ইয়ার্ন মার্চেন্টে ওসমান দোসররা বহাল তবিয়তে
যুগের চিন্তা রিপোর্ট :
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০৯:২৪ পিএম, ৬ নভেম্বর ২০২৪ বুধবার
# লিটন সাহা গ্রেফতার হলেও অধরা তাঁর কুকর্মের সহযোগীরা
নারায়ণগঞ্জ-৪ ও ৫ আসনের সাবেক সাংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানের প্রেসক্রিপশনে নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি ওসমানদের অন্যতম দোসর খালেদ হায়দার খান কাজলের হাতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গত বছরের ৮ মে গঠিত সূতা ব্যবসায়ীদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ ইয়ার্ন মার্চেন্ট অ্যাসোয়িশনের ২০২৪-২০২৫ সালের কমিটি বাতিল করে পূনরায় নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্যতা যাচাই করে ব্যবসায়ীদের পছন্দের নেতা গঠনে তোড়জোড় চালিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীবৃন্দ। যা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা উঠছে এই ব্যবসায়ী সংগঠন ঘিরে। বিগত দিন থেকেই ইয়ার্ন মার্চেন্টের নাম ব্যবহার করে চোরাই সুতা ব্যবসার সিন্ডিকেট করেন সংগঠনটির সভাপতি লিটন সাহা।
এছাড়া টানবাজারের সুতা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সংগঠনের নামে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন এই লিটন সাহা ও তার এই ইয়ার্ন মার্চেন্টে ২০২৪-২০২৫ সালের কমিটিতে স্থান পাওয়া ওসমান পরিবারের দোসররা। এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শামীম ওসমানের সাথে প্রকাশ্যে ছাত্র-জনতার উপরে গুলি বর্ষণ হত্যা মামলার আসামী হন সংগঠনটির সভাপতি লিটন সাহা। সেই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ নভেম্বর শুক্রবার রাতে রাজধানীর বেইলী রোডের বাসা থেকে লিটন সাহাকে গ্রেপ্তার করে ডিবির একটি টিম। লিটন সাহা ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ওসমান পরিবারের এক কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে টাকা বিলি ও ভোটারদের ধর্মীয় গ্রন্থ ছুঁয়ে শপথ করিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। ইতোমধ্যে লিটন সাহাকে রিমাণ্ডে নিয়েছে ডিবি। একটি হত্যা মামলায় আদালত ২ দিনের রিমাণ্ড মঞ্জু করে।
পরবর্তীতে ২ নভেম্বর বিকেলে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেনের আদালত এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। এই কুখ্যাত লিটন সাহা দীর্ঘ তিনমাস পালিয়ে থাকাতে তার নির্দেশনা মোতাবেক ইয়ার্ন মার্চেন্ট অ্যাসোয়িশন পরিচালনা করেছেন তারই দোসর সংগঠনটির সিনিয়র সহ-সভাপতি অশোক মহেশ^রী, সহ-সভাপতি মোজ্জম্মেল হক, সদস্য মুজিবর রহমান। ওসমানদের পটেকম্যান হিসেবে পরিচিত ইয়ার্ন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি লিটন সাহার অপকর্ম ঢাকতে ব্যস্ত এই গ্রুপ। ইতিমধ্যে ব্যবসায়ী সংগঠনে ওসমানদের দোসররা বহাল থাকায় দফায় দফায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন জেলা বিএনপির সভাপতি আলহাজ¦ মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন।
কিন্তু কোন প্রকারের কিছু তোয়াক্কা না করেই বিভিন্নভাবে ম্যানেজের মাধ্যমে বহাল রয়েছেন সেই বাকি দোসররা। এদিকে ইয়ার্ন মার্চেন্টে লিটন সাহার নেতৃত্বে কমিটিতে ছিলেন, সিনিয়র সহ-সভাপতি অশোক মহেশ^রী, সহ-সভাপতি মোজ্জম্মেল হক, সহ-সভাপতি মোস্তফা এমদাদুল হক, সহ-সভাপতি সানজিদ রায়, সদস্য মুজিবুর রহমান, আমিন উদ্দিন ভূঁইয়া, জয় কুমার সাহা, তাজুল ইসলাম, সিরাজুল হক হাওলাদার, আকবর হোসেন, মো. আকরাম, গৌতম সাহা, তাইজুদ্দিন আহম্মেদ, মাহমুদুল হাসান, মো. মূসা, জাহিদ হাসান, জীবন সাহা, বিশ^জিৎ সাহা, অসিম কুমারসহ আরো অনেকেই। এরা দীর্ঘ ১৭ বছর ওসমানদের দালালী করে এখনো ব্যবসায়ী ট্যাগে টানবাজারে রয়েছেন।
