চতুর্মুখী চাপে ঝুট ব্যবসায়ী হাতেম
যুগের চিন্তা রিপোর্ট
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০২:৫০ পিএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ শনিবার
ওসমানদের দোসর হিসেবে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর সেলিম ওসমানের পদত্যাগপত্রের প্রেসক্রিপশনে শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন বিকেএমইএ'র সভাপতি পদ দখল করেন ঝুট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাতেম। ওসমানদের ছত্রছায়ায় মোহাম্মদ হাতেম বিসিক এলাকার বহু ব্যবসায়ীকে ব্যবসা ছেড়ে যেতে বাধ্য করে। একদিকে ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, আরেকদিকে জমি ব্যবসায় রমরমা সিন্ডিকেট গড়ে তোলে হাতেম। ওসমান পরিবারের প্রত্যক্ষ ঠিকাদার হিসেবে কাজ করতেন হাতেম। একদিকে সেলিম ওসমান, শামীম ওসমান এবং অয়ন ওসমানের নিয়ন্ত্রিত বাহিনীকে ঝুট বিতরণ করতেন, অপরদিকে আজমেরী ওসমানের সাথে সখ্যতা রেখে তার ক্যাডারবাহিনীর মাধ্যমেও ফ্যাক্টরির ঝুট নিয়ন্ত্রণ করতেন। তবে শুধু ঝুট নয়, বিসিক এলাকায় বিচার- শালিশের নামে ব্যবসায়ীদের উপর নানা অত্যাচারের কথা এখন সেখানকার মানুষের মুখে মুখে। শুধু তাই নয়, হাতেমের কথার নড়চড় হলেই ব্যবসায়ীদের উপর অত্যাচারের খড়া নেমে আসতো। বিসিক, কাশিপুর, এনায়েতনগর এলাকায় বিশাল ভূমিদস্যুদের সিন্ডিকেট গড়ে তোলে ওসমানরা। এর প্রধান নিয়ন্ত্রক ও ছিলো এই ঝুট ব্যবসায়ী হাতেম।
এদিকে ২০১০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর থেকে বিকেএমইএর সভাপতির পদে ছিলেন সেলিম ওসমান। ২০১২ সালে ভোটের মাধ্যমে সভাপতি হন তিনি। তারপর ২০১৪, ২০১৬, ২০১৯, ২০২১ ও ২০২৩ সালে সমঝোতার মাধ্যমে পর্ষদ করে সভাপতি হন সেলিম ওসমান। ৫ আগষ্ট আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর গত ২৫ আগষ্ট বিকেএমইএ’র সভাপতি হন মোহাম্মদ হাতেম। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সেলিম ওসমান বিকেএমইএ’র সভাপতি থাকলেও তার পক্ষে বিকেএমইএ’র নিয়ন্ত্রণ ছিলো মোহাম্মদ হাতেমের হাতে। শেষে তাকে নির্বাহী সভাপতি নামের একটি পদ-ও দেয়া হয় যেটি ব্যবসায়ী সংগঠনের নিয়মের মধ্যে নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ওসমানরা ও তাদের দোসররা পালিয়ে গেলেও বিকেএমইএ’র সভাপতি পদে মোহাম্মদ হাতেমের অবস্থান নিয়ে ব্যবসায়ীরা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন মহলে ব্যপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ তাকে অপসারনের দাবী জানিয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা, ও সচিব বরাবর অভিযোগ দায়ের করেছেন বৈষম্যর শিকার বিকেএমইএ এর সাধারণ ব্যবসায়ীরা। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ৫ আগষ্টের পর ভোল পাল্টে সে বিকেএমইএ’র সভাপতি হয়ে আবারো জেলার ঝুট সেক্টর নিয়ন্ত্রন করছেন। আবির্ভূত হয়েছেন ঝুট নিয়ন্ত্রক হিসেবে। ইতিমধ্যে জেলা বিএনপি, মহানগর বিএনপি, নারায়ণগঞ্জ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলনসহ নারায়ণগঞ্জ সুধীসমাজ অনতিবিলম্বে বিকেএমইএ’র সভাপতি পদ থেকে ওসমানদের দোসর ঝুট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাতেমকে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া