
বর্জ্যে বিবর্ণ শীতলক্ষ্যা
আমাদের নারায়ণগঞ্জের প্রাণ হলো শীতলক্ষ্যা নদী। স্বচ্ছ ও শান্ত স্বভাবের এই নদী ও দু-পাড়ের সমৃদ্ধ প্রকৃতিতে উৎপত্তি হয় নারায়ণগঞ্জ বন্দরের এবং আমাদের নারায়ণগঞ্জ শিল্প-বাণিজ্য সমৃদ্ধ নগরীতে রুপান্তরিত হয়। তবে এ নদীটি বর্তমানে ভয়াবহ দূষণ, আবর্জনা, ড্রেনের ময়লা, শিল্পকারখানার বর্জ্য, রাসায়নিক কেমিক্যালসহ বিভিন্ন অপদ্রব্যের প্রভাবে আজ মৃতপ্রায়। পানি এটতাই দূষিত যে জলজ প্রানীর অস্তিত্ব বর্তমানে মারাত্মক সংকটে। পানি রং কালো এবং তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত।
নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী ভয়াবহ দূষণের কবলে। শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য, বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত কেমিক্যাল, রঙিন ও দূষিত পানির ধারা, ডাইং ওয়াশিং ফিনিশিং সহ বিভিন্ন কারখানার বিষাক্ত রং ও কেমিক্যালের ফলে আমাদের শীতলক্ষ্যার অস্তিত্ব আজ হুমকির পথে। সেই সাথে শীতলক্ষ্যার মধ্যে মিশে থাকা বিভিন্ন খাল, ডোবা, নালা ও দূষিত হচ্ছে।
একসময়ে যে শীতলক্ষ্যার পানি সরাসরি পান করা যেত, সেই শীতলক্ষ্যা নদীর পানির রং বর্তমানে আলকাতরার মতো কালো। মানুষ দূর দূরান্ত থেকে আসতো এই নদীতে গোসল করার জন্য। কিন্তু বর্তমান উৎকট গন্ধের জন্যে নদীর সামনে যাওয়া ও কষ্টকর।
একসময়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে প্রচুর মাছ ছিলো। জেলেরা এই শীতলক্ষ্যার মাছ ধরে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো। স্বচ্ছ ও পরিষ্কার এই নদীতে বিভিন্ন ধরনের মাছ দেখা দেখা যেতো। কিন্তু বর্তমানে নদীটি দূষণের ফলে সব ধরণের মাছ আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে গেছে। জেলেরা তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছে এবং মাছের বাজারগুলোতেও আগের মতো মাছ দেখা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে নদীটির দুইপাশ ডকইয়ার্ড, বিভিন্ন শিল্পকারখানা, গোডাউন কারাখানা দখল করে রেখেছে। ফলে নদীটি দু-পাশ থেকে ছোট ও লম্বা হয়ে গেছে।
অধিকাংশ শিল্পকারখানাতেই ইটিপি ব্যবস্থা নেই। ইটিপি হচ্ছে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি এর অপরিশোধিত পানি পরিশোধন করার একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে দুষিত পানিকে বিশুদ্ধ করা যায়। যেখানে ইটিপি ব্যবস্থার মাধ্যমে সহজেই পানি বিশুদ্ধ করা যাচ্ছে, সেখানে এটা নিয়ে অধিকাংশ শিল্পকারখানাতেই নেই কোনো আগ্রহ। আবার বিভিন্ন কারখানাতে ইটিপির ব্যবস্থা থাকলেও তা করা হয় না। ফলে নদীতে প্রতিনিয়ত দূষিত পানি মিশ্রিত হচ্ছে।
আরিফ হোসেন নামের একজন জানান, “নদীর পানির থেকে তো এখন দুর্গন্ধ আসে। আমরা কতো গোসল করছি এই নদীতে। আর এখন নদীতে গোসল করলে শরীরে চুলকানি উঠে। যেখানে আমাদের বড় যারা ছিলো তারা এই পানি খাবারের জন্যেও নিয়ে যেতো।”
ফারুক মিয়া নামের আরেকজন বলেন, “ছোট থেকে বড় হলাম এই শীতলক্ষ্যার পাড়ে। ছোটবেলায় বন্ধুদের সাথে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নদীতেই থাকতাম। আবার নদীর থেকে আমরা অনেকবারই মাছ ধরে নিয়ে গেছি বাড়িতে। কিন্তু এখন নদীর এই অবস্থা দেখলে কান্না আইসা পরে।” শীতলক্ষ্যা হলো আমাদের নারায়ণগঞ্জের প্রাণ।
জীবনান্দ দাসের কপোতাক্ষ নদের মতো আমাদের নারায়ণগঞ্জ বাসিরও স্নেহের তৃষ্ণা মিটিয়েছে আমাদের এই শীতলক্ষ্যা। তাই এই শীতলক্ষ্যার অস্তিত্ব রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। অন্যথায় আক্ষেপ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (পবা) নারায়ণগঞ্জ শাখার সভাপতি এ বি সিদ্দিক জানান, পরিবেশ দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নামমাত্র জরিমানা করেই দায়িত্ব শেষ করছে পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। কার্যকর ব্যবস্থা নিলে বিদ্যমান আইনেই পরিবেশ দূষণ রোধ করা সম্ভব হতো।