সূত্র বলছে, প্রায় ৩ মাস অতিবাহিত হলেও এখনো পদত্যাগ করেনি বিগত আওয়ামীলীগ শাসনামলে ওসমান পরিবারের আর্শিবাদে ইয়ার্ন মার্চেন্টস এসোসিয়েশনে রামরাজত্ব কায়েম করা লিটন সাহা ও ওসমানদের প্রেসক্রিপশনে গঠতি কমিটি। পট পরিবর্তনের পরে লিটন সাহা ও তার ভাই রামু সাহা গা ঢাকা দিলেও এখনো ওসমানদের রাহুমুক্ত হয়নি সংগঠনটি। বিগত দিনে যারা ওসমান পরিবারের পদলেহন করে সংগঠনটিতে বিনাভোটে নির্বাচিত হয়েছিল তারা এখনো রয়েছে স্বপদে বহাল। লিটন সাহা ও রামু সাহা পালালেও মুঠোফোনে চলছে তাদের নিরব চাঁদাবাজি। বিশেষ করে বিগত আওয়ামীলীগ শাসনামলে নারায়ণগঞ্জে চোরাই সুতা তথা বন্ড সুতা জালিয়াতির সিন্ডিকেটের গডফাদার বনে যাওয়া লিটন সাহার আর্শিবাদপুষ্টরা এখনো ইয়ার্ন মার্চেন্টসের কমিটিতে আসীন থাকায় টানবাজারে বন্ধ হয়নি চোরাই সুতার কারবার।
বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বন্ড জালিয়াতি মামলায় লিটন সাহার বাবা আসামী হয়েছিল। তবে লিটন সাহা ইয়ার্ন মার্চেন্টস এসোসিয়েশনের ভাপতি হওয়া সে ছিল ধরা ছোয়ার বাইরে। কাস্টমসের অভিযানে একাধিক চোরাই সুতা ব্যবসায়ী পাকড়াও এমনকি মামলার আসামী হলেও লিটন সাহা সভাপতি হওয়ায় আসামী হয়নি। ইয়ার্ন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের আওতাধীন ইয়ার্ন মার্চেন্ট ক্লাব। তবে আওয়ামীলীগ শাসনামলের এক দশক ধরেই সুতা ব্যবসায়ীদের এই ক্লাবটি ইয়ার্ন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের বর্তমান সভাপতি বিতর্কিত লিটন সাহার নেতৃত্বে আসার পর থেকে নানা কারণে ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে সংগঠনটি। যার মধ্যে অন্যতম ছিল লিটন সাহার শেল্টারে চলেছে অবাধে জুয়া খেলা ও মাদক বিক্রি।
এছাড়াও ওসমান পরিবারের আস্থাভাজন হিসেবে ক্লাবের সভাপতি পরিচয়ে দীর্ঘ এক দশক ধরেই লিটন সাহার নেতৃত্বে চলেছে নিরব চাঁদাবাজি । গত ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে ওই জুয়ার আসর থেকে জুয়া খেলার সময়ে হাতে নাতে ২২ জন জুয়ারীকে গ্রেফতার করেছে যাত্রবাড়ির ধলপুরস্থ র্যাব-১০ এর একটি টিম। এসময় জুয়া খেলার তাস ও নগদ ২ লাখ ৩১ হাজার দুইশত টাকা উদ্ধার করা হয়। পরে ১৮ এপ্রিল র্যাব-১০ এর হাবিলদার মো. আলমগীর হোসেন বাদি হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় ১৮৬৭ সনের জুয়া আইনে একটি মামলা দায়ের করেন এবং গ্রেফতারকৃতদের সদর মডেল থানায় হস্তান্তর করেন। এদিকে ২০১৯ সালের ৮ মার্চ সন্ধ্যায় সুতা ব্যবসায়ীদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ ইয়ার্ন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের টানবাজারস্থ কার্যালয়ে অবস্থিত ইয়ার্ন মার্চেন্ট ক্লাব থেকে ১২ জুয়ারিকে আটক করে সদর মডেল থানা পুলিশ।
তা ছাড়া গত ৫ আগষ্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলে সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের মতো অপকর্মের দোসর লিটন সাহা ও ছোট ভাই রামু সাহাও পালিয়ে গেছে। ৫ আগস্টের পরে নারায়ণগঞ্জ শহরের টানবাজার আশেপাশের এলাকায় কুখ্যাত লিটন সাহার বিরুদ্ধে পোস্টার সাটিয়েছে নির্যাতিত ব্যবসায়ীরা। তারা অবিলম্বে লিটন সাহা ও তার দোসরদের গ্রেফতারের মাধ্যমে দৃষ্টানমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। গত ১৭ আগস্ট রাতে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিকেএমইএ সভাপতি সেলিম ওসমান, শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমান, ভাতিজা আজমেরী ওসমান, শ্যালক বিসিবি পরিচালক তানভীর আহমেদ টিটুসহ ৪৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ২০০ জনের বিরুদ্ধে সদর থানায় মামলা দায়ের করেন নিহত আবুল হাসান স্বজনের ভাই আবুল বাশার অনিক।
