পতনের পর দোসর হাতেমকে কেন বেছে নিলেন সেলিম ওসমান
যুগের চিন্তা রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
সেলিম ওসমান, ঝুট ব্যবসায়ী হাতেম
গণঅভ্যুত্থানে হুট করে ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালানোর পর খুব বেশি সময় পাননি তার চ্যালাচুমুন্ডারা। সূত্র জানিয়েছে, এখন অবধি দেশ ছাড়তে পারেননি ব্যবসায়ী জগৎ ও সংগঠনগুলোর কুখ্যাত মাফিয়া সেলিম ওসমান। ২০১০ থেকে ২০২৪ সালে পতনের আগ পর্যন্ত বিকেএমইএর সভাপতি পদ দখলে ছিল সেলিম ওসমানের। বিসিক এলাকার ঝুট ব্যবসা, ভূমিদস্যুতা আর বিচার সালিশের নামে ব্যবসায়ীদের শোষণ নিপীড়নের কল্যাণে ২০১৬ সালের পর থেকে সেলিম ওসমানের খাস লোকে পরিণত হন ঝুট হাতেম। ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর ঘাপটি মেরে ছিলেন সেলিম ওসমান। তবে ছক আকছিলেন সোনার ডিম পাড়া ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকে কী করে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ওসমানদের অন্যতম দোসর নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজলের বিরুদ্ধে ছাত্র-হত্যা মামলা থাকায় তাকে সামনে আনতে পারেনি সেলিম ওসমান। গত ১৬ বছরে ওসমানদের চিহ্নিত অনেকে দোসরই এখন পলাতক। ফলে নারায়ণগঞ্জের সব ব্যবসায়ী সংগঠনেই মুখ খুলতে থাকেন নির্যাাতিত ব্যবসায়ীরা। বিকেএমইএ বড় সংগঠন, তাই এখানে সেলিম ওসমান তার অন্যতম দোসর হাতেমকে বসানোর সিদ্ধান্ত নেন। ২৫ আগস্ট অসুস্থতার কথা বলে পদত্যাগপত্র জমা দেন তিনি। সেই পদত্যাগপত্রে তিনি বিকেএমইএ’র (নির্বাহী সভাপতি) সভাপতি হিসেবে ঝুট ব্যবসায়ী হাতেমকে বসানোর জন্য নির্দেশ দেন। এখন প্রশ্ন উঠেছে কেন, তিনি দোসর ঝুট ব্যবসায়ী হাতেমকে বেছে নিলেন। বিকেএমইএর গঠনতন্ত্রে কি আছে? গঠনতন্ত্র অনুসারে তৎকালীন নির্বাহী সভাপতি হামেত কি সভাপতি হতে পারে? কেন সভাপতির পদত্যাগে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মনসুর আহমেদকে সভাপতি হিসেবে ভরসা করতে পারলেন না সেলিম ওসমান?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আসলে বিসিক এলাকার ওসমানদের হয়ে ব্যবসায়ীদের উপর এমন কোন খড়গ চালানো বাকি রাখতেননা হাতেম। ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ বিসিক এলাকায় ওসমাদের সময় নির্বাচনে ইচ্ছুক ব্যবসায়ীদের নির্যাতনের জন্য টর্চার সেলও করা হয়েছিল। ঝুট ব্যবসায়ী হাতেমের অত্যন্ত ঘনিষ্ট আরেকটি সংগঠনের ওই ব্যক্তির মাধ্যমেই ওই টর্চার সেলটি ব্যবহৃত হতো। এখনো সেই সংগঠনের সভাপতি পদে রয়েছেন ওসমানদের আরেক দোসর। সবদিক বিবেনা করে বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল হক, বিকেএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি মনসুর আহমেদসহ আরো বেশ কয়েকজনকে ঠিক ভরসা করে উঠতে পারেননি সেলিম ওসমান। যার ফলে সিনিয়র সহসভাপতি মনসুরকে বাদ দিয়ে ঝুট ব্যবসায়ী হাতেমকে সভাপতি করার নির্দেশ দেন সেলিম ওসমান। তবে বিপত্তি বাধে যখন ২২ জুলাই তৎসময়ের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেশের ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বৈঠক করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বৈঠকে বিকেএমইর তৎকালীন নির্বাহী সভাপতি (বর্তমান সভাপতি) মো. হাতেম বলেন, 'এরকম একটি সঙ্কটকালে আমরা এমন সিচ্যুয়েশন দেখবো সেটা আশা করিনি। যে তাণ্ডব আমরা গত কয়েক দিনে দেখেছি, আমরা আশা করব, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্য যারা আছেন, তারা তা উদ্ঘাটন করবেন এবং আইনের আওতায় আনবেন। আমরা সরকারের পাশে সবসময়ই ছিলাম, এখনো আছি, ভবিষ্যতেও থাকবো।’
