দীপাবলী ও কালীপূজা
রণজিৎ মোদক
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ১১:১০ পিএম, ৩১ অক্টোবর ২০২৪ বৃহস্পতিবার
সনাতন হিন্দু ধর্মীয় দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব হচ্ছে, শ্যামা পূজা- দীপান্বিতা বা দীপাবলী। কেউ কেউ এই উৎসবকে দেওয়ালী উৎসবও বলে থাকেন। ত্রেতা যুগে চৌদ্দ বছর বনবাসে থাকার পর নবমীতে শ্রীরাম রাবণ বধের বিজয় আনন্দ নিয়ে দশমীতে রাজ প্রাসাদ অযোধ্যায় ফিরে আসেন।
রামের আগমন বার্তা শুনে সমস্ত প্রজাকূল তাদের গৃহে প্রদীপ জ্বালিয়ে আনন্দ উৎসব পালন করেন। সেই উৎসবকে দীপাবলী উৎসব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার বৈষ্ণব শাস্ত্রীয় মতে কার্তিক মাস তথা দামোদার মাস। এ মাসেই স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মাতৃস্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ হন। ভক্তির রশিতে ভগবান ভক্তের হাতে বন্দি।
এই দামোদার মাস ভগবানের প্রিয় মাস। এ মাসে ভগবানের উদ্দেশ্যে যা কিছু করা হয়, তাঁর অক্ষয় ফল প্রদান করেন ভগবান। দ্বাপর যুগে বৃন্দাবনবাসী গোপ ললনাবৃন্দ অন্ন কুটের উৎসব করেন এই দামোদার মাসে (কার্তিক)। শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর ভক্তবৃন্দ এ মাসে রাখের উৎসব ব্রত পালন করেন।
শাস্ত্রীয় মতে কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে দীপান্বিতা পার্বন শ্রাদ্ধ ও শ্যামা পূজা করা হয়। প্রয়াত পিতৃপুরুষদের স্মরণে উল্কাদানের মাধ্যমে আশীর্বাদ কামনা করা। কালহারিণী কালী মাতার শ্রীচরণে প্রার্থনা জানায় “অগ্নিদগ্ধাশ্চ যে জীবা যেহপা দগ্ধা কুলে মম। উজ্জ্বল জ্যোতিষা দগ্ধান্তে যান্তু পরমাং কাল হরণ কারিনী কালী হচ্ছে শ্যামা”।
ইনিই দশ মহাবিদ্যারূপিনী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলামুখী মাতংগিনী, কমলা, কালী তারা, ষোড়শী, কামাক্ষ্যা, ভূবেনশ্বরী। বহু রূপে বহু নামে ডাকা হয় মাকে। তিনি স্বামী বিবেকানন্দের “কালী- দ্যা মাদার”। শ্রীরাম প্রসাদের বেড়া বাধুনী কণ্যা রূপী কালী মা, শ্রী রাম কৃষ্ণের দক্ষিণেশ্বরী কালী মাতা। বামাক্ষেপার তারা পীঠের তারা মা।
কামরূপের কামাক্ষ্যা, কলিকাতার কালী, ঢাকার ঢাকেশ্বরী, জামালপুরের দয়াময়ী, চট্টগ্রামের চট্টেরশ্বরী, নবদ্বীপের পোড়ামা ভবতারিনী। সত্য যুগে মহামায়া, চন্ডী ত্রেতাতে। দ্বাপর যোগমায়ায় যোগেশ্বরী বৃন্দে (বড়াই বুড়ি)। প্রতিটি মানব দেহে তিনিই কূল কুন্ডলিনী শক্তিরূপে বিরাজ করছেন। আদ্যাশক্তি জগদ্মাতা শক্তিভূতা, সৃষ্টি শক্তিরূপী পরমাশি মায়া, সর্বকারণের কারণ রূপী। সৃষ্টির প্রারম্ভে স্বয়ং বিষ্ণু দেবীকে স্মরণ করে মধু-কৈটব নামে দুই অসুরকে বধ করেন।
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মায়া শক্তি ভুবনপূজিতা দুর্গা; তাঁরই ভয়ংকর উগ্রমূর্তি হলেন কালীমাতা। তবে কিভাবে তিনি খড়গ হাতে সন্তানের মস্তক ছিন্ন করেন? এ কেমন মা? দেবীকালী জগন্মাতা হয়েও উগ্র কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, রাষ্ট্রের সকল জীবই রাষ্ট্রের প্রজা এবং তারা রাজার সন্তানের মতো। তবুও অপরাধীকে দন্ড দেওয়া রাজার কর্তব্য, এমনকি নিজের সন্তান হলেও। এব্যাপারে রাজাকে অবশ্যই অত্যন্ত কঠোর হতে হয়। অন্যথায় দেশ অনাচারে ছেয়ে যাবে।
