বৃহস্পতিবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪   অগ্রাহায়ণ ২১ ১৪৩১   ০৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

দোকানে মালামাল ফুটপাতে চালান, চাঁদাবাজি তিনগুন

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ০৫:৫০ পিএম, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪ বুধবার

গত ২৫ নভেম্বর, সোমবার দৈনিক যুগের চিন্তা পত্রিকায় হকারদের কারণে ফুটপাথে নানা সমস্যা এবং তাদের উচ্ছেদের বিষয়ে “বৈধ-অবৈধ মিলিয়েই আমাদের দেশ” এমন হেডিং এ একটি নিউজ হয়। যাতে উল্লেখ ছিল ফুটপাথের হকারদের পসরার ফলে ফুটপাতে সৃষ্টি হচ্ছে মানবজট এবং ফুটপাথ উপচে পড়ে হকারদের পসরা সড়কে চলে গিয়ে সেখানেও সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। এতে করে আমজনতার দূর্ভোগ চরমে। তাদের ৫ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করতে ৩০ মিনিট বা তার চেয়েও অধিক সময় অপচয় হয়। ফলে সময়ের কাজ অসময়ে করতে বাধ্য হন তারা। সূত্র জানিয়েছে, গত ৫ আগস্টের পর থেকে হঠাৎ করে নগরীর সড়কগুলোর ফুটপাতে হকারের সংখ্যা বেড়ে গেছে। মার্কেটগুলোর সামনে ফুটপাতে তো হকাররা বসছেই, রাস্তার মধ্যেও দুই লেয়ারে টুল, চৌকি, ভ্যানে মালামালের পসড়া সাজিয়ে বসেছেন। সূত্র জানিয়েছে, আসলে শহরের বিভিন্ন নামীদামি দোকানের মালামালও ফুটপাতে বিক্রি করছেন দোকানদারা। সূত্র জানায়, বিভিন্ন মার্কেটের নামকরা দোকানগুলোর কর্তাব্যক্তিরা তাদের দোকানের কর্মচারীদের ফুটপাতে দোকান নিয়ে বসতে বাধ্য করছেন। 

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকটি মার্কেটের কর্মচারীরা জানান, ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন মার্কেটের দোকানমালিকরা বাড়তি কর্মচারী নিয়োগ করে টুল-টেবিল ও ভ্যান দিয়ে দোকানের মালামাল ফুটপাত, সড়কের দুইপাশের দুইটি লেয়ার করে মানুষের কাছে বিক্রি করছেন। এতে সরু সড়ক ও ফুটপাতে পথচারী চলাচল, যানবাহন চলাচল দূরুহ হয়ে পড়েছে। আর ফুটপাতে দোকানের সংখ্যা তিনগুন হয়ে যাওয়ায় ফুটপাতের হকার থেকে চাঁদাবাজির টাকার অঙ্কও তিনগুন বেড়েছে। প্রশাসন, রাজনীতিক ব্যক্তিরা বিষয়টি বুঝতে পেরেও আমলে নেননি। ফলে শহর এলাকায় যানজট নিরসন ও পথচারী চলাচল দূরুহ হয়ে পড়েছে।  


সড়কে চলাচল করা কয়েকজন কাভার্ড ভ্যান চালক, বাস-চালক, ট্যাক্সি-চালকরা বলেন আগে আমরা দেখতাম হকাররা ফুটপাত দখল করে তাদের ব্যবসা চালাচ্ছে। সবসময়ই চাষাড়া হয়ে কালিরবাজার যাওয়ার সময় দেখতাম ফুটপাতগুলোতে উপচে পড়া ভীড়। কয়দিন আগে তো তারা তেমন কোনো ঝামেলাও করতে পারতো না। কারণ জেলা প্রশাসক, ওসমান পরিবার,  মেয়র আইভী তারা সবাই এই হকারদের উচ্ছেদ করতে একমত ছিলেন। কিন্তু ৫ই আগস্ট-এ তারা পালানোর সাথে সাথে আমরা স্বাধীন হলাম। যার একটা খারাপ প্রভাব পড়লো বাজারঘাট, রাস্তাঘাট, ফুটপাতসহ সবখানে। আসলে দেশ স্বাধীন হইছে কিন্তু অপরাধীরা ভাবতাছে, তাদের সকল অপরাধ স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে করার লাইসেন্স পেয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠলেই প্রতিদিন কোনো না কোনো ঝামেলা দেখি। সব ঝামেলার মধ্যে ফুটপাত দখলও একটা ঝামেলা কিন্তু তার থেকেও বড় ঝামেলা হচ্ছে হকাররা রাস্তায় এসে পড়ে। এমনেই তো ঘন্টার পর ঘন্টা যায়গা শহরের জ্যাম ঠেইল্লা হাইওয়েতে যাইতে। তার মধ্যে এই হকাররা ফুটপাত ভইরা আইসা পড়ে রাস্তায়। সমস্যা ভাই আসলেই হকাররা সমস্যা। আমার মনে হয় কি জানেন ভাই এরা অবশ্যই কাউকে চান্দা দেয় নয়তো এমনে বুক ফুলাইয়া ফুটপাত ভইরা রাস্তায় আইসা পড়ে কেমনে। এদের কিছু বলাও যায়না। বলতে গেলেই এদের সিন্ডিকেট আইসা ঝামেলা করে। পরের গাড়ি কিছু একটা ঘটলে পরে এই খেসারত আমার উপর দিয়ে যাবে ভেবে ওদের কিছু বলি না। তবে হঠাৎ করে এতো হকার কই থাইকা আইলো। এতো হকার তো আগে আছিল না। মনে হয় এইখানে কোন সমস্যা আছে!  


