নিজেকে বাঁচাতে সমন্বয়কদের পেছনে ছুটছেন হাতেম
যুগের চিন্তা রিপোর্ট
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ১০:০৩ এএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪ শুক্রবার
৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের বিদায়ের পর ওসমানদের দোসর মোহাম্মদ হাতেম সাবেক সাংসদ সেলিম ওসমানের প্রেসক্রিপশনে বিকেএমইএ’র সভাপতি চেয়ারে বসেছেন এটি সেলিম ওসমানের পদত্যাগপত্রেই পরিষ্কার হয়েছে। হাতেমকে বিকেএমইএ’র মতো গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের শীর্ষ পদ থেকে অপসারণের দাবিতে ইতিমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিব বরাবর অভিযোগ করেছেন গত ১৬ বছর বৈষম্যের শিকার বিকেএমইএ’র ব্যবসায়ীরা। এরপর থেকে নিজের চেয়ার বাঁচাতে নানা জায়গায় ছুটছেন মোহাম্মদ হাতেম। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ ঢেলে নিজের চেয়ার বাঁচানোর জন্য ধর্না দিয়েছেন। তবে ব্যবসায়ীদের অভিযোগের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আমলে নিয়ে সকল তথ্য যাচাই-বাঁছাই করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ওসমান পরিবারের সাথে হাতেমের দীর্ঘদিনের সখ্যতা, সেলিম ওসমানের পদত্যাগের চিঠিতে হাতেমকে উত্তরসূরি হিসেবে বিকেএমইএ’র সভাপতি হিসেবে বসানো, ওসমানদের শেল্টারে বিসিক এলাকায় ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, বিসিক সংলগ্ন এলাকায় ভূমিদস্যুতা, ওসমান পরিবারর ক্ষমতায় ব্যবসায়ীদের নিকট চাঁদাবাজি, ব্যবসায়ীদের চাপে ফেলে বিচার সালিশের নামে বিপদে ফেলে অর্থ আদায়সহ আরো বেশকিছু গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছে সূত্র। সকল ধরণের স্ট্যান্টবাজি খোলাসা হয়ে যাওয়ায় এবার হন্য হয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতাদের পিছু ছুটছেন হাতেম। নানাজনকে ধরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের নেতাদের মাধ্যমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তদ্বির করানোর অপচেষ্টা করছেন। এই কাজে হাতেমের দুই ছেলের মধ্যে বড় হাসিন আরমান অয়ন এবং ছোট ছেলে হাসিন রিয়ান অনিককেও ব্যবহার করছেন।
অতীতে এই দুইজন ওসমান পরিবারসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে সেল্ফিবাজিতে ব্যস্ত থাকলেও এখন পিতার সংগঠনের চেয়ার বাঁচাতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সাইবার যোদ্ধা হিসেবে স্ট্যান্টবাজি করছেন। তারাও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে বাবার চেয়ার বাঁচাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তদ্বির করানোর অপচেষ্টা করছে বলে জানিয়ে সূত্র। তবে ২২ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের বাসভবনে গিয়ে হাতেমের দেয়া বক্তব্য সারা দেশে ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা হাতেমসহ তার দুই ছেলের স্ট্যান্টবাজির বিষয়টি ধরতে পেরেছেন। নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপি, মহানগর বিএনপি, নারায়ণগঞ্জ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ, ইসলামী আন্দোলন, গণসংহতিসহ নারায়ণগঞ্জের সর্বস্তরের বিশিষ্টজনেরাও ৫ আগস্টের পর হাতেম যে স্ট্যান্টবাজি চালু করেছিলো সেটি বুঝতে পেরে ওসমানদের দোসর হাতেমকে অপসারণের পক্ষে মতামত দিয়েছেন। বিকেএমইএর বেশিরভাগ সদস্যই হাতেমের দ্রুত অপসারণ চান। এদিকে হাতেমের ভূমিদস্যুতার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে বিসিক এলাকার স্থানীয় জনগণ। ঝুট ব্যবসা নিয়ে বিরোধ লাগিয়ে সংঘর্ষ বাধানোর হীন যে পরিকল্পনা হাতেম নীলনকশায় করেছিলো সেটি নিয়েও ত্যক্ত বিরক্ত ব্যবসায়ীরা। তারা এমন কুঠিল লোকের পদত্যাগে দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। সবাই প্রত্যাশা করছেন অতি দ্রুত হাতেমকে অপসারণ করে ওসমান প্রভাবমুক্ত হবে বিকেএমইএ।
