গণদাবির বিরুদ্ধে অনড় বাস মালিকরা!
যুগের চিন্তা রিপোর্ট
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০৭:০৫ পিএম, ১৫ নভেম্বর ২০২৪ শুক্রবার
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটসহ জেলার সকল রুটের বাসভাড়া কমানোর দাবিতে আন্দোলন করছে যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম। চলমান এই আন্দোলনের সাথে একমত নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সকল সংগঠনগুলো। এই আন্দোলনকে সাধুবাদ জানিয়েছে যাত্রী সাধারণও। তবে এই গণদাবির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন কেবল বাসমালিকরা। বাস ভাড়া না কমানো বিষয়ে তারা এখনো অনড়।
বাস মালিকদের ভাষ্য, এটি আলোচনা করার মতো কোনো বিষয় না। কেননা, দ্রব্যমূল্যের এই উর্দ্ধগতির পরিস্থিতিতে যেখানে সবকিছুর মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে সেখানে এত খরচ বহন করে ভাড়া কমানো সম্ভব নয়। ‘প্রয়োজনে বাস বন্ধ করে দিবে কিন্তু ভাড়া কামানো যাবে না’, এমন অবস্থান বাস মালিকদের।
কিন্তু যাত্রী অধিকার ফোরামের নেতাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিনের পরিবহন সিন্ডিকেটকে সুবিধা দিতেই বাস মালিকদের এমন ‘গণবিরোধী’ অবস্থান।
যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরামের হিসেবে, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটর দূরত্ব ও ডিজেলের বর্তমান মূল্য অনুযায়ী এ রুটের বাস ভাড়া নন-এসি ৪৫ টাকা, এসি ৬৫ টাকা এবং বিআরটিসি এসি বাসের ভাড়া ৬০ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু বাস মালিকদের বিভিন্ন পর্যায়ে ও রাজনৈতিক দলগুলোকে চাঁদা দিতে বাধ্য হওয়ায় তারা অতিরিক্ত ভাড়া ধার্য করে এসেছেন। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এই পরিস্থিতি বদলেছে। তাই বাস মালিকরা প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারে এবং এতে বাস ভাড়া কমানো সম্ভব।
গত ২৬ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে সকল রুটের বাসভাড়া কমানোর দাবি জানিয়ে হরতালসহ টানা ৯ কর্মসূচি ঘোষণা করে যাত্রী অধিকার ফোরাম। ২৯ অক্টোবর লিফলেট বিতরণের মধ্য দিয়ে টানা কর্মসূচির সূচনা হয়। ইতোমধ্যে লিফলেট বিতরণ, পেশাজীবী, শ্রমিক, ছাত্রদের সাথে আলোচনা সভা, পথসভা, মশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামীকাল শুক্রবার শহীদ মিনারে সমাবেশও ডাকা হয়েছে।
শুক্রবারের মধ্যে ভাড়া না কমালে আগামী ১৭ নভেম্বর অর্ধবেলা হরতাল পালন করা হবে বলেও জানিয়েছেন সংগঠনটির আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি।
এদিকে, বাসভাড়া আগের মতো বহাল রাখার পক্ষে নিজেদের যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন বাস মালিকরা। তারা বলছেন, বর্তমানে বেড়েছে বাসের সকল যান্ত্রাংশের দাম। সড়কের যে অবস্থা তাতে কিছুদিন পরপরই কিছু না কিছু নষ্ট হচ্ছে। তেলের দাম উঠানামা করে। নিয়মিত গাড়ির মেইনটেনেন্স করা লাগে। মূল্যবৃদ্ধির এ সময়ে সকলে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়।
তাই আমাদের সকল স্টাফ, কর্মচারী, ড্রাইভার, হেল্পার সকলের বেতন বৃদ্ধি করতে হয়েছে। এসব খরচের মধ্যে বাস ভাড়া কমিয়ে মালিকদের হাতে লভ্যাংশ বলতে কিছু থাকবে না। এমন পরিস্থিতে যদি ভাড়া কমাতে বলা হয়, তাহলে বাস বন্ধ করে দেয়া ছাড়া উপায় নেই।
অন্যদিকে যাত্রী অধিকার ফোরাম বলছে, গত ২ এপ্রিল বিআরটিএ নারায়ণগঞ্জ রুটে বাসভাড়া নির্ধারণ করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে কিন্তু তা মানেনি মালিকপক্ষ। প্রজ্ঞাপনের বাইরে গিয়ে বছরের পর বছর অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে।
