বৃহস্পতিবার   ১৪ নভেম্বর ২০২৪   কার্তিক ৩০ ১৪৩১   ১২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

প্রভাব খাটিয়েছেন এমপির স্ত্রীরাও

যুগের চিন্তা রিপোর্ট :

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৮:৩৬ পিএম, ৭ নভেম্বর ২০২৪ বৃহস্পতিবার

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির এমপির সাথে সাথে প্রভাববিস্তার করেছেন তাঁদের স্ত্রীরাও। এমপির ছেলেরা নারায়ণগঞ্জে রাজপুত্রের মতো নিজেদের শাসন কায়েম করতেন। আবার এমপির স্ত্রীরাও প্রভাব বিস্তার করতে করতে আলাদা বলয় তৈরি করে ফেলেন। কারো কারো তো আলাদা বাহিনীও গড়েও উঠে। জাতীয় মহিলা সংস্থা, লেডিস ক্লাব, পৌরসভা, স্থাস্থ্য কমপ্লেক্স, রাজনীতির মাঠ সবজায়গাতেই তারা ছিলেন দাপুটে। এছাড়া সাবেক এক এমপির স্ত্রীকে তার কর্মীরা আম্মাজান খেতাব দিয়ে তার শেল্টারে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতো।

 

সূত্র জানিয়েছে, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত একেএম নাসিম ওসমানের স্ত্রী পারভীন ওসমান ও তাদের ছেলে আজমেরী ওসমানের পৃথক দুটি বাহিনী ছিল। আজমেরী ওসমানের সন্ত্রাসী গ্রুপটিকে ভাইজান গ্রুপ, আর পারভীন ওসমানের গ্রুপটি আম্মাজান গ্রুপ নামে কুখ্যাতি অর্জন করেছিল। ঝুট সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, জমি দখল, ফ্ল্যাট দখলসহ প্রায় সকল অপকর্মের নিয়ন্ত্রণেন ছিল এই দুই বাহিনী। ২০১৪ সালে নাসিম ওসমানের প্রয়াত হওয়ার পর সংসদ সদস্য হিসেবে উত্তরসূরী হতে না পারলেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে দুইধাপ এগিয়ে গিয়েছিল এই দুটি গ্রুপের আগ্রাসনের মাত্রা।


 
গডফাদারের রাজনীতি করতেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। তার ছিল বিশাল বিশাল বাহিনী। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিন দফায় নির্বাচিত হওয়ার পর তার সন্ত্রাসীদের রাজত্ব বেশ কয়েকগুন বেড়ে যায়। শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমানও ছিলেন আলাদা আলাদা বেশ কয়েকটি গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। তাছাড়া ছাত্রলীগের সকল অপকর্মের মূল নিয়ন্ত্রক ছিলেন অয়ন ওসমান। শামীম ওসমানের স্ত্রী সালমা ওসমান লিপির আলাদা বলয় ছিল। জাতীয় মহিলা সংস্থা নারায়ণগঞ্জের সভাপতি হিসেবে তিনি ছিলেন। মাঝে সিটি নির্বাচনেও নির্বাচন করার জন্য জোরাজুরি করলেও মেয়র আইভীর ক্লিন ইমেজের কারণে সুবিধা করতে পারেননি। তবে তার শেল্টারেও ব্যাপক সন্ত্রাসী ও সুবিধাভোগী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। লিপি ওসমানের মামা জালাল, ভাই তানভীর আহম্মেদ টিটু আলাদা বলয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, দখলবাজি, জমি দখলসহ বিভিন্ন সংগঠনের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করতেন।

 

এদিকে ব্যবসায়ী সংগঠক বিকেএমইএ’র সভাপতি আরেকদিকে সংসদ সদস্য হয়ে ব্যবসায়ীদের জন্য জমদূত ছিলেন সেলিম ওসমান। তার অধিনস্তদের দিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ব্যাপক চাঁদাবাজি করার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। সেলিম ওসমান যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানে চাঁদাবাজির রামরাজত্ব তৈরি করেছেন। অপরদিকে চাঁদাবাজির একটি অংশ দানের ক্ষেত্র তৈরি করে দানবীর সেজে গিয়েছিলেন সেলিম ওসমান। শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে কান ধরে উঠবস করিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হন সেলিম ওসমান। পরে ক্ষমতার জোরে সেখান থেকে রেহাই পান। বন্দরে চারটি স্কুল তৈরি করেছেন যার অর্থের উৎস নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা আছে। নারায়ণগঞ্জ-৩০০ শয্যা হাসপাতালের ভবন তৈরির জন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করেছিলেন। পরে উপর মহলের চাপে সেই টাকা ফেরত দিয়ে হাসপাতালের সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ান। ২০১৭ সালের পর থেকে তাঁর স্ত্রী নাসরিন ওসমানকেও লাইমলাইটে নিয়ে আসার চেষ্টা চালান সেলিম ওসমান। নাসরিন ওসমানেরও একটি সিন্ডিকেট তৈরি হয়।

