বৃহস্পতিবার   ০৭ নভেম্বর ২০২৪   কার্তিক ২৩ ১৪৩১   ০৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

চাঁদাবাজ কারা নানা প্রশ্নের ঘুরপাক

যুগের চিন্তা রিপোর্ট :

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৮:০৫ পিএম, ৩১ অক্টোবর ২০২৪ বৃহস্পতিবার

চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রিজের চাঁদার টাকা ফেরত আনার

 

গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকার প্রধান শেখ হাসিনা পালিয়ে যায়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য অনুযায়ী দুর্বত্তায়নে ছেয়ে থাকা দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে সংস্কার শুরু হয়। প্রথমেই ব্যবসায়ীদের সংগঠন নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কর্মার্সে সংস্কার পর্ব শুরু হয়। ওসমানদের আজ্ঞাবহ খালেদ হায়দার খান কাজলকে সরিয়ে কোঅপ্ট সভাপতি হিসেবে স্বনামধন্য মডেল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিটিজেন ব্যাংক পিএলসি’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মাসুদুজ্জামানকে নির্বাচিত করা হয়।

 

দায়িত্ব নিয়েই ৭ সেপ্টেম্বর মাসুদুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন চেম্বার অব কমার্সের কাছে চাঁদা দাবি করা হয়েছে। এরমধ্যে কিছু টাকা দিয়েছেন বাকি টাকা মেটানোর কথা রয়েছে। সেই সংবাদ সম্মেলনে তিনি দাবি করেন তিনি চাঁদাবাজদের দাবি করা টাকা আর দেবেন না, উল্টো লাল কার্ড দেখিয়ে ফেরত আনবেন। এর কিছুদিন পর ১ অক্টোবর বিকেএমইএ ভবনে সাংবাদিক সম্মেলন করে মাসুদুজ্জামান জানান, চাঁদার টাকা তিনি ফেরত এনেছেন। কিন্তু চাঁদাবাজদের নাম বলতে অপরাগতরা করেন। 

 

দীর্ঘদিন পরেও এখনও না.গঞ্জবাসীর মনে প্রশ্ন রয়েছে চাঁদা কাদের দিল, আবার ফেরত নিয়ে আসলো কিভাবে? প্রশাসনও জানতে পারলো না চাঁদাবাজদের নাম? নাকি পুরো ঘটনাটাই স্ট্যান্টবাজি? ব্যবসায়ীদের বোকা বানানো হলো না তো। স্ট্যান্টবাজি না হলে নাম বলতে সমস্যাটাই কি ছিল? চাঁদাবাজরাও এতে উৎসাহিত হলো কিনা? এসব নানা প্রশ্ন এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে নারায়ণগঞ্জবাসীর মনে। কেন চাঁদাবাজদের আড়াল করা হলো? এখানে আসলে কোন স্বার্থ কাজ করেছে? ভালো চাঁদা-খারাপ চাঁদার ঘটনাটাই বা কি? চেম্বারের কমিটিতে ওসমানদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিরাও আগের মতো এতো তৎপর কিভাবে? এই ঘটনায় তাদের কোন কূটকৌশল নেই তো? 

 

গত ৭ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সে এক প্রেস কনফারেন্সের নবনির্বাচিত সভাপতি মাসুদুজ্জামান সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, ‘একটি কঠিন সময়ে আমাকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য যারা আমাকে যোগ্য মনে করেছেন তাদের প্রতি ধন্যবাদ জানাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রায় ৪ হাজার লোক ক্ষতিগ্রস্ত এবং প্রায় ২০ হাজার ছাত্র আহত হয়েছেন। এই আন্দোলনে নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। 

 

মাসুদুজ্জামান বলেন, ব্যবসায়িরা ৫ আগস্টের পর থেকে ভীতিতে রয়েছেন। চাঁদা, দখল এসব চলছে। ব্যবসায়ীরা কখনোই রাজনীতির সাথে জড়িত না, আমরা কখনো কখনো পরিস্থিতির শিকার। যে কোন পরিবর্তন হলে ব্যবসায়ীদের উপর দিয়েই ঝড়ঝাপ্টা যায়। গত কয়েকদিন ধরে কিভাবে চাঁদাবাজি চলছে, হুমকি ধামকি দিয়ে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, চেম্বার অব কমার্সে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছে, ৩ লাখ মিটিয়েছি, ৭ লাখ টাকার জন্য চাপ আছে। বিকেএমইএ উনারাও ৫ লাখ টাকা চাঁদা দিয়েছে বাধ্য হয়ে। আমি বলতে চাই, চাঁদা এক পয়সাও দিবো না, বরং যেই চাঁদা দিয়েছি সেটি ফেরত চাই। নতুবা শহীদ মিনারে গিয়ে লাল কার্ড দেখাবো, নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে বের করে দিবো যত শক্তিশালী নেতাই হোক। আমরা ঝামেলামুক্ত ব্যবসা করতে চাই। সমস্ত ব্যবসায়ীদের বলবো, যার যার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লাঠি রাখেন, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করবো।’
 

 