প্রজ্ঞাপনে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব সাড়ে ১৯ কিলোমিটার দেখিয়ে (২ দশমিক ৩২ টাকা কিলোমিটার প্রতি) ভাড়া দেখানো হয়েছে ৪৫ টাকা। সাথে ফ্লাইওভার টোল ৫ টাকা ও সানারপাড় ইউটার্ন ৩ টাকা দেখিয়ে বলা হয়, এই রুটে মোট ভাড়া ৫৩ টাকা। সে প্রজ্ঞাপনেই আবার বলা হয় যে, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের ভাড়া হবে ৫৪ টাকা। কিন্তু বাস্তবে নেওয়া হচ্ছে ৫৫ টাকা।
প্রজ্ঞাপনে মতিঝিল শাপলা চত্বর ঘুরে দূরত্ব দেখানো হয়েছে সাড়ে ১৯ কিলোমিটার। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো বাস শাপলা চত্বর ঘুরে যাতায়াত করে না। সে অনুযায়ী, বর্তমান দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার। গত ৩০ আগস্ট সরকার ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ১ দশমিক ৫০ টাকা এবং পরে শূন্য দশমিক ৫০ টাকা কমালেও ভাড়া কমানোর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি বিআরটিএ বা প্রশাসন। একই সাথে শিক্ষার্থীতের হাফ ভাড়া বিষয়ও অমিমাংসিত।
যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরামের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে জেলার বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন। দাবির সাথে সংহতি জানিয়ে এই ফোরামে রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদ, গণসংহতি আন্দোলন, নাগরিক কমিটিসহ নাগরিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কয়েকটি সংগঠনের নেতারা সম্পৃক্ত রয়েছেন। তবে গণমুখী এই আন্দোলনের সাথে ঐকমত্য রয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, এ দাবির পক্ষে তাদের সমর্থন রয়েছে।
আন্দোলনের সাথে সংহতি জানিয়ে বুধবার বাস ভাড়া কমানোর দাবিতে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হককে স্মারকলিপি দেন ৪০২ জন আইনজীবী। এর আগে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠন।
এ বিষয়ে সর্বশেষ বুধবার আলোচনায় বসে জেলা প্রশাসক, বিআরটিএ, বাস মালিক ও যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম। এদিনও বাস মালিকরা, ভাড়া কমানোর বিরুদ্ধে মত দেন। এদিনে, বাস মালিকরা টিকেট প্রতি ৩ টাকা ভাড়া কমিয়ে ৫২ টাকা এবং প্রতি বাসে ৫ জন শিক্ষার্থীকে অর্ধেক ভাড়ায় যাতায়াত করতে দেয়ার প্রস্তাব রাখে। তবে এ প্রস্তাব নাকচ করে দেয় যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ ফোরাম।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, ‘আলোচনায় সকলে যার যার মতো করে প্রস্তাবনা রেখেছেন। তবে কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায়নি।’
যাত্রী অধিকার ফোরামের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি বলেন, ‘ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে বাসভাড়া ৪৫ টাকা করতে হবে। একইসাথে অন্যান্য রুটের বাসের ভাড়াও কমাতে হবে। কেননা, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের বাইরে যেসব রুটে বাস চলাচল করে সেগুলো সিএনজি-চালিত কিন্তু তারা ভাড়া আদায় করছে ডিজেলের। পরিবহন সিন্ডিকেটকে সুবিধা দিয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করা বন্ধ করতে হবে। বাসভাড়া না কমানো পর্যন্ত আমাদের কর্মসূচি চলবে।’
আগামী ১৭ নভেম্বরে হরতাল কর্মসূচির পরও যদি বাসভাড়া না কমানো হয়, সেক্ষেত্রে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলেও জানান তিনি। এন. হুসেইন রনী /জেসি