পদে বহাল থাকতে ঝুট ব্যবসায়ী হাতেমের নানা পায়তারা
যুগের চিন্তা রিপোর্ট
যুগের চিন্তা
প্রকাশিত : ০১:০৪ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ রোববার
গত ৫ আগষ্ট পটপরিবর্তনের পর (২৪ আগষ্ট) আওয়ামী লীগের অন্যতম দোসর সেলিম ওসমানের পদত্যাগপত্রের প্রেসক্রিপশনে শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন বিকেএমইএ'র সভাপতি পদ দখলে নেন বিগত কয়েক বছর যাবৎ সেলিম ওসমানের হাতে ভূয়াভাবে বানানো পদ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ওরফে (ঝুট বাবা হাতেম)। তিনি ২০১০ সাল থেকেই ওসমানদের ছত্রছায়ায় মোহাম্মদ হাতেম বিসিক এলাকার বহু ব্যবসায়ীকে ব্যবসা ছেড়ে যেতে বাধ্য করে। একদিকে ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, আরেকদিকে জমি ব্যবসায় রমরমা সিন্ডিকেট গড়ে তোলে হাতেম।
ওসমান পরিবারের প্রত্যক্ষ ঠিকাদার হিসেবে কাজ করতেন হাতেম। একদিকে সেলিম ওসমান, শামীম ওসমান এবং অয়ন ওসমানের নিয়ন্ত্রিত বাহিনীকে ঝুট বিতরণ করতেন, অপরদিকে আজমেরী ওসমানের সাথে সখ্যতা রেখে তার ক্যাডারবাহিনীর মাধ্যমেও ফ্যাক্টরির ঝুট নিয়ন্ত্রণ করতেন। তবে শুধু ঝুট নয়, তিনি বিসিক শিল্প মালিক সমিতির পদ দখলে রাখায় সেখানকার বিচার- শালিশের নামে ব্যবসায়ীদের উপর নানা অত্যাচারের কথা এখন সেখানকার মানুষের মুখে মুখে। তা ছাড়া হাতেমের কথার নড়চড় হলেই ব্যবসায়ীদের উপর অত্যাচারের খড়া নেমে আসতো। এদিকে পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বিকেএমই‘এ এর সভাপতির দায়িত্ব সেটা পূরন হওয়ায় তিনি পুরনো মুখোশ পাল্টে ক্লিন ইমেজ হিসেবে নিজেকে আলোচনায় রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। যার কারণে সেলিম প্রেসক্রিপশনে হওয়া সভাপতি সেই বিষয়টি সকলের সামনে প্রকাশ্যে না এনে, সবাইকে বলেন যে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন বাণিজ্যে মন্ত্রণালয় থেকে। কিন্তু সত্য কখনো লুকিয়ে থাকে না সেলিম ওসমানের দেওয়া সেই প্রেসক্রিপশন প্রকাশে আসলে ও গত জুলাইয়ের আন্দোলনে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন আর বলেছিলেন যে, এই সরকারের পাশে আমরা সবসময়ই ছিলাম, এখনো আছি, ভবিষ্যতেও থাকবো। তা ছাড়া পটপরিবর্তনে নিজের পদ বাঁচিয়ে রাখতে হাতেমের বড় ছেলে অয়নকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের সাইবার যোদ্ধা পরিচিত করার প্রয়াস চালান হাতেম। অথচ শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমানের সাথে ঢাকায় বেশিরভাগ সময়ে হাতেমের ছেলে অয়নের সখ্যতা ছিলো। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হাতেমের ছেলে অয়ন বাণিজ্যেমন্ত্রী টিপু মুন্সি, ঢাকা সিটি মেয়র আতিকসহ আওয়ামী লীগের ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে কথায় কথায় সেল্ফি তুলতেন এমনকি সে সময় বাবা হাতেম বিকেএমই‘এ নির্বাহী সভাপতি থাকায় বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কাছে এই ছবি দেখিয়ে ভয়ভীতি দেখাতেন এই হাতেমের ছেলে অয়ন। এদিকে বিগত দিনে ওসমানদের যেভাবে ম্যানেজ করে হাতেম টিকে ছিলেন সেইভাবে নয়া কৌশলে ঝুট বণ্টনের টোকেনের মাধ্যমে বিএনপির কিছু কথিত নেতাকর্মীদের মাধ্যমে নিজের অবস্থান শক্ত করতে গিয়ে ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেন যাকে ঘিরে হাতেমকে স্বৈরাচারের দোসর উল্লেখ করে কয়েকজন ব্যবসায়ী বাণিজ্যে উপদেষ্টা ও সচিব বরাবর লিখিত অভিযোগ দিলে দিশেহারা হয়ে পরেন ঝুট ব্যবসায়ী হাতেম। যাকে ঘিরে দিশেহারা হয়ে পরেন ঝুট ব্যবসায়ী হাতেম। তা ছাড়া বর্তমানে ব্যবসায়ী বিভিন্ন সেক্টর থেকে হাতেমের বিরুদ্ধে আসতে শুরু বয়কটের ডাক। তা ছাড়া বর্তমানে জেলা বিএনপি, মহানগর বিএনপি, নারায়ণগঞ্জ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলনসহ নারায়ণগঞ্জ সুধীসমাজ অনতিবিলম্বে বিকেএমইএ’র সভাপতি পদ থেকে ওসমানদের দোসর ঝুট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হাতেমকে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন। সব কৌশলই বিফলে যেতে শুরু করেছেন হাতেমের যাকে ঘিরে অনেকটাই দিশেহারা হয়ে পরেছেন এই ব্যবসায়ী নেতা হাতেম।