প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত জেলা নারায়ণগঞ্জ। সুন্দর এই জেলাটির সড়কে থাকে যানজট, ফুটপাথে থাকে মানবজট। যা সৃষ্টি করার পিছনে রয়েছে অবৈধ হকার শ্রেণি এবং অবৈধ অটো-মিশুক চালকদের হাত। ফুটপাথ দখলের পাশাপাশি হকাররা ভ্যান বা ছোট গাড়ি নিয়ে সড়কও দখল করছে। এভাবে চলতে থাকলে যানজট নিরসনের চেষ্টা বৃথা যাবে। সকল জেলার মত এই জেলাতেও যানবাহন চলাচলের জন্য সড়ক এবং তার পাশে পথিকদের যাতায়াতের জন্য ফুটপাত বিদ্যমান। কিন্তু জীবিকা নির্বাহের ছুতায় হকাররা অবৈধভাবে দখল করে রাখছে ফুটপাথ। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা-রাত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সড়ক, নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা সড়কে আসলেই দেখা মিলে হকারদের অবৈধ স্থাপনার, যা উপচে পড়ে খানিকটা সড়কেও চলে এসেছে। এতে করে সড়কে সৃষ্টি হচ্ছে যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে ভয়ানক যানজট। হাঁটতে গিয়ে অনেকেই প্রয়োজনীয় খুটি-নাটি ক্রয় করতে জমে দাড়ান ফুটপাথে থাকা অবৈধ এই হকারদের সাজানো পসরায়। এই জমে দাড়ানোর ফলে সৃষ্টি হয় চলাচলের প্রতিবন্ধকতার। তার পিছনে বাধ্য হয়ে জমে দাড়ায় লম্বা মানবের লাইন। ফলে সৃষ্টি হয় ফুটপাথে মানবজটের।

 ফুটপাথ জুড়ে রয়েছে হরেক রকমের রং-বেরংয়ের হকারদের অদ্ভুত সমারোহ সরকার যদিও রাস্তার পাশের ফুটপাতকে জনসাধারনের হাঁটাচলার কাজে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে বানিয়েছেন। বড় শপিংমল-গুলোর বড় দামদর থেকে বাঁচতে মানুষ ভীড় জমায় ফুটপাথে থাকা সহজলভ্য পন্য ক্রয় করতে। ফলে গোটা ফুটপাত জুড়ে থাকে মানবজট। এসকল হকাররা অধিকাংশই বিভিন্ন হামলা মামলার সময় উপস্থিত আসামী। জেল জরিমানার পর শেষ ঠাঁই হিসেবে ভাইদের হাতে পায়ে ধরে ক্ষুদ্র পরিসরে মালামাল এনে ফুটপাতে বসেন। তারা কাস্টোমারদের কে মিথ্যা নাটকে চোর বানান। পিটান এবং মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন। এছাড়াও মহিলারা সহ্য করেন অবাঞ্চিত, অশালীন, অকথ্য ভাষা যার প্রতিবাদ করতে গেলে তাদের শুনতে হয় আরো অকথ্য ভাষার ব্যবহার। দুই নম্বর পন্য, আরেক জনের গায়ে পড়ে ঝগড়া সহ বিভিন্ন ভয়ানক অবৈধ উপায়ে করেন ব্যবসা। অসহ্যকর ভোগান্তিতে ভুগতে হয় আমজনতার। এছাড়াও চোর -ছিনতাইকারীদের আনাগোনাও বেশি থাকে এই মানবজটে। তারা তাদের শিকারের সন্ধান পায় এই মানবজটে। পথচারীর মূল্যবান বস্তু মুক্ত হাতে ছোঁ মেরে ভোঁ দৌড় দেয় শিকারীরা। পথচারী অপলক দৃষ্টি-তে তাকিয়ে থেকে চিৎকার দেয়। যা বাতাসে মিলিয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড এর মধ্যেই পরিস্থিতি ঠান্ডা।


