রোববার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ৮ ১৪৩১   ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ওসমান লুটেরাদের শাসনের অবসান

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

যুগের চিন্তা

প্রকাশিত : ১১:০৫ এএম, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ রোববার

ওসমানদের লুটপাটের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়া নারায়ণগঞ্জ ক্লাব অবশেষে তাদের কালো থাবা থেকে মুক্ত হল। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রথমবারের মতো ওসমানপরিবারের প্রভাবমুক্ত হয়ে ঐতিহ্যবাহী নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের নির্বাচন অত্যন্ত উৎসবমুখর, প্রাণবন্ত, স্বচ্ছ এবং ব্যাপক ভোটারের ভোটপ্রয়োগের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়েছে। দীর্ঘ ১৫ বছর পর ভোটাররা ওসমানদের কালো থাবার কারণে প্রভাবমুক্ত হয়ে ভোট দিতে পারেনি । সিলেকশনে ওসমানদের কিছু লোককে সামনে এনে লোক দেখানো নির্বাচন করতো ওসমানরা। কেননা, ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পুরোটা সময় সেলিম ওসমান, শামীম ওসমান, তাঁর শ্যালক তানভীর আহমেদ টিটুগংরা এটিকে লুটপাটের আস্তানা বানিয়ে ফেলেছিল। সর্বশেষ ক্লাব সদস্য করার নাম করে ৪০০ সদস্যের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা লোপাট করে টিটু,তাছাড়া ক্লাবের নতুন ভবন তৈরির নামেও ক্লাবের ফান্ডে নয়ছয় করে যায়। ওসমানদের এই লুটপাটে ব্যাপকভাবে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়। পূর্ববর্তী ইউরোপীন ক্লাবটি ইংরেজ আমল থেকেই এলিট ক্লাব হিসেবে স্বীকৃত। একসময় বনেদি পরিবারের লোকজনই এই ক্লাবের সদস্যরা হতো। এই ক্লাবের সুনামের কারণে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য ক্লাবগুলোতে এই ক্লাবের কার্ডধারী সদস্যদের জন্য প্রবেশাধিকার একেবারে সহজ ছিল। কিন্তু ওসমানদের কালো থাবায় ক্লাবের ইমেজ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

ওসমানদের অনুসারী, তাদের গোলামী করতো, দাসত্ব করতো এমন অনেক ব্যক্তিকে তারা ক্লাবে অন্তর্ভূক্ত করে। যার ফলে ক্লাবের ইমেজ সংকট তৈরি হয়। বন্ধ হয়ে যায় এই ক্লাবের কার্ডধারী সুবিধা নিয়ে অন্যান্য ক্লাবে উন্মুক্ত প্রবেশাধীকার। এখনো সেটি বন্ধ রয়েছে। এবারের নির্বাচনে দাঁড়ানো সকল প্রার্থীই ক্লিন ইমেজের। তাদের এই ইমেজ এবং ওসমান প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাচ্ছন্দে ভোট দিয়েছেন ভোটাররা। তাদের সকলের প্রত্যাশা যারা জয়ী হয়েছেন তারা যেন ওসমানদের কারণে ক্লাবের যে ইমেজ সংকট হয়েছে সেটি পুনরুদ্ধার করার ব্যাপারে তড়িৎ ভূমিকা দেন।  


গত ৫ আগস্টের আগে ও স্বৈরাচার পতনের দিনে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ক্লাবটি সংস্কারে গুরুদায়িত্ব ক্লাবটির সাবেক তিনবারের নির্বাচিত সভাপতি এম সোলায়মানের উপর দিয়েছিলেন ক্লাব সদস্যরা। ক্লাব সদস্যদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মাত্র কয়েকমাসে ঘুরে দাঁড়ায় ক্লাবটি। ২১ ডিসেম্বর ভোটের দিনে তারই যেন পুরস্কার তুলে দিলেন এম সোলায়মানের হাতে। চতুর্থবারের মতো ঐতিহ্যবাহী নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন সজ্জন ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাত এম সোলায়ামান।  তিনি নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের তিনবারের সভাপতি, ইয়ার্ন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এর ডিরেক্টর এবং হাজী হাসেম স্পিনিং মিলস লি এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর। গতকাল শনিবার (২১ ডিসেম্বর) সারাদিন ভোটাররা ভোটপ্রয়োগ শেষে ভোটগণনা শুরু করে নির্বাচন কমিশন। রাতে ভোট গণনা শেষে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সভাপতি পদে এম. সোলায়মানকে বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করেন নির্বাচন কমিশনার। নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ রি- রোলিং মিলস এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. মাহবুবুর রশিদ জুয়েল। নিয়মিত প্রায় ২২৬০ ভোটারের মধ্যে ১৫৯৮ জন ভোটার ভোট দিয়েছেন। নির্বাচনে ৭০ দশমিক ৮৪ পারসেন্ট ভোট কাস্ট হয়েছে। সভাপতি পদে ২নং ব্যালটে এম সোলায়মান ৯১৮ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ১নং ব্যালটে মো. মাহবুবুর রশিদ জুয়েল পেয়েছেন ৬৭১ ভোট।


সভাপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার পর নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের নবনির্বাচিত সভাপতি এম. সোলায়মান ভোটারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে মেম্বাররা অনেক আনন্দ উৎসব পালন করেছেন। নির্বাচনটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। যে যার ইচ্ছামত নির্বাচন করতে পেরেছে, ভোটদিতে পেরেছে। কারো উপর কোন চাপ ছিলনা। ৫আগস্টের আগে ক্লাবটি ধ্বংসের পথে চলে গিয়েছিল। আমরা সবাই মিলে এই ক্লাবটিকে দাঁড় করিয়েছি। আগামী দিনে আমাদের প্রথম কাজ হবে যত  দ্রুত সম্ভব ক্লাবের কমিউনিটি সেন্টারটি চালু করে ফেলা। ইয়াং মেম্বারদের জন্য অর্র্থাৎ মেম্বারস সন দের জন্য আলাদ একটি লাউন্স করে দিবো। আরো যেসকল কাজগুলো রয়েছে সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করবো। আমি নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই কোন অঘটন ব্যতিত একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দিয়েছেন।


সভাপতি পদে পরাজিত প্রার্থী বাংলাদেশ রি-রোলিং মিলস এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. মাহবুবুর রশিদ জুয়েল বলেন, আমার বড় ভাই জয়ী হয়েছে। ভবিষ্যতেও আমরা একেঅন্যকে সহযোগিতা করবো। আমাদের ক্লাবের দায়িত্বে তিনি এসেছেন, আমাকে ডাকলেই আমি উনার সকল কাজে পাশে থাকবো। ভোটের মাধ্যমে তিনি জয়ী হয়েছেন আমি এতে খুশি। আমাদের মধ্যে কোন বিভেদ ছিলনা, এখনো নেই আগামীতেও থাকবেনা।


নির্বাচনে ১১টি পদের মধ্যে একজন সভাপতি, একজন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, একজন জুনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং আটজন পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনে সভাপতি পদে এম সোলয়ামান, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদে মারুফ আহমেদ বাবু ৯৫০ ভোট, ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে মো. সাইদুল্লাহ হৃদয় ৭৩৮ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছে এবং পরিচালক (ডিরেক্টর) পদে দিলারা মাসুদ ময়না ১১৮০ ভোট, হারুন-অর-রশিদ ১৪৭৯ ভোট, খান আব্দুল কাদির মাহবুব ১৪০০ ভোট, কাজী আব্দুস সাত্তার ১৩৮১ ভোট, কৌশিক সাহা ১৩৬১ ভোট, মো. জাহিদ হোসেন ১৫৩১ ভোট, তাইজুদ্দিন আহমেদ ১৪৭১ ভোট, সেলিম রেজা সিরাজী ১৪৭৭ ভোট  পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে ৬ টি ভোট বাতিল হয়েছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে ২৬টি ভোট বাতিল হয়েছে,  ডিরেক্টর পদে ৩৫২টি ভোট নষ্ট (বাতিল) হয়েছে। সভাপতি পদে ৯টি ভোট বাতিল হয়েছে।


এছাড়া পরাজিত প্রার্থীদের মধ্যে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদে ইকবাল হাবিব ৬৪২ ভোট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে ইঞ্জিনিয়ার আমিনুজ্জামান মৃধা ৫১৩ ভোট, খাজা এবায়দুল হক টিপু ৩২১ ভোট পেয়েছেন। এবং পরিচালক (ডিরেক্টর) পদে এড. ইন্দ্রজিৎ সাহা দীপক ১১৫২ ভোট পেয়েছেন।  


নারায়ণগঞ্জ ক্লাব লি. নির্বাচনে  নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যান  হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আনিসুল ইসলাম সানি, সদস্য আলহাজ্ব সাইফুল আলম, কুতুবউদ্দীন আহমেদ, এডভোকেট মো. রাকিবুল হাসান শিমুল, মোহাম্মদ হোসেন মিঠু এবং নির্বাচন আপীল বোর্ডের চেয়ারম্যান এড. মো. জাকির হোসেন, সদস্য মো. নবী হোসেন, খন্দকার মাহাবুব হোসেন (বাবু) ।


এর আগে সভাপতি পদের প্রার্থী এম সোলায়মান ক্লাবের নির্বাচনী ইশতিহারগুলোর বিষয়ে যুগের চিন্তাকে জানিয়েছিলেন, ‘আগামী তিনমাসের মধ্যেই ক্লাবের কমিউনিটি সেন্টারটি চালু করে দিবো। তাছাড়া মেম্বার’স সন দের জন্য আলাদা একটা লাউন্সও আগামী তিনমাসের মধ্যে চালু করবো, যাতে তারা স্বাচ্ছন্দে তাদের জেনেরেশনের সাথে গল্প করতে পারে। অন্যান্য ক্লাবগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে ক্লাবের খাবারের মানটা উন্নত করবো। ক্লাবের লাইব্রেরীটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা আমার নিজের অর্থায়নেই আবার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো। আমি আগে দায়িত্বে থাকা অবস্থাতে যেটি করেছি ক্লাবের ফান্ড ব্যতিত নিজস্ব অর্থায়নে ক্লাব সদস্যদের বিশাল গ্রুপ করে ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে ইংল্যান্ড এবং আমেরিকা আনন্দ ভ্রমণে আয়োজন করেছি, ২০১৩ সালে একইভাবে চায়না সফরের ব্যবস্থা করেছিলাম। এবারও নির্বাচিত হলে দেশে ও বিদেশে ক্লাব সদস্যদের নিয়ে আনন্দভ্রমণের ব্যবস্থা করবো। স্পোর্টসে বিশেষ করে স্নুকার, টেনিস এবং সাঁতারে যে কৃতিত্ব রয়েছে সেটি অব্যাহত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করবো।’