লুটেরা শামীম ওসমান দম্পতি দুদকের জালে
যুগের চিন্তা রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
শামীম ওসমান, তাঁর স্ত্রী সালমা ওসমান লিপি, শ্যালক তানভীর আহমেদ টিটু
সন্ত্রাসের জন্য কুখ্যাতি ওসমান পরিবারের জন্য নতুন কিছু নয়। ২০০৯ সালে এমপি হওয়ার সুযোগ না পেলেও ২০১৪ সালে এমপি হয়ে শামীম ওসমান, সেলিম ওসমানসহ গোটা পরিবার এক লুটেরা সাম্রাজ্য তৈরি করেন। শামীম ওসমান, তার ভাই সেলিম ওসমান, শামীম ওসমানের স্ত্রী সালমা ওসমান লিপি, শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমান, শামীম ওসমানের শ্যালক তানভীর আহমেদ টিপু, শামীম ওসমানের মামা শ^শুর জালাল, শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমান, শামীম ওসমানের বেয়াই ফয়েজউদ্দিন লাভলু, অয়ন ওসমানের শ্যালক ভিকি, শামীম ওসমানের কথিত শ্যালক এহসানুল হক নিপুসহ গোটা ওসমান পরিবারের প্রায় অর্ধশত ব্যক্তি গত একদশকের বেশি সময় ধরে গোটা নারায়ণগঞ্জের