বিসিক এলাকায় কোন ধরণের সংঘাত তৈরি হলে হাতেমকেই দায় নিতে হবে বলে প্রশাসনকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। যাকে ঘিরে বর্তমানে চতুর্মুখী চাপে রয়েছেন এই ঝুট ব্যবসায়ী হাতেম। বর্তমানে বিসিক শিল্পঅঞ্চল এলাকায় বেশ কয়েকটি গার্মেন্টস মালিক প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছেন যে হাতেমকে ঝুট দেওয়া যাবে না। বিসিক থেকে তাদের বাপ ছেলেকে বয়কট করেছে সাধারণ ব্যবসায়ীরা।
এ ছাড়া জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশিপুর ভোলাইল এলাকার শহরআলী মাদবরের ছেলে দুর্র্ধষ সন্ত্রাসী হাসান'কে দিয়ে জমি দখল, চাঁদাবাজি, লুটপাট সহ বিভিন্ন অপকর্ম করাতেন সাইফুল্লাহ বাদল ও ঝুটব্যবসায়ী হাতেম। সন্ত্রাসী হাসান বিগত সরকার আমলে সাইফুল্লাহ বাদল ও আজমেরী ওসমানের ক্যাডার হিসেবে ভোলাইল এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতো। কিন্তু গত ৫ আগস্ট আওয়ামীলীগ সরকার পদত্যাগের পর থেকে সেই সন্ত্রাসী হাসান এখন নব্য-বিএনপির সেজে আবারও ভোলাইল এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করছে। যেটির মূল পরিকল্পনাকারীও এই ওসমানদের দোসর হাতেম। জানা যায়, সন্ত্রাসী হাসান জমির দালাল ও মুদি দোকানদার ছিলেন। বিগত সরকারের আমলে কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুল্লাহ বাদল, বিকেএমইএ'র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, কাশিপুর ৩নং ওয়ার্ডের মেম্বার শামীম আহমেদ, কাশিপুর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেক লীগের সভাপতি আল-আমিন ও সাইফুল্লাহ বাদলের বোন জামাতা সানাউল্লাহসহ আরও কয়েকজন মিলে হাসানের সহযোগিতায় ভোলাইল ‘মরা খাল' ( ভোলাইল মিষ্টির দোকানের পেছনে) ১৭০নং কাশিপুর মৌজার ১নং সিট এর সরকারি জায়গাটি দখল করে এন-আর গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেয়। জানা যায়, এন-আর গ্রুপের কাছে সরকারি খালে জায়গাটি হাসানের মাধ্যমে তিন কোটি টাকা বিক্রি করা হয়। সেই সময় এন-আর গ্রুপ সরকারি খালের জন্য দেড় কোটি টাকা হাসানের মাধ্যমে লেনদেন করেন এবং পরে জায়গার কাগজ পত্র হলে আরও দেড় কোটি টাকা দিবে বলেন জানান। এদিয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, উত্তর নরসিংপুর মরা খালপাড় এখন সরু ড্রেনে পরিণত হয়েছে। খালের চারপাশে দেয়াল দিয়ে দখলে নিয়েছে এন-আর গ্রুপ। মূলত এই গোটা দখলে নেতৃত্ব দিয়েছে ওসমানদের দোসর ঝুট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাতেম। এছাড়া কাশীপুরের চর নরসিংপুর এলাকায়ম শতকে শতকে জমি তার ম্যানেজার হাসানের মাধ্যমসহ আরো কয়েকটি সিন্ডিকেটের করে জিম্মি করে রেখেছেন। যা নিয়ে হাতেমের বিরুদ্ধে শীগ্রই হতে পারে মানববন্ধন। ইতিমধ্যে হাতেমের অপকর্মের বিরুদ্ধে সজাগ হতে শুরু করেছে ব্যবসায়ীসহ জমি হারা অসহায় অনেকেই।