ফুটপাত দখলে কে বা কারা এই হকারদের স্বাধীনভাবে অবৈধ ব্যবসা করার সুযোগ দিচ্ছে?  এমন প্রশ্নে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন হকার বলেন, এখন ভাই কাউরে কিছু দেয়া লাগে না। আমরা স্বাধীন। স্বাধীনভাবে ব্যবসা করি। বিএনপির কিছু নামকরা নেতা চান্দা চাইতে আসে। তারা বলেন তোরা টাকা দে, দোকান কেডায় উঠায় ওইটা আমরা দেখমুনে। কয়েকজন দেয় হয়তো, কিন্তু আমরা দেই না। এই কারণে তারা হয়তো একটু রাগ আমাদের উপর। কিন্তু আমার কথা হইলো এহনো যদি টাকা দিয়ে ব্যবসা করা লাগে তাহলে তো আর স্বাধীন হইতে পারলাম না।


আপনাদের এই দোকানগুলোর জন্য পথচারীদের হাঁটতে অসুবিধা হয় তারা আপনাদের কারণে ফুটপাথে সৃষ্ট মানবজটকে এড়িয়ে চলার জন্য সড়কে চলে যান তাতে সড়কেও সৃষ্ট হয় যানজটের! এককথায় বলতে গেলে আপনাদের এই দোকানগুলোর জন্য আমজনতার ভোগান্তি যে চরমে পৌছিয়েছে এটা কি বুঝেন আপনারা? ফুটপাতে আপনাদের এই দোকানগুলো যে অবৈধ সেই ব্যাপারে জানেন আপনারা? হ্যাঁ জানি! জানলেও কিছু করার নাই দীর্ঘ কয়েক বছর যাবত এই হকারি করেই সংসার করছি। আমাদের উচ্ছেদ করার অভিযান কয়েকমাস আগেও হয়েছে। তখন সেলিম ওসমান আমাদের কাছে ভোটার আইডি কার্ড চেয়েছিলেন। অনেকেই দিতে পারে নি কারণ তারা এই জেলার না। অধিকাংশই বাহিরের। তাদের জন্য আমারাও ব্যবসা করতে পারি না। ৫-ই আগস্টের পরে এহন আর কোনো বৈষম্য নাই তাই আবারও সবাই ফুটপাথে দোকান দিয়েছে। আর ভাই পথচারীরা ক্রয় না করলেই তো আর আমগো দরকার পরে না। তারা আমাদের থেকে পণ্য ক্রয় করে বলেই আমরা দোকান দেই। যাগো পেটে আল্লাহ অন্যভাবে ভাত আসার সুযোগ করে দেয়। তারা আমাদের কষ্ট কখনো বুঝবে না। তারা আমগো অবৈধ বলুক বা বৈধ তা আমাদের দেখার সাবজেক্ট না। বৈধ অবৈধ মিলাইয়াই আমগো বাংলাদেশ। আমি আমার সাথে থাকা আরও কয়েকজন আছেন যার চান্দা দেই না। কিন্তু যারা হুমকি ধামকি ভয় পায় তারা এখনো চাঁন্দা দেয়, কিন্তু কারে দেয় এইটা বলতে পারমু না। ঝামেলা আছে।


ফুটপাত এ থাকা হকারদের জন্য কোনো সমস্যায় ভুগছেন কি? ফুটপাথে চলাচলকারী কয়েকজন পথিককে এমন প্রশ্ন করলে তারা বলেন, সমস্যা তো দেশের প্রত্যেকটা জায়গাতেই আছে। একটা সমাধান করলে আরেকটা বের হয়। তবে ফুটপাথের জন্য প্রতিদিন আমার দেড়-দুই ঘন্টা চাষাড়া থেকে ডিআইটি আসা যাওয়া করতেই নষ্ট হয়ে যায়। গত দুই সপ্তাহ আগে নূর মসজিদের সামনে থেকে আমার মানিব্যাগ উধাও হয়ে যায়, মানে গায়েব হয়ে যায়। আরেক জন বলেন তার মোবাইল নিয়ে যায় পিছনের পকেট ব্লেড দিয়ে কেটে। কারও খোয়া যায় কানের দুল তো কারও গলার চেইন। সবমিলিয়ে ফুটপাত কমদামে ব্রান্ডের কপি জিনিস বিক্রি করে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের আংশিক চাহিদা মেটাতে পারলেও মানবজটের ফলে আমজনতার ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও তারা ফুটপাত উপচে সড়কে চলে যাওয়ায় সেখানেও সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা। ফলে সড়কে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট।