর্কে আরো জানা যায়, আজহারুল ইসলাম মান্নান এক সময় অধ্যাপক রেজাউল করিমের রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। পেশায় ছিলেন সাধারণ দিনমজুর। পরবর্তীতে একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের দালালি করে রাতারাতি কোটিপতি বনে যান মান্নান। এর পর আর তাকে পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। এদিকে গত ৭ আগস্ট মান্নানের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী পিরোজপুর ইউপির প্রতাপেরচর এলাকায় সাবেক মহিলা সদস্য মমতাজ বেগম ও তার পরিবারের লোকজনকে জোরপূর্বক বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে দখলে নেয়। এ ব্যাপারে মমতাজ বেগম উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করে কোনো প্রতিকার না পেয়ে সেনাবাহিনীর ক্যা¤েপ অভিযোগ করেন। তাছাড়া মান্নান পুত্র খাইরুল ইসলাম সজীবের বিরুদ্ধে নৌ চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রনের অভিযোগ রয়েছে। মেঘনা নদীর উপজেলার নুনেরটেক থেকে চর কিশোরগঞ্জ পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে তার লোকজন নিয়মিত চাঁদা উত্তোলন করে আসছে বলে জানা গেছে। বিএনপি নেতা মান্নান, ছেলে খাইরুল ইসলাম সজিব ও তাদের বাহিনী এলাকার জনসাধারণের কাছে যেনো এক মূর্তিমান আতঙ্ক। তার বাহিনী প্রতাপেরচর গ্রামের মিন্টু, ঝাউচর গ্রামের আল আমিনের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের ভয়ে প্রতাপেরচর, ঝাউচর ও আষাড়িয়াঢ়চর গ্রামের ব্যবসায়ীরা এখন এলাকা ছাড়া। শুধু তাই নয় মেঘনা গ্রুপের ৩টি ইকোনমিক জোনসহ ৩৮টি শিল্প প্রতিষ্ঠান দখলে নিয়েছে বিএনপি নেতা আজহারুল ইসলাম মান্নান, ছেলে সজিব ও ভাই হান্নানসহ তাদের সহযোগিরা। গত ৫ আগষ্টের পর মান্নানের নেতৃত্বে শতাধিক লোকজন নিয়ে ফ্রেশ সিমেন্ট, ফ্রেশ ফিড, ফ্রেশ ডালডা, ফ্রেশ ফাইবার, ফ্রেশ চা, ফ্রেশ সুগার, ফ্রেশ বলপেন, মেঘনা সিরামিকস, মেঘনা পাল্প পেপার, মেঘনাঘাট ৪৫০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্ট, মেঘনাঘাট সামিট ৩০৫/৩৩৭ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্ট-১, মেঘনাঘাট সামিট ৭৫০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্ট-২, ওরিয়ন পাওয়ার প্লান্ট, মেঘনাঘাট স্যামসাং ৭১৮ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্ট, হাজি সেলিম ডকইয়ার্ড, বাংলা ডকইয়ার্ড, আল মোস্তফা গ্রুপ, চায়না ব্যাটারি ও আনন্দ শীপইয়ার্ডে গিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান তার দখলে নেয়।  এছাড়া মান্নানের নির্দেশে উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের প্রথমে হত্যা মামলার আসামি করা হয়। পরে তাদের ইউপি চেয়ারম্যানদের অনুপস্থিত থাকার সুযোগে বিপুল পরিমান অর্থের বিনিময়ে মান্নানের পছন্দের জনপ্রতিনিধিদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে সুপারিশ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ী ও বিএনপি ঘরোনার একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা সোনারগাঁ উপজেলার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মান্নান ও তার ছেলে সজিব এবং তাদের সহযোগিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে জোর দাবী জানান।


বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ড. ইকবাল হোসাইন ভূঁইয়া বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ গুলোর চেয়ারম্যানদের অনুপস্থিতিতে সৎ যোগ্য ইউপি সদস্যদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছি। কিন্তু বিএনপির আজহারুল ইসলাম মান্নান অর্থের বিনিময়ে আওয়ামীলীগের সমর্থিত ইউপি সদস্যদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত করেছেন। এটা নিন্দনীয় ও অত্যন্ত দুঃখজনক।


এ ব্যাপারে সোনারগাঁ উপজেলা বিএনপি সভাপতি আজহারুল ইসলাম মান্নানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অস্বীকার করেন। তার দাবী, একটি পক্ষ তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে।