বিকেএমইএ’র পরিচালনা পর্ষদ থেকে দুই জনের পদত্যাগ
মাহফুজ সিহান :
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০৯:২৩ পিএম, ২৯ নভেম্বর ২০২৪ শুক্রবার
সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের প্রতি অনাস্থা
# হাতেমের সভাপতিত্বে বর্তমান নেতৃত্বে তৈরি উদ্বেগেই এই পদত্যাগ
# হাতেম স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার প্রধান দোসর বলেছিলেন গিয়াসউদ্দিন
# বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ২২ জুলাই বিকেলে শেখ হাসিনার কাছে যান হাতেম
রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে টানা ১৪ বছর যাবত নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন (বিকেএমইএ) এর সভাপতির পদ আকঁড়ে ছিলেন বিতর্কিত সাবেক সাংসদ একেএম সেলিম ওসমান। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তড়িঘড়ি করে সভাপতি পদে সেলিম ওসমানের অবর্তমানে দায়িত্ব নেন মোহাম্মদ হাতেম। যিনি এতোদিন সেলিম ওসমানের সময়কালীন হয়ে নির্বাহী সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তিনি ওসমান পরিবারের ঘনিষ্টজন হিসেবেই পরিচিত। বিতর্কিত ওসমানের পরিবারের ঘনিষ্টজনদের নিয়েই মোহাম্মদ হাতেমের সেই পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়।
গত ২৫ আগস্ট এই পর্ষদ গঠনের তিন মাসের মাথায় সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের পরিচালনা পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করেছেন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. মনসুর আহমেদ এবং ডিরেক্টর খুরশিদ আহমেদ তুনিম। তারা দুইজন ২৮ নভেম্বর নির্বাহী প্রেসিডেন্ট বরাবর তাদের পদত্যাগপত্র জমা দেন। সূত্র জানিয়েছে বর্তমান পর্ষদের আরো বেশ কয়েকজন হাতেমের প্রতি অনাস্থা এনে পদত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
পদত্যাগ করা পরিচালনা পর্ষদের দুজন উল্লেখ করেন, ‘একটি ভারী হৃদয় এবং গভীর হতাশার সাথে যে আমরা বিকেএমইএর পরিচালনা পর্ষদের পদ থেকে অবিলম্বে কার্যকরী পদ থেকে পদত্যাগ করছি। এই সিদ্ধান্তটি এতো সহজে নেয়া হয়নি মোহাম্মদ হাতেমের সভাপতিত্বে বর্তমান নেতৃত্বের বিষয়ে আমাদের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের ফলাফল এই পদত্যাগ। আমরা এমন আচরণ লক্ষ্য করেছি, যা আমাদের দৃষ্টিতে স্বৈরাচারী প্রবণতাকে প্রতিফলিত করে এবং ন্যায্যতা, অখণ্ডতা এবং গণতন্ত্রের নীতিগুলোকে দুর্বল করে, যা আমাদের সংস্থার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এই ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপগুলি আমাদের মূল্যবোধ এবং নৈতিক মানগুলির বিরোধিতা করে।
গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের বরাতে তারা উল্লেখ করেন, প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম এবং আরও কিছু সিনিয়র বোর্ড অফ ডিরেক্টর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে (আওয়ামী লীগের) ফ্যাসিবাদকে সহযোগিতা করেছিলেন এবং জুলাই-আগস্টের গণহত্যাকে সমর্থন করেছিলেন এবং বিশেষ করে যারা নিরীহ ছাত্র ও সাধারণ জনগণকে হত্যা করেছিল।
পদত্যাগপত্রে তারা বলেন, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবং আমার বিবেকের আঁকড়ে ধরে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে যারা এই ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করে তাদের পাশে আমরা কাজ করব না। তারা বলেন, সামগ্রিকভাবে, আমরা মনে করি, আগামী ৫ ডিসেম্বর ২০২৪-এর জন্য নির্ধারিত (ইজিএম) এবং ২৪ তম (এজিএম-২০২৪) অবিলম্বে বাতিল করা উচিত। তারা বলেন, আমরা আমার সহকর্মী বোর্ড সদস্যদের প্রচেষ্টাকে গভীরভাবে সম্মান করি এবং ভবিষ্যতে সংগঠনের সাফল্য কামনা করি। যাইহোক, আমরা বর্তমান নেতৃত্বের দিকনির্দেশনা এবং সংগঠনের উত্তরাধিকার এবং মূল মূল্যবোধের উপর এর সম্ভাব্য প্রভাব প্রতিফলিত করার জন্য বোর্ডকে অনুরোধ করছি। আমরা আশাবাদী বিকেএমইএ ভবিষ্যতে তার মৌলিক মানগুলি পুনরুদ্ধার করতে পারবে।’
সূত্র জানিয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের সময় মোহাম্মদ হাতেম ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দেয়ার আশ^াস দিয়েছিলেন। আন্দোলনচলাকালীন সময়ে ২২ জুলাই বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তৎসময়ের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে ব্যবসায়ী নেতারা যেকোনো সংকটে ব্যবসায়ীরা সবসময় সরকারের সঙ্গে ছিলেন এবং আগামীতেও থাকবেন বলে আশ্বাস দেন। সেখানে বিকেএমইএ’র তৎকালীন নির্বাহী সভাপতি হিসেবে মোহাম্মদ হাতেম উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্যে হাতেম শেখ হাসিনাকে বলেন, “দুটো অনুরোধ। কারখানাগুলো যদি আমরা চালু রাখতে পারি, তাহলে শ্রমিকরা ভেতরে সুশৃঙ্খল পরিবেশে থাকবে। বাইরে থাকলে তাদের অন্যরা ব্যবহার করতে পারে, তাদের ভেতরে থাকাটাই নিরাপদ। “ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। স্বল্প পরিসরে হলেও ইন্টারনেটটা যাতে চালু করা যায়।”
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মোহাম্মদ হাতেম ওসমান পরিবারের খুবই ঘনিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত। ওসমান পরিবারের নির্দেশে যেভাবে নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাষ্ট্রিজের সভাপতির পদ আকঁড়ে রেখেছিলেন খালেদ হায়দার খান কাজল। বিকেএইএ’র ক্ষেত্রে সেটি মোহাম্মদ হাতেম। হাতেম ছাড়াও মোর্শেদ সারোয়ার সোহেল প্রত্যক্ষভাবে ব্যবসায়ীদের উপর ছড়ি ঘোরাতেন। শামীম ওসমান, সেলিম ওসমানসহ ওসমান পরিবারের ঘনিষ্টজনরাই ঘুরেফিরে বিকেএমইএ’র পর্ষদে বেশি জায়গা নেন বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। তাছাড়া ফতুল্লার বিসিক এলাকায় ঝুট ব্যবসার মূল নিয়ন্ত্রক হিসেবে ঘুরেফিরে হাতেমের নামটিই ব্যবহার করেন নানাজন।
বিগত সময়ে নারায়ণগঞ্জ হোসেয়ারি এসোসিয়েশনের নির্বাচনে হাতেমের হস্তক্ষেপ ছিল বলে অনেক ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন। সরকার পতনের পরও গোটা ফতুল্লায় ঝুট ব্যবসার প্রচ্ছন্ন নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করেন হাতেম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন জানান, বিসিক এলাকায় ঝুট ব্যবসা করতে গেলে প্রথম অনুমোদন নিতে হয় হাতেমের। বিসিক এলাকায় ঝুট নিয়ে যেসকল অসন্তোষ শোনা যায় এরপেছনে হাতেমকেই দায়ী করেন তারা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত দুই যুগের বেশি সময় ধরে ওসমানদের ছায়া হিসেবে কাজ করেছেন মোহাম্মদ হাতেম। স্বৈরশাসক ও ফ্যাসিস্টের পতন হয়েছে ঠিকই কিন্তু ওসমানদের ছায়ামুক্ত হতে পারেনি বিকেএমইএ।