সূত্র বলছে, বিসিক শাসনগাঁও এলাকায় বড়, মাঝারি ও ছোট মিলিয়ে প্রায় ৫০০ তৈরি নীট ওয়্যার ও নিটিং কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে বড় রয়েছে ১০৮টি সবগুলোর ন্যায় বড়গুলো ও মোহাম্মদ হাতেমের টোকেনের দখলেই। তিনি যখন যাকে গার্মেন্টস থেকে মালামাল নামানোর টোকেন দিচ্ছেন তখনই তখনই সেই চ্যালাড়া হাতেমের জয়জয়কার বলে তার কথায় সেগুলোতে মালামাল নামাচ্ছে বলে জানা গেছে। ঝুট ব্যবসায় মূল নিয়ন্ত্রক হিসেবে ঘুরেফিরে হাতেমের নামটিই চলে আসে বারবার। সরকার পতনের পরও গোটা ফতুল্লায় ঝুট ব্যবসার প্রচ্ছন্ন নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করেছেন হাতেম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন জানান, বিসিক এলাকায় ঝুট ব্যবসা করতে গেলে প্রথম অনুমোদন নিতে হয় হাতেমের। বিসিক এলাকায় ঝুট নিয়ে যেসকল অসন্তোষ শোনা যায় এরপেছনে হাতেমকেই দায়ী করেন তারা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত দুই যুগের বেশি সময় ধরে ওসমানদের ছায়া হিসেবে কাজ করেছেন মোহাম্মদ হাতেম। স্বৈরশাসক ও ফ্যাসিস্টের পতন হয়েছে এখনো ওসমানদের ছায়ামুক্ত হতে পারেনি বিকেএমই’এ।
এদিকে বহু ব্যবসায়ীরা বলছে, বিসিক নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবসায়ীদের ভয়ভীতিসহ সবই করতেন সেলিম ওসমানের হয়ে করতেন হাতেম। আর হাতেমের সে সময়কার যা বর্তমানে ও রয়েছে সেই হাতিয়ার হিসেবে রয়েছেন বাংলাদেশ নিটিং অনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি সেলিম সারোয়ার ও সংগঠনটির সাবেক সভাপতি আবু তাহের শামীম। এদের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে নিটিং অনার্স এসোসিয়েশনের অফিসে লাঞ্চিত করার অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া এই সেলিম ও শামীম বিভিন্ন জায়গায় হাতেমের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেন। যাকে ঘিরে সেলিম সারোয়ার ও আবু তাহের শামীম ছোট ছোট নিটিং থেকে হাতেমের নামে চাঁদাবাজিসহ বর্তমানে বিভিন্ন নিটিং ও কয়েকটি গার্মেন্টসের ঝুট সেক্টর হাতেমের হয়ে নিয়ন্ত্রণ করছেন এরা। এদিকে এ.বি নীট ওয়্যারের মালিকানাধীন থাকায় হাতেম বিসিক শিল্প মালিকর সমিতির সভাপতি পদ দখল করে রেখেছেন যার মাধ্যমে তিনি দীর্ঘদিন যাবৎই জিম্মি করে রেখেছেন বিসিককে ও খাচ্ছেন ঝুট সেক্টর। এদিকে গত কয়েকবছর যাবৎ যেভাবে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসিক মাসোয়ারাসহ নানাভাবে চাঁদাবাজি করেছেন যা দিয়ে নিজের দুই ছেলে ও স্ত্রীর নামে তৈরি করেছেন এইচ.কে এপ্যারেলস নামে আরেকটি গার্মেন্টস। তা ছাড়া এই হাতেমের নামে বিসিকসহ নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি সেক্টর থেকে মাসিক মাসোয়ারাসহ তোলা হচ্ছে। যা সেই বিগত দিনের মতোই তুলে থাকেন বিকেএমই‘এ এর সহ-সভাপতি মোর্শেদ সারোয়ার সোহেল। এদিকে বর্তমানে সেলিম ওসমানের বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্যেসহ সবই এখনো এই হাতেম নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে শোনা যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ওসমানদের দোসর মোহাম্মদ হাতেম ও বিকেএমইএ'র বর্তমান পর্ষদের বিরুদ্ধে অন্তবর্তীকালীন সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা, ও সচিব বরাবর অভিযোগ দায়ের করেছেন বৈষম্যর শিকার বিকেএমইএ এর সাধারণ ব্যবসায়ীরা।
