সোমবার   ১৮ নভেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ৪ ১৪৩১   ১৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাগে-ক্ষোভে হত্যার পর লাশ ৭ টুকরো করেন প্রেমিকা

রাকিবুল ইসলাম :

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৮:৪১ পিএম, ১৫ নভেম্বর ২০২৪ শুক্রবার

রোমহর্ষক ও নির্মম এক হত্যকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। রূপগঞ্জে পলিথিনে মোড়ানো সাত টুকরো ১৩ নভেম্বর যে লাশের সন্ধান মিলেছিল সেটি ফতুল্লার সস্তাপুর এলাকার চাঁদ ডাইংয়ের মালিক শিল্পপতি জসিম উদ্দিন মাসুমের (৬২)। প্রেমের সম্পর্কের জেরে ক্ষুব্ধ হয়ে ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন মাসুমকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে চাপাতি দিয়ে জবাই করে হত্যার পর টুকরো অংশ প্রথমে পাঠাও ও পরে সিএনজি ভাড়া করে বিভিন্ন স্থানে ফেলেছেন। হত্যাকাণ্ডে জড়িত নিহত মাসুমের প্রেমিকা রুমা আক্তারকে (৩০) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃত নারী রুমা আক্তার ময়মনসিংহের গৌরিপুর তারাকান্দা এলাকার মো. নজর আলীর মেয়ে।

 

গ্রেফতারের পর নিহত মাসুমের প্রেমিকা রুমা আক্তার প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। রোমহর্ষক এই হত্যাকাণ্ডের পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলে গায়ে শার্ট ও ট্রাউজার ও মাথায় ক্যাপ পরিহিত রুমা আক্তারকে যখন গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হয় তখনও তিনি ছিলেন হাস্যেজ্জ্বল। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের পরও কোন অনুশোচনা কিংবা নিজের কর্মের জন্য তাকে বিচলিত হতে দেখা যায় নি। ঠাণ্ডা মাথায় খুনের পর টুকরো টুকরো করে লাশ বিভিন্নস্থানে গুমের চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত পার পাননি এই নারী। 

 

গতকাল এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, রূপগঞ্জের পূর্বাচলে জসিম উদ্দিন মাসুমের সাত টুকরো লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রথমে লাশের পরিচয় পাওয়া যায়নি। পরে গুলশান থানার একটি জিডির সূত্র ধরে লাশের পরিচয় জানতে পারি। ‘এই ঘটনায় পুলিশ অনুসন্ধান চালিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি রুমা আক্তারকে (২৮) রাজধানীর কাফরুল শেওড়াপাড়া এলাকার ভাড়া বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যায় সরাসরি জড়িত থাকার কথা আসামী রুমা আক্তার স্বীকার করেছেন। সেই সাথে নিহত জসিম উদ্দিন মাসুমের সাথে তার পরকীয়া সম্পর্ক ছিল বলে জানিয়েছেন। এ সময় হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ১টি চাপাতি, ১টি হ্যাকসো ব্লেড এবং ভুক্তভোগীর পরিহিত সাফারি, একজোড়া স্যু উদ্ধার করা হয়। এর আগে ১৩ নভেম্বর সকালে রূপগঞ্জের পূর্বাচলে ৫ নম্বর সেক্টর লেকের পাড়ে তিন পলিথিনে মোড়ানো নিহতের ৭ টুকরা খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করা হয়। এস আই জাহাঙ্গীর নিহতের বিচ্ছিন্ন মাথা, দুইটি হাত, বিচ্ছিন্ন দুটি পা, বুকের পিছনের অংশ, পেটের ভুরি, ফেপসা, কলিজাসহ দেহের অন্যান্য অংশ পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ।

 

পুলিশ সুপার জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার রুমা হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছেন। তার দেওয়া তথ্যমতে, মাসুমের মরদেহের অন্যান্য অংশ খুঁজে পাওয়া গেছে। রুমার সঙ্গে শিল্পপতি মাসুমের অবৈধ প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এই প্রেমের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে গত ১০ নভেম্বর ঢাকায় শেওড়াপাড়া রুমার ভাড়া বাসায় মাসুমকে ডেকে নিয়ে প্রথমে দুধের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে। পরে তাকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়। এর পর চাপাতি দিয়ে জবাই করে লাশ টুকরো টুকরো করা হয়। সেই টুকরো অংশ প্রথমে পাঠাও এবং পরে সিএনজি ভাড়া করে এগুলো বিভিন্ন স্থানে ফেলেছে।