অবশ্য জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন এক বক্তব্যে মোহাম্মদ হাতেমের নাম প্রকাশ্যেই বলেছেন। চলতি মাসের ১ নভেম্বর বিকেলে সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী এলাকায় এম ডব্লিউ স্কুল এন্ড কলেজ প্রাঙ্গনে মাদক-চাঁদাবাজী-সন্ত্রাস রোধে বিএনপি আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন বলেন, ‘অনেকেই জোহা পরিবারের চামচামি করে রাজনীতি করেছেন, আপনারা কি আদৌ স্বপ্ন দেখছেন যে সেই পরিবারকে নিয়ে আবারো রাজনীতি আসবে, কখনোই না। এই পরিবারের দুইটা সন্তান ছিল আজমিরী এবং অয়ন ওসমান। তারা কিন্তু কোন দলে নাম লেখায় নি। তাদের রাখা হয়েছিল সন্ত্রাসী এবং অর্থ লুটপাটের জন্য।
গিয়াসউদ্দিন ব্যবসায়ী সংগঠন প্রসঙ্গে বলেন, ওয়ান ইলেভেনের আহ্বান যে ব্যবসায়ী সংগঠন করেছিল, সেই সংগঠনের নেতৃবৃন্দরাই এদের (আজমেরী-অয়ন) সাহায্য করেছে। ওসমান পরিবারের সাথে সমস্ত মিটিং মিছিলে ছিল। আজ তারা ভিন্ন বেশে সমাজে আসতে চায়, এতটা সহজ নয়। অনেকদিন খেলাধুলা করেছেন কিন্তু এখন বিপ্লব হয়েছে, এখন খেলাধুলা করতে এসে লাফ দিলে আপনার হাড়গোড় ভেঙ্গে যাবে। এখানে যে বিকেএমইএ সংগঠন আছে, সেখানকার সাবেক সভাপতি (সেলিম ওসমান) পালিয়ে গেছে। কিন্তু সহ সভাপতি মো. হাতেম এখন ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে। এই হাতেম স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার প্রধান দোসর। তার বক্তব্য, বিবৃতি সব আছে। আপনারা বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন।
বিএনপি নেতাকর্মীদের ব্যবসা দিয়ে নিজেদের মধ্যে কোন্দল সৃষ্টি করছেন, মনে রাখবেন বিএনপির সবাইকে একসাথে করে ফেললেও গিয়াস উদ্দিনের মাথা গিলতে পারবেন না। আপনাদের ছাড় দেওয়া হবে না, অবিলম্বে এই কমিটি ভেঙে দিয়ে যারা ভালো নিরীহ তাদের দ্বারা কমিটি গঠন করতে হবে। এই কমিটি থাকলে বিএনপি বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আমার আহ্বান থাকবে এই সমস্ত দালালদের বিতাড়িত করে আপনারা নতুন কমিটি গঠন করেন।’
এবিষয়ে কথা বলতে বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যানি।
সম্প্রতি হাতেমের উপর অনাস্থা জ্ঞাপন করে বিকেএমইএ’র পরিচালনা পর্ষদ থেকে দুইজনের পদত্যাগ এবং আরো বেশ কয়েকজনের পদত্যাগের গুঞ্জন ওসমান পরিবার ঘনিষ্ঠ হাতেম এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের বিদায়ের ঘন্টা ত্বরান্বিত করলো।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর থেকে বিকেএমইএর সভাপতির পদে ছিলেন সেলিম ওসমান। সর্বশেষ ২০১২ সালে ভোটের মাধ্যমে সভাপতি হন তিনি। তারপর ২০১৪, ২০১৬, ২০১৯, ২০২১ ও ২০২৩ সালে সমঝোতার মাধ্যমে পর্ষদ করে সভাপতি হন সেলিম ওসমান। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনে পর ২৫ আগস্ট এক প্রেসবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বিকেএমএ’র নতুন সভাপতি হন বলে জানানো হয়।