এদিকে ব্যবসায়ীদের অভিযোগপত্রে উল্লেখ রয়েছে, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) দেশের নিটওয়্যার প্রস্তুতকারকদের একটি জাতীয় বাণিজ্য সংস্থা। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প সম্প্রসারণকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্বেও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনামলে সংগঠনটির নেতৃবৃন্দরা তাদের কার্যকলাপের জন্য সবসময়েই ছিলেন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। ২০১০ সাল থেকে টানা ১৪ বছর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সভাপতির পদ আঁকড়ে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান। প্রথমবার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে নামকাওয়াস্তে কয়েকটি নির্বাচন হলেও পরবর্তীতে তথাকথিত সমঝোতা'র মাধ্যমে পর্ষদ করে নিজের অনুগতদের নিয়ে সংগঠন পরিচালনা করেছেন। বিকেএমএই তে সব কিছুই চলতো সেলিম ওসমানের নির্দেশনা অনুযায়ী। এমনকি কে কোন পদে থাকবেন সেটাও নির্ধারণ করে দিতেন তিনি। ৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের পর গত ২৪ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে সভাপতির পদ থেকে সেলিম ওসমান পদত্যাগ করেন। তবে তিনি কমিটি পুনর্গঠন করার ঘোষণা না দিয়ে নতুন সভাপতি নির্বাচন করেন এবং তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে পর্ষদকে অনুরোধ করেন যা এই ধরনের নেতৃস্থানীয় সংগঠনটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সেলিম ওসমান তার পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেন, 'বর্তমান নির্বাহী সভাপতি হাতেম দীর্ঘদিন ধরে আমাকে, বিকেএমইকে ও নিট সেক্টরের উন্নতির জন্য সহায়তা করে গেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমি পরিচালনা পর্ষদের সকলের কাছে অনুরোধ রাখতে চাই, আমার বিদায়ের পর পর বিকেএমইএ ও নিট সেক্টরের উন্নয়নকল্পে মোহাম্মদ হাতেম এর অবদান এবং প্রচেষ্টার কথা স্মরণ করে তাকে এই নতুন বিকেএমইএ পরিচালনার জন্য সভাপতির দায়িত্বভার অর্পণ করা হোক (সংযুক্তি দ্রষ্টব্য) অনুগত পর্ষদও বিনা বাক্যব্যয়ে তার কথা মেনে নিয়েছেন এবং মোহাম্মদ হাতেমকে সভাপতি, সাবেক স্বৈর-শাসকের দোসর সেলিম ওসমানের অনুগতদের নিয়েই গঠিত হয়েছে প্রহসনের বর্তমান পর্ষদ।
উল্লেখ্য, মোহাম্মদ হাতেম বিগত তিন বছর যাবত নির্বাহী সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাকে সুযোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে তৈরি করার লক্ষ্যে ২০২১ সালে নির্বাহী সভাপতির একটি নতুন পদ সৃষ্টি করে সেখানে তাকে বসান সেলিম ওসমান। বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলের পুরোটাই সেলিম ওসমানের অনুগত থেকে মোহাম্মদ হাতেমও পুরোপুরি ক্ষমতার সদ্বব্যবহার করেছেন। তিনি সরকারের কতটা আজ্ঞাবহ সর্বশেষ তার প্রমাণ দিয়েছেন গত ২২ জুলাই।
সেদিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেশের ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বৈঠক করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বৈঠকে বিকেএমইর তৎকালীন নির্বাহী সভাপতি (বর্তমান সভাপতি) মো. হাতেম বলেন, 'এরকম একটি সঙ্কটকালে আমরা এমন সিচুয়েশন দেখবো সেটা আশা করিনি। যে তান্ডব আমরা গত কয়েক দিনে দেখেছি, আমরা আশা করব, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্য যারা আছেন, তারা তা উদ্ঘাটন করবেন এবং আইনের আওতায় আনবেন। আমরা সরকারের পাশে সবসময়ই ছিলাম, এখনো আছি, ভবিষ্যতেও থাকবো।"