এরপর ১ অক্টোবর বিকেএমইএ এর প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাসুদুজ্জামান ও বিকেএমইএ এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম উপস্থিত থেকে চাঁদার টাকা ফেরত আনার বিষয়টি জানান। তারা বলেন, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জের দুটি ব্যবসায়ী সংগঠনের কর্মকর্তাদের ভয় ভীতি দেখিয়ে নেয়া ৮ লক্ষ টাকা চাঁদাবাজরা  ফেরত দিয়েছে।  নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে তিন লক্ষ টাকা এবং রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিকেএমইএ এর কাছ থেকে ৫ লক্ষ টাকাসহ মোট ৮ লক্ষ টাকা চাঁদা নিয়েছিলো রাজনৈতিক ছত্র ছায়ায় থাকা দুর্বৃত্তরা। নারায়ণগঞ্জ চেম্বারের শীর্ষপদে বর্তমানে নতুন নেতা এসেছেন। 

 

 

চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাষ্ট্রিজের সভাপতি মাসুদুজ্জামান বলেন, ‘৫ আগস্টের পর উদ্ভুত পরিস্থিতিতে চাঁদা নেওয়া হয়েছিলো। তখন ব্যবসায়ীরাও আতংকগ্রস্থ হয়ে তাৎক্ষণিক সে চাঁদা প্রদান করে। পরে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ার পর বিষয়টি গণমাধ্যমের নজরে আনা হয়। এছাড়া ব্যবসায়ীদের ঐক্যের কারণে চাঁদাবাজরা সে টাকা ফেরত দিয়েছে। তিনি বলেন, এটি চাঁদাবাজদের জন্য একটি ম্যাসেজ। নারায়ণগঞ্জে কোনো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কেউ চাঁদাবাজি করলে তাকে ছাড় দেয়া হবেনা। তার বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

 


 
তবে চাঁদাবাজদের নাম জানাতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করেন ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, চাঁদাবাজরা চাঁদার টাকা ফেরত দিয়েছে এটাই যথেষ্ট। এর মাধ্যমে আর কেউ নতুন করে ব্যবসায়ী বা ব্যবসায়ী সংগঠনের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করার  সাহস পাবে না। কারণ চাঁদার টাকা ফেরত দেয়াটা সামান্য কোন বিষয় নয়।

 

বিকেএমইএ এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিকেএমইএ’র কাছ থেকে আসলে চাঁদা নেয়নি। এটি অন্য একটি ব্যাবসায়ী সংগঠনের কাছ থেকে আমার মাধ্যমে নিয়েছিলো। নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীরা এক থাকাতে এখানে বড় ধরণের কোন সমস্যা হয়নি। আগামীতেও হবে না আশা করছি। 

 

এই দুটি সংবাদ সম্মেলনের পর থেকেই ব্যবসায়ীসহ নারায়ণগঞ্জবাসী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাষ্ট্রিজের সভাপতির কাছে চাঁদাবাজদের নাম প্রকাশের দাবি জানান নানা সময়। চেম্বার অব কমার্সের এজিএমেও অনেকে এই ঘটনাকে স্ট্যান্টবাজি বলে কানাঘুষা করেছেন। এমনকি অনেকে নানা সমালোচনাও করেছেন। তাছাড়া নারায়ণগঞ্জের নানা মহলেও চাঁদাবাজদের নাম প্রকাশের দাবি জানানো হচ্ছে। এনিয়ে প্রচুর কানাঘুষা চললেও ব্যবসায়ীক সংগঠনের নেতারা মুখে কুলুপ এটেছেন। 

 

গত ২৬ অক্টোবর এজিএমে  নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মো. মাসুদুজ্জামান তো কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বলেছেন, ‘এ সংগঠন আপনাদের, আমার, সবার। আমি যে প্রক্রিয়ায় আসি না কেন, বলেছিলাম চার মাসের জন্য দায়িত্ব নিয়েছি। ইচ্ছে ছিল, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিবো। কিন্তু এই চার মাস সহ্য হলো না! এত কী করে ফেললাম এই চার মাসে? এত আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে; আমি আলোচনাকে সাধুবাদ জানাই।’ গঠনমূলক সমালোচনা করার আহ্বান জানিয়ে চেম্বারের সভাপতি বলেন, ‘যাই করেন গঠনমূলকভাবে করেন। ব্যক্তিগত আক্রমণ কইরেন না। আমি আমার সাদা শার্টে কালি মাখতে এখানে আসি নাই। আপনাদের কাছে আমি ওয়াদাবদ্ধ। আমি সংগঠনে থাকা অবস্থায় কোনো ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি সহ্য করবো না।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের পালা বদলের পর যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তখন অনেকের অনুরোধে আমি চেম্বারের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হই। এটি আপনাদের সংগঠন। এর দায় সকল সদস্যের। আমরা চাই ভবিষ্যতে আপনারা আপনাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে আপনাদের সদস্য নির্বাচন করবেন।’

 

নারায়ণগঞ্জবাসী দাবি করেছেন, এখন সত্য প্রকাশে কোন বাধা থাকার কথা নয়, অবিলম্বে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে এই বিষয়টি খোলাসা করবেন ব্যবসায়িক নেতারা।