অভিযোগপত্রে ব্যবসায়ীরা উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) দেশের নিটওয়্যার প্রস্তুতকারকদের একটি জাতীয় বাণিজ্য সংস্থা। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প সম্প্রসারণকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্বেও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনামলে সংগঠনটির নেতৃবৃন্দরা তাদের কার্যকলাপের জন্য সবসময়েই ছিলেন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। ২০১০ সাল থেকে টানা ১৪ বছর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সভাপতির পদ আঁকড়ে ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান। প্রথমবার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে নামকাওয়াস্তে কয়েকটি নির্বাচন হলেও পরবর্তীতে তথাকথিত সমঝোতা'র মাধ্যমে পর্ষদ করে নিজের অনুগতদের নিয়ে সংগঠন পরিচালনা করেছেন। বিকেএমএই তে সব কিছুই চলতো সেলিম ওসমানের নির্দেশনা অনুযায়ী। এমনকি কে কোন পদে থাকবেন সেটাও নির্ধারণ করে দিতেন তিনি।
৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের পর গত ২৪ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে সভাপতির পদ থেকে সেলিম ওসমান পদত্যাগ করেন। তবে তিনি কমিটি পুনর্গঠন করার ঘোষণা না দিয়ে নতুন সভাপতি নির্বাচন করেন এবং তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে পর্ষদকে অনুরোধ করেন যা এই ধরনের নেতৃস্থানীয় সংগঠনটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সেলিম ওসমান তার পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেন, 'বর্তমান নির্বাহী সভাপতি হাতেম দীর্ঘদিন ধরে আমাকে, বিকেএমইকে ও নিট সেক্টরের উন্নতির জন্য সহায়তা করে গেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমি পরিচালনা পর্ষদের সকলের কাছে অনুরোধ রাখতে চাই, আমার বিদায়ের পর পর বিকেএমইএ ও নিট সেক্টরের উন্নয়নকল্পে মোহাম্মদ হাতেম এর অবদান এবং প্রচেষ্টার কথা স্মরণ করে তাকে এই নতুন বিকেএমইএ পরিচালনার জন্য সভাপতির দায়িত্বভার অর্পণ করা হোক (সংযুক্তি দ্রষ্টব্য) অনুগত পর্ষদও বিনা বাক্যব্যয়ে তার কথা মেনে নিয়েছেন এবং মোহাম্মদ হাতেমকে সভাপতি, সাবেক স্বৈর-শাসকের দোসর সেলিম ওসমানের অনুগতদের নিয়েই গঠিত হয়েছে প্রহসনের বর্তমান পর্ষদ।
উল্লেখ্য, মোহাম্মদ হাতেম বিগত তিন বছর যাবত নির্বাহী সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাকে সুযোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে তৈরি করার লক্ষ্যে ২০২১ সালে নির্বাহী সভাপতির একটি নতুন পদ সৃষ্টি করে সেখানে তাকে বসান সেলিম ওসমান। বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলের পুরোটাই সেলিম ওসমানের অনুগত থেকে মোহাম্মদ হাতেমও পুরোপুরি ক্ষমতার সদ্বব্যবহার করেছেন। তিনি সরকারের কতটা আজ্ঞাবহ সর্বশেষ তার প্রমাণ দিয়েছেন গত ২২ জুলাই।
সেদিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেশের ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বৈঠক করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বৈঠকে বিকেএমইর তৎকালীন নির্বাহী সভাপতি (বর্তমান সভাপতি) মো. হাতেম বলেন, 'এরকম একটি সঙ্কটকালে আমরা এমন সিচুয়েশন দেখবো সেটা আশা করিনি। যে তান্ডব আমরা গত কয়েক দিনে দেখেছি, আমরা আশা করব, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্য যারা আছেন, তারা তা উদ্ঘাটন করবেন এবং আইনের আওতায় আনবেন। আমরা সরকারের পাশে সবসময়ই ছিলাম, এখনো আছি, ভবিষ্যতেও থাকবো।"