প্রসঙ্গত, ছাত্রজনতার গণআন্দোলনে ফ্যাসিস্টদের বিদায়ের পর আবার ফ্যাসিস্ট সরকারের ব্যক্তির প্রেসক্রিপশনে বিনা নির্বাচনে তাদেরই দোসর মোহাম্মদ হাতেমকেই সভাপতি বানানো হয়েছে। এখনো পুরো বিকেএমইএ’র পর্ষদে হাতেম ছাড়াও ওসমানদের আরো দোসররা বর্তমান। ৫ আগস্টের পর থেকেই নানা স্ট্যান্টবাজিতে ব্যস্ত ছিলেন হাতেম। সর্বশেষ এই অসন্তোষ নিয়েই অনুষ্ঠিত ৫ ডিসেম্বর বিকেএমইএ’র বিশেষ সাধারণ সভাতেও (ইজিএম) হাতেমের স্ট্যান্টবাজিতে ত্যক্ত-বিরক্ত বিকেএমইএ’র সদস্যরা। ঢাকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্র্যান্ডবলরুমে বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত এই ইজিএমে প্রায় ১৫০জন সদস্য অংশগ্রহণ করলেও বেশিরভাগ টেবিলেই হাতেমকে নিয়ে জোর সমালোচনা চলে। উপস্থিত ব্যবসায়ীরা হাতেমের স্ট্যান্টবাজিতে হতবাক ও বিস্মিত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ইজিএম অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ হাতেম বারবার ঘোষণা করতে থাকেন বিকেএমইএর এই অনুষ্ঠানে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের দুই প্রধান সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ উপস্থিত থাকবেন। অনুষ্ঠান শুরুর পর থেকে তিনি বলেই যাচ্ছেন এই তো তারা চলেই আসছেন। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা উপস্থিত হবেন। এই তো তারা লিফটের উঠার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এই তো তারা এক্ষুনি চলে আসবেন। কিন্তু আদতে শেষ পর্যন্ত তাদের কেউই বিকেএমইএ’র এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হননি। বারবার এই স্ট্যান্টবাজির অর্থ ছিল, হাতেম বোঝাতে চেয়েছেন, তার সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের নেতাদের গভীর সম্পর্ক। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যবসায়ীদের এই অনুষ্ঠানে তো তাদের আসারই কথা না। কিন্তু হাতেম এটি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন তিনি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেও কাছের লোক। অথচ তিনি যে, শেখ হাসিনা সরকার ও ওসমানদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ তা তো ভিডিও বক্তব্য ও পত্রিকার পাতায় স্পষ্ট প্রমাণ আছে। সারাদেশের মানুষ যে তার অতীত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানে সেটি তিনি ভুলেই গেছেন, আর ব্যবসায়ীরা তো খুব ভালো করেই জানেন হাতেম গত ১৫ বছর যাবৎ ওসমানদের হয়ে কী কী করেছেন। অনেকে টিপ্পনী কেটে কানাঘুষো করেন, কে বসালো হাতেমকে সভাপতির পদে নির্বাচন ছাড়া! তিনি ৫ আগস্টের পর কী করে হর্তাকর্তা বনে গেলেন। আর তার এই কমিটিতে তো অনেক ওসমানীয় বলয়ের লোকে ভরপুর। তিনিও তাদের মধ্যে অন্যতম।
২০১০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর থেকে বিকেএমইএর সভাপতির পদে ছিলেন সেলিম ওসমান। সর্বশেষ ২০১২ সালে ভোটের মাধ্যমে সভাপতি হন তিনি। তারপর ২০১৪, ২০১৬, ২০১৯, ২০২১ ও ২০২৩ সালে সমঝোতার মাধ্যমে পর্ষদ করে সভাপতি হন সেলিম ওসমান। কিছুদিন আগে বিলুপ্ত জাতীয় সংসদে তিনি নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সদস্য ছিলেন। তাঁর ভাই শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন। বিকেএমইএতে প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের কারণে টানা পাঁচবার সমঝোতার মাধ্যমে পর্ষদ গঠন করা হলেও সংগঠনের উদ্যোক্তারা চুপচাপ ছিলেন। ৫ আগস্টের পর ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর ২৫ আগস্ট অসুস্থতার কথা বলে পদত্যাগ করেন সেলিম ওসমান। তার স্থলাভিষিক্ত হন মোহাম্মদ হাতেম।