তখন রাজাকে অযোগ্য বলে বিবেচনা করা হবে। তথাপি সন্তানদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও অসুরদের দন্ডদান করতে তাঁকে ভয়ংকর উগ্ররূপিণী কালী রূপ ধারণ করতে হয়। অসুর কারা? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, যারা শাস্ত্র বিধি পরিত্যাগ করে পাপাচারে লিপ্ত হয় তাঁরাই অসুর। আবার গীতার ৭ম অধ্যায়ের ১৫তম শ্লোকে ভগবান বলেছেন, (মূঢ়, নরাধম, মায়া দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে এবং আসুরিক ভাবাপন্ন) তাঁরাই অসুর।
সেই অসুরদের মেদ (মাংস) থেকে এই মেদেনীর সৃষ্টি। তাই আজও এই মাটিতে অসুরের সৃষ্টি হচ্ছে। সেই সব অসুরদের হাত থেকে রক্ষা পেতেই আজ দেবী শক্তির আহবান। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অর্জুনের বাহুতে শক্তি সঞ্চার করেন দেবী মহামায়া চন্ডী। এছাড়াও দেবী যোগমায়া রূপে মধুর বৃন্দাবনে রাধা গোবিন্দের যুগল মিলনে সহায়িকারূপে কাজ করে। অদ্যবধি দেবী তুলসী সারা বিশ্বে সনাতনী নর-নারীর হৃদয়ে কৃষ্ণ ভক্তির সহায়িকা শক্তি হিসেবে কাজ করে চলেছে।
শাস্ত্র মতে জানা, শ্রী বৃন্দাদেবীর কৃপা না হলে, শ্রীধাম বৃন্দাবনে প্রবেশাধিকার সম্ভব নয়। ভক্তিরমামৃতে বলা হয়েছে, বৃন্দাদেবীর কৃপা হলে, শ্রীমতি রাধা রাণীর কৃপা হয়! প্রেমময়ী রাধা রাণীর কৃপায় শ্রী গোবিন্দ দর্শন হয়। বহুরূপে বহুভাবে দেবীর সাধন ভজন করার বিধান রয়েছে। এখানে তন্ত্র মন্ত্রে দেবীকে তুষ্ট করে অনেকেই সাধকখ্যাত হয়েছেন। আবার ভক্তির মাধ্যমে দেবীর কৃপা লাভ করেছেন। তাদের স্মরণ করলে পাপ বিনষ্ট হয়। তাদের পরশে গঙ্গা পবিত্র হয়।
দেবী সৃষ্টি রক্ষায় মাতৃরূপে গৃহে গৃহে অবস্থান করেন। আবার অসুর বধে দেবী মাতাংগিনীরূপে সব ধ্বংস করেন। সৃষ্টি রক্ষায় সমস্ত দেবতারা যখন ব্যর্থ, তখন বৈষ্ণব শক্তি শব (মরদেহ) রূপে দেবীর আগমন পথে পড়ে রইলেন। মুন্ডুমালিনী উন্মাদিনী তার ডাকিনী-যোগিনী সঙ্গে রণরঙ্গিনী বেশে ছুটে যাচ্ছেন। পায়ের নিচে শব (মরা) রূপে পতি শিবকে দেখে দেবী লজ্জ্বিত হয়ে জিভে কামড় দেন। যে দেবী রক্ত পিপাসায় নিজের মস্তক কেটে ছিন্নমস্তারূপে রক্ত পান করেছিলেন। সেই দেবী লজ্জ্বায় রণে ক্ষান্ত হলেন। লজ্জ্বা যে নারীর ভূষণ- এ সত্যই এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
আজকাল সত্যি কথা বলতে কি, এসব লজ্জ্বাটুকু অনেকটা দূর হয়ে যাচ্ছে। কালী বা শ্যামা রূপের মাঝে আমরা আমাদের বাঙালী মায়েদের চরিত্র দেখতে পাই। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর যে ভক্তি প্রদর্শন কালী চরিত্রে তা প্রস্ফুটিত হয়েছে। পদ্মা পুরাণ, মহাভারত ও রামায়নের নারী চরিত্রে লজ্জ্বাই নারীর ভূষণ এবং (স্বামী) পতি পরম গুরু রূপে উল্লেখ করা হয়েছে।