 

পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, এই ঘটনায় আরও দুই জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তারা এই ঘটনায় জড়িত কিনা তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম পরিচয় প্রকাশ করা হচ্ছে না। 

 

হত্যার কারণ হিসেবে রুমা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, তাকে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে নিয়ে দিয়েছেন নিহত ব্যবসায়ী মাসুম। কিন্তু এই ফ্ল্যাটের পাশের ফ্ল্যাটে রুমার আত্মীয় থাকে। তবে একদিন অন্য আরেক নারীকে নিয়ে নিহত মাসুমকে এই ফ্ল্যাটে যেতে দেখেছে রুমার আত্মীয়। সেই ক্ষোভের কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে পরকীয়া প্রেমিক শিল্পপতি জসিম উদ্দিন মাসুমকে হত্যা করে টুকরো টুকরো করে ফেলেন। পরে টুকরোগুলো গুমের চেষ্টা করে ফেলেন। নিহত মাসুম ওই নারীকে বিবাহ করবে এমন কথা দিয়েছিল বলে জানায় আসামী।

 

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিহত জসিম নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার কাঠেরপুল এলাকার মৃত আলেক চান ব্যাপারীর ছেলে। তিনি ফতুল্লার চাঁদ ডাইং ও নিট কম্পোজিট গার্মেন্টসের মালিক। তিনি পরিবার নিয়ে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বসবাস করতেন। নিহত মাসুমের ২ ছেলে এবং ১ মেয়ে ও স্ত্রী রয়েছে। বড় ছেলে শিবু পেশায় ডাক্তার। ছোট ছেলে শিহাব পিতার ব্যবসা দেখাশোনা করছেন। নিহত শিল্পপতি মাসুম মানবাধিকারকর্মী হিসেবে সমাজসেবায় কাজ করতেন। এছাড়া তিনি যাত্রাপালার নাট্যকর্মী হিসেবেও এক সময় কাজ করেছেন। তিনি একজন সাংস্কৃতিক মনা ব্যক্তি ছিলেন। পরিবারের তথ্যমতে সুনামের সাথে মানুষকে আপন করে নিয়ে তার ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করেছেন। তার লেনদেনেও কোন মানুষের অভিযোগ নেই।

 

নিহত মাসুমের পরিবার ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ নভেম্বর বিকেলে জসিম গাড়িতে করে বাসা থেকে বের হয়ে গুলশান যান। এরপর ব্যক্তিগত গাড়িচালককে ছেড়ে দেন। চালককে জানিয়েছিলেন, অন্য গাড়িতে নারায়ণগঞ্জের কারখানায় যাবেন। তবে রাতে বাসায় না ফেরায় ও মোবাইল বন্ধ থাকায় পরদিন গুলশান থানায় তার বড় ছেলে জিডি করেন। ১০ নভেম্বর এশার পরে নিহত ব্যবসায়ী মাসুম নিজের স্ত্রীর সাথে শেষ কথা বলেন। এর আগে তার গাড়ি চালক মালেককে নিয়ে ঢাকায় যান। যার গাড়ি নম্বর ঢাকা মেট্রো গ ২২-৪৯২৯। পরে অন্য গাড়ি দিয়ে ফেররা কথা থাকলেও তা  আর হয়ে উঠে নাই। তবে লাশ হয়ে ফিরে আসলেন তিনি। কিন্তু এই নির্মম হত্যার ঘটনা পরিবার স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে নাই। তারা এই হত্যার বিচারের দাবী জানান।

 

নিহতের ছোট বাই দায়মুদ্দিন বলেন, আমার ভাইয়ের কোন শত্রু নেই। তার শত্রু আসলেও তিনি কাছে বসিয়ে চা খাওয়াইতেন। তাকে যারা হত্যা করেছে আমরা তার শাস্তির দাবী জানাই।