ওই মামলায় লিটন সাহা ও তার ছোট ভাই রামু সাহাও আসামী। এছাড়াও আরো কয়েকটি মামলাতেও লিটন সাহা আসামী রয়েছে বলে জানা গেছে। এ দিকে প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের আর্শিবাদে লিটন সাহা বনে গিয়েছিলেন সুতা ব্যবসায়ীদের জাতীয় ভিত্তিক সংগঠন বাংলাদেশ ইয়ার্ন মার্চেন্টের সভাপতি। তার নেতৃত্বে চলেছে চাঁদাবাজি, মদের ব্যবসা, জুয়াসহ নানা অপকর্ম। বিগত দিনে তার নিরব চাঁদাবাজি অনেকটাই মুখ বুজে সহ্য করতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। নারায়ণগঞ্জের টানবাজার অন্তত সহস্রাধিক সুতা ব্যবসায়ী রয়েছে। রং ও ক্যামিকেলের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে অন্তত দেড় শতাধিক। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার সুতা বিক্রি হয় এই ছোট্ট টানবাজার এলাকাতেই।
এছাড়াও রয়েছে বন্ডের জালিয়াতি বা চোরাই সুতার ব্যবসাও। টানবাজারে বন্ড জালিয়াত ব্যবসায়ীদের গডফাদার ছিল এই লিটন সাহা। লিটন সাহা ও রামু সাহার নেতৃত্বে গত কয়েক বছর ধরে টানবাজারে গড়ে ওঠা চোরাই সুতা সিন্ডিকেটের ব্যবসায়ীরা বিপুল পরিমাণ শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বন্ড সূতা ক্রয় ও বিক্রয় করার কারণে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়তই লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছেন। টানবাজারে চোরাই, সুতা ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে কমতে শুরু করেছে সুতা ব্যবসায়ীদের সংখ্যা। লিটন সাহার বন্ড জালিয়াতির অন্যতম দোসর ছিল আমলাপাড়া এলাকার কাস্টমসের সুজিত সাহা। এদিকে বর্তমানে এই লিটন সাহার সর্ব দোষ ঢাকছেন সংগঠনটির সহ-সভাপতি মোজাম্মেল হোসেন।
ওসমানদের সহযোগীতায় অবৈধ বন্ড সুতা বিশাল চক্র, ব্যাপক চাঁদাবাজি করলেও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নাজেহাল করা ছাড়েননি লিটন সাহা। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনের সেই বিশাল খরচ এখন ব্যবসায়ীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন লিটন সাহার ঘনিষ্ঠভাজন মোজাম্মেল হক এমন অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। অনেকেই বলছেন, তার অবর্তমানে তাকে দূর থেকে সাহস, বুদ্ধি পরামর্শ দিচ্ছিলেন মোজাম্মেল হক। সরকারের পটপরিবর্তনের পর ধারাবাহিকভাবে লিটন সাহা ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের নামে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ক্ষুদ ব্যবসেোয়ৗদর পাওনা টাকার বিষয়টি। এখন লিটন সাহার পরামর্শে সেই টাকা পরিশোধের জন্য ইয়ার্ন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের এফডিআর ভেঙে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে, এতে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে সংগঠনের সদস্যদের। তারা বলছেন, মোজাম্মেল হক এমন কাজ কোনভাবেই করতে পারেননা। নানাসময় নানা ছুতোয় ব্যবসায়ীদের উপর চাঁদাবাজির খড়গ চালিয়েছেন লিটন সাহা । কখনো বিদেশে খেলা দেখার ছুতোয়, কখনো ভাই রামু সাহার নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে নির্বাচনের খরচ যোগানো আবার কখনো বা ওসমানদের দোহাই দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে থাকার কথা মাত্র সংগঠনের ৭০০ সদস্য। কিন্তু সেখানে ২ থেকে ৩ হাজার লোককে আমন্ত্রণ করা হয়েছে, বিলাসিতা দেখানো হয়েছে ওসমানদের খুশি করতে। এখন সেই টাকা পরিশোধ করতে সংগঠনের এফডিআর ভেঙে পরিশোধ করছেন লিটন সাহার ঘনিষ্ঠ মোজাম্মেল হক। যা অত্যন্ত নিন্দনীয়।
এটি কোনভাবেই সংগঠনের জন্য সুবাতাস বয়ে আনতে পারেনা। লিটন সাহার অতীত কুকর্মের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন এই মোজাম্মেলক হক। এর বাহিরে ও শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানের হাত ধরে যারা কমিটিতে স্থান পেয়েছে তারা সকলে এখনো ওসমানদের আসার ভয়-ভীতি দেখিয়ে টানবাজার জুড়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। সেখান থেকে এই ঐতিহ্যেবাহী টানবাজারের সুতা ব্যবসায় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ইজিএম এর মধ্যেমে শীঘ্রই নির্বাচন করে যোগ্যতা যাচাই করে ভোটের মাধ্যমে ব্যবসায়ীক নেতা নির্বাচিত হওয়া দরকার বলে মনে করছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।