 

পিছু হটেননি নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীও। বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী তৈরি করে রূপগঞ্জের নিজের রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। ছেলে গোলাম মর্তুজা পাপ্পা গাজীরও বিশাল বাহিনী ছিল। বাবা-ছেলের পৃথক দুই বাহিনীই জমি দখল., জবর দখল, রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবসায়ীদের উপর প্রভাব বিস্তার করতো। গোলাম দস্তগীর গাজীর স্ত্রী হাছিনা গাজীও ছিলেন রূপগঞ্জে প্রভাবশালী। স্বামী ও ছেলের প্রভাবে নিরঙ্কুশভাবে রূপগঞ্জের তারারো পৌরসভায় রাজত্ব করেছেন দীর্ঘদিন। মহারানীর মতোই রূপগঞ্জের সব সেক্টরে হুকুম ফলাতেন হাছিনা গাজী। যেসকর কাজ গোলাম দস্তগীর গাজী কিংবা পাপ্পা গাজীকে দিয়ে করতে সফল হওয়া যেতোনা সেসকল কাজে হাছিনা গাজী ছিলেই সিদ্ধহস্ত। এতে গাজী পরিবারের কমিশন যেত তিনগুন।

 

আড়াইহাজারের একচ্ছত্র রাজা ছিলে নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সাবেক এমপি , সাবেক হুইপ ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম বাবু। সন্ত্রাস আর আধিপত্য দিয়ে এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলেন তার কথা ছাড়া আড়াইহাজারের একটি পাতাও নড়তো না। আওয়ামী লীগের কোন ব্যক্তিও তার বিরুদ্ধে জাতীয় নির্বাচনে দাঁড়ানোতো দূরের কথা, ওয়ার্ড মেম্বার পদেও দাঁড়ানোর সাহস করতেননা। তাঁর স্ত্রী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. সায়মা আফরোজ ইভা ছিলেন ওই এলাকার অঘোষিত রানী। সরকারি কর্মকর্তা হয়েও বছরের পর বছর নিজ উপজেলাতেই সরকারি পদ আকঁড়ে ধরে থেকেছেন। জেলার সিভির সার্জন তো দূরের কথা খোদ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিরাও তাকে বদলীর কথা আদৌও ভাবতে পারেননি। বাবুর মতোই তার স্ত্রী ইভাও সম্পদের দিক থেকে ফুলে ফেঁপে ওঠেন। দুদকের কাছে বাবু ও তাঁর স্ত্রীর ব্যাপক সম্পদ নিয়ে নানা সময় কথা চললেও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সেসব ফাইল সবসময় বন্ধই ছিল।

 

নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাপা নেতা লিয়াকত হোসেন খোকা ওসমান পরিবারের হাত ধরে সোনারগাঁয়ে রাজত্ব করেছেন প্রায় ১০ বছর। সাবেক এমপি আব্দুল্লাহ আল কায়সার হাসনাতও তার কাছে সেসময় পাত্তা পায়নি। লিয়াকত হোসেন খোকার মতো তাঁর স্ত্রী ডালিয়া লিয়াকতও ছিলেন প্রভাবশালী। ডালিয়ার নিয়ন্ত্রণেও ছিলো সোনারগাঁয়ের একটি বিশাল বাহিনী। উপজেলা মহিলা সংস্থার পদ তো বটেই ডালিয়া হতে চেয়েছিলেন সোনারগাঁ পৌরসভার মেয়র। অনেকটা গাজীর স্ত্রী হাছিনা গাজীকে অনুকরণ করে। কিন্তু সোনারগাঁ পৌরসভার সচেতন মানুষ এর প্রতিবাদ করলে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করলে পিছু হটেন লিয়াকত হোসেন খোকা। শেষমেষ নির্বাচন না দিতে ডিও লেটার পাঠান বলেও জনশ্রুতি আছে। এখন অবধি সোনারগাঁ পৌরসভার নির্বাচন লিয়াকত হোসেন খোকার কূটচালে ঝুলে আছে। যার মূল কারণ ছিল তার স্ত্রী ডালিয়া লিয়াকত।

 

আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনের অবসান হয়েছে। অন্তর্র্বতীকালীন সরকার আগামী নির্বাচন স্বচ্ছ করতে নানাবিধ সংস্কার কাজ শুরু করেছে। নারায়ণগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ চান, অতীতের মতো যাতে নারায়ণগঞ্জে যেই জনপ্রতিনিধি হোক না কেন, তাঁর পরিবারের সকল ব্যক্তিরা যাতে লুটেপুটে দুর্নীতি করে মানুষকে শোষণ করার সুযোগ না পায়।