বুধবার   ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ৪ ১৪৩১   ১৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ঝুট ব্যবসায়ী হাতেমের ভূমিদস্যুতায় দখল কাশিপুরের ‘মরা খাল’

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ১০:৫৯ এএম, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ বৃহস্পতিবার

ওসমানদের দোসর হিসেবে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর সেলিম ওসমানের পদত্যাগপত্রের প্রেসক্রিপশনে শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন বিকেএমইএ’র সভাপতি পদ দখল করেন ঝুট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাতেম। ওসমানদের ছত্রছায়ায় মোহাম্মদ হাতেম বিসিক এলাকার বহু ব্যবসায়ীকে ব্যবসা ছেড়ে যেতে বাধ্য করে। একদিকে ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, আরেকদিকে জমি ব্যবসায় রমরমা সিন্ডিকেট গড়ে তোলে হাতেম। ওসমান পরিবারের প্রত্যক্ষ ঠিকাদার হিসেবে কাজ করতেন হাতেম। একদিকে সেলিম ওসমান, শামীম ওসমান এবং অয়ন ওসমানের নিয়ন্ত্রিত বাহিনীকে ঝুট বিতরণ করতেন, অপরদিকে আজমেরী ওসমানের সাথে সখ্যতা রেখে তার ক্যাডারবাহিনীর মাধ্যমেও ফ্যাক্টরির ঝুট নিয়ন্ত্রণ করতেন। তবে শুধু ঝুট নয়, বিসিক এলাকায় বিচার-শালিশের নামে ব্যবসায়ীদের উপর নানা অত্যাচারের কথা এখন সেখানকার মানুষের মুখে মুখে। শুধু তাই নয়, হাতেমের কথার নড়চড় হলেই ব্যবসায়ীদের উপর অত্যাচারের খড়্গ নেমে আসতো। বিসিক, কাশিপুর, এনায়েতনগর এলাকায় বিশাল ভূমিদস্যুদের সিন্ডিকেট গড়ে তোলে ওসমানরা। এর প্রধান নিয়ন্ত্রক ও ছিলো হাতেম। ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাইফুল্লাহ বাদলের ভূমিদস্যু সিন্ডিকেটের সাথে হাতেমের ভূমিদস্যু সিন্ডিকেট একত্রিত হয়ে গ্রাস করতো মানুষের জমি। এমনকি বাদ যায়নি সরকারি খালও। মোহাম্মদ হাতেমের সকল অপকর্মের মূল সহযোগী ছিল কাশিপুর ভোলাইল এলাকার শহরআলী মাদবরের ছেলে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হাসান। নানা সময় জমি দখলের সময় হাসানকে হাতেম নিজের ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতেন। সূত্র জানিয়েছে, ঝুট ব্যবসায়ী হাতেম ও আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুল্লাহ বাদলের সিন্ডিকেট একত্রিত হয়ে বিসিক সংলগ্ন কাশিপুর ৩নং ওয়ার্ডের ‘মরা খাল’ ভূমিদস্যুতায় গিলে খেয়েছেন।  

সূত্র জানিয়েছে, নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নটি হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিয়ন। বিগত আওয়ামীলীগ সরকার আমলে এই ইউনিয়নে খুন, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, লুটপাট, ভূমিদস্যুতা সহ বিভিন্ন অপকর্ম করা হতো। আর এই ইউনিয়নের সকল অপকর্মের মূলহোতা ছিলেন কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগের সভাপতি এম.সাইফুল্লাহ বাদল। বিগত আওয়ামীলীগ সরকার আমলে সাইফুল্লাহ বাদল তার বাহিনীদের দিয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ড ও মহল্লাগুলোতে দখলবাজি, চাঁদাবাজি, লুটপাটসহ বিভিন্ন অপকর্ম করাতেন। বিভিন্ন ওয়ার্ডে বিভিন্ন কর্মীদের দায়িত্ব দিয়ে এসকল কাজ করাতেন এম.সাইফুল্লাহ বাদল। ঠিক তেমনই কাশিপুর ভোলাইল এলাকার শহরআলী মাদবরের ছেলে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হাসান’কে দিয়ে জমি দখল, চাঁদাবাজি, লুটপাট সহ বিভিন্ন অপকর্ম করাতেন সাইফুল্লাহ বাদল ও ঝুটব্যবসায়ী হাতেম। সন্ত্রাসী হাসান বিগত সরকার আমলে সাইফুল্লাহ বাদল ও আজমেরী ওসমানের ক্যাডার হিসেবে ভোলাইল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতো। কিন্তু গত ৫ আগস্ট আওয়ামীলীগ সরকার পদত্যাগের পর থেকে সেই সন্ত্রাসী হাসান এখন নব-বিএনপির সেজে আবারও ভোলাইল এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করছে। যেটির মূল পরিকল্পনাকারীও এই ওসমানদের দোসর হাতেম। জানা যায়, সন্ত্রাসী হাসান জমির দালাল ও মুদি দোকানদার ছিলেন। বিগত সরকারের আমলে কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুল্লাহ বাদল, বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, কাশিপুর ৩নং ওয়ার্ডের মেম্বার শামীম আহমেদ, কাশিপুর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেক লীগের সভাপতি আল-আমিন ও সাইফুল্লাহ বাদলের বোন জামাতা সানাউল্লাহসহ আরও কয়েকজন মিলে হাসানের সহযোগিতায় ভোলাইল ‘মরা খাল’ ( ভোলাইল মিষ্টির দোকানের পেছনে) ১৭০নং কাশিপুর মৌজার ১নং সিট এর সরকারি জায়গাটি দখল করে এন-আর গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেয়। জানা যায়, এন-আর গ্রপের কাছে সরকারি খালে জায়গাটি হাসানের মাধ্যমে তিন কোটি টাকা বিক্রি করা হয়। সেই সময় এন-আর গ্রুপ সরকারি খালের জন্য দেড় কোটি টাকা হাসানের মাধ্যমে লেনদেন করেন এবং পরে জায়গার কাগজ পত্র হলে আরও দেড় কোটি টাকা দিবে বলেন জানান। এদিয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, উত্তর নরসিংপুর মরা খালপাড় এখন সরু ড্রেনে পরিণত হয়েছে। খালের চারপাশে দেয়াল দিয়ে দখলে নিয়েছে এন-আর গ্রুপ। মূলত এই গোটা দখলে নেতৃত্ব দিয়েছে ওসমানদের দোসর ঝুট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাতেম।

এবিষয়ে এলাকাবাসী জানান, এটা একটা পুরাতন খাল, এখান দিয়ে এক সময় নৌকা-ট্রলার চলাচল করতো। কিন্তু দুই বছর আগে বাদল চেয়ারম্যান ও মোহাম্মদ হাতেম ও তার পালিত সন্ত্রাসী হাসানের মাধ্যমে এই খালটি এন-আর গ্রুপ দখল করে। আমরা এলাকাবাসী চেয়েছিলাম এখানে একটি কবরস্থান হবে। কিন্তু কবরস্থানে জন্য অল্প কিছু জায়গা দিয়ে খালের পুরো জমি দখল দিয়েছে এন-আর গ্রুপ। এখানে প্রায় ৩৫ শতাংশ দখলে আছে। আরও দখল করার চেষ্টা চলছে। আমাদের অনেকের বাড়ি-ঘরও এই হাতেমের ক্যাডার দালাল হাসান জোর করে এন-আর গ্রপের কাছে বিক্রি করে দেয়। এই হাসান বিসিকের মোহাম্মদ হাতেম এর লোক, এই খালটি বিক্রির সময় এন-আর গ্রপের সাথে হাতেমও সরাসারি ওসমানদের পক্ষ হয়ে উপস্থিত ছিলো। হাতেম ও সাইফুল্লাহ বাদল হাসানের মাধ্যমে এই জায়গা বিক্রির লেনদেন করেন। প্রথম ১৬ শতাংশ খাল দখলে নেয় পরে ৩৫ শতাংশ দখল করে। বর্তমানে সাইফুল্লাহ বাদল সহ আওয়ামীলীগের যারা এই জায়গার সাথে জড়িত ছিলো তারা পালিয়ে গিয়েছে এবং শুধু হাতেম  ও হাসান আছে। তাদেরকে আইনের আওতায় আনলে পাওয়া যাবে এই সরকারি খাল তারা কিভাবে বিক্রি করলো। সব লেনদেন হাতেমের ভূমিদস্যুতার ম্যানেজার খ্যাত হাসানের মাধ্যমে করলেও মূলত এরমূলে ছিলেন হাতেম ও সাইফুল্লাহ বাদল।  

প্রসঙ্গত, ওসমানদের দোসর মোহাম্মদ হাতেম  ও বিকেএমইএ’র বর্তমান পর্ষদের বিরুদ্ধে অন্তবর্তীকালীন সরকারের  বাণিজ্য উপদেষ্টা, ও সচিব বরাবর অভিযোগ দায়ের করেছেন বৈষম্যর শিকার বিকেএমইএ এর সাধারণ ব্যবসায়ীরা।

অভিযোগপত্রে ব্যবসায়ীরা উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) দেশের নিটওয়্যার প্রস্তুতকারকদের একটি জাতীয় বাণিজ্য সংস্থা। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প সম্প্রসারণকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্বেও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনামলে সংগঠনটির নেতৃবৃন্দরা তাদের কার্যকলাপের জন্য সবসময়েই ছিলেন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। ২০১০ সাল থেকে টানা ১৪ বছর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সভাপতির পদ আঁকড়ে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান। প্রথমবার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে নামকাওয়াস্তে কয়েকটি নির্বাচন হলেও পরবর্তীতে তথাকথিত সমঝোতা'র মাধ্যমে পর্ষদ করে নিজের অনুগতদের নিয়ে সংগঠন পরিচালনা করেছেন। বিকেএমএই তে সব কিছুই চলতো সেলিম ওসমানের নির্দেশনা অনুযায়ী। এমনকি কে কোন পদে থাকবেন সেটাও নির্ধারণ করে দিতেন তিনি। ৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের পর গত ২৪ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে সভাপতির পদ থেকে সেলিম ওসমান পদত্যাগ করেন। তবে তিনি কমিটি পুনর্গঠন করার ঘোষণা না দিয়ে নতুন সভাপতি নির্বাচন করেন এবং তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে পর্ষদকে অনুরোধ করেন যা এই ধরনের নেতৃস্থানীয় সংগঠনটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সেলিম ওসমান তার পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেন, 'বর্তমান নির্বাহী সভাপতি হাতেম দীর্ঘদিন ধরে আমাকে, বিকেএমইকে ও নিট সেক্টরের উন্নতির জন্য সহায়তা করে গেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমি পরিচালনা পর্ষদের সকলের কাছে অনুরোধ রাখতে চাই, আমার বিদায়ের পর পর বিকেএমইএ ও নিট সেক্টরের উন্নয়নকল্পে মোহাম্মদ হাতেম এর অবদান এবং প্রচেষ্টার কথা স্মরণ করে তাকে এই নতুন বিকেএমইএ পরিচালনার জন্য সভাপতির দায়িত্বভার অর্পণ করা হোক (সংযুক্তি দ্রষ্টব্য) অনুগত পর্ষদও বিনা বাক্যব্যয়ে তার কথা মেনে নিয়েছেন এবং মোহাম্মদ হাতেমকে সভাপতি, সাবেক স্বৈর-শাসকের দোসর সেলিম ওসমানের অনুগতদের নিয়েই গঠিত হয়েছে প্রহসনের বর্তমান পর্ষদ।

উল্লেখ্য, মোহাম্মদ হাতেম বিগত তিন বছর যাবত নির্বাহী সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাকে সুযোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে তৈরি করার লক্ষ্যে ২০২১ সালে নির্বাহী সভাপতির একটি নতুন পদ সৃষ্টি করে সেখানে তাকে বসান সেলিম ওসমান। বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলের পুরোটাই সেলিম ওসমানের অনুগত থেকে মোহাম্মদ হাতেমও পুরোপুরি ক্ষমতার সদ্বব্যবহার করেছেন। তিনি সরকারের কতটা আজ্ঞাবহ সর্বশেষ তার প্রমাণ দিয়েছেন গত ২২ জুলাই।

সেদিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেশের ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বৈঠক করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বৈঠকে বিকেএমইর তৎকালীন নির্বাহী সভাপতি (বর্তমান সভাপতি) মো. হাতেম বলেন, 'এরকম একটি সঙ্কটকালে আমরা এমন সিচুয়েশন দেখবো সেটা আশা করিনি। যে তান্ডব আমরা গত কয়েক দিনে দেখেছি, আমরা আশা করব, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্য যারা আছেন, তারা তা উদ্ঘাটন করবেন এবং আইনের আওতায় আনবেন। আমরা সরকারের পাশে সবসময়ই ছিলাম, এখনো আছি, ভবিষ্যতেও থাকবো।