এই বক্তব্য ভাইরাল হওয়ার পরেই ব্যাপারটি বুঝতে পারেন বিকেএমইএর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মনসুর আহমেদ। মনসুর আহমেদ ও পরিচালক খুরশীদ আহমেদ তানিম পদত্যাগ করেন। পদত্যাগপত্রে তারা দুইজনই বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমকে ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ উল্লেখ করে বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী আচরণ এবং অনৈতিক কার্যক্রমের অভিযোগ তুলেছেন। ২৮ নভেম্বর) সংগঠনের নির্বাহী সভাপতি বরাবর পদত্যাগ দেন এ দুই নেতা। তাদের অভিযোগ, ‘বর্তমান সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের নেতৃত্বে সংগঠনের মূল্যবোধ ও নৈতিক মানদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা বলেন, ‘আমরা লক্ষ্য করেছি যে বর্তমান নেতৃত্বের অধীনে এমন কিছু কর্মকাণ্ড ঘটছে যা আমাদের আমাদের সংগঠনের মূলনীতি- ন্যায়পরায়ণতা, সততা এবং গণতান্ত্রিক চর্চাকে লঙ্ঘন করছে।” গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের বরাতে সংগঠনের এ দুই পরিচালক বলেন, “বর্তমান সভাপতি (মো. হাতেম) এবং কিছু সিনিয়র বোর্ড সদস্যরা ফ্যাসিজমকে সহযোগিতা করেছে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও সাধারণ ছাত্র-জনগণের ওপর নির্যাতনকারী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন।”
তারা আগামী ৫ ডিসেম্বরে ডাকা সংগঠনের বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) ও বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) বাতিলের আহ্বান জানান। তবে আড়াল থেকে সেলিম ওসমানে চাপে সেই অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হন মনসুর। যেই মনসুর এতোকিছু করেছেন, তাকেই আবার বাধ্য করা হয় হাতেমের পক্ষে কাজ করতে। বিকেএমইএর সর্বশেষ এজিএমেও অনুপুস্থিত ছিলে মনসুর। বিকেএমইএর বৈষম্যের শিকার ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিব বরাবর ঝুট ব্যবসায়ী হাতেমের পুরো ব্যাপারটি তুলে ধরেছেন, এব্যাপারে তদন্ত চলছে। সূত্র জানিয়েছে, কোন দিকে পাত্তা না পেয়ে এখন ঝুট ব্যবাসায়ী হাতেম সমন্বয়কদের পেছনে ছুটছেন, সাথে তার দুই ছেলে। তবে এসব যে তার স্ট্যান্টবাজি সেটি ৫ডিসেম্বর বিকেএমইএর ইজিএমে বুঝতে পেরেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, হাতেমের সকল কুকর্ম ও ওসমানদের চাল ধরা পড়ে গেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচিৎ এখনই প্রশাসক নিয়োগের ব্যবস্থা করে অতিদ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করা, ব্যবসায়ীদের ওসমান দোসরদের জিম্মি অবস্থা থেকে রক্ষা করা। না হলে ওসমান দোসররা নারায়ণগঞ্জকে নানাভাবে অশান্ত করার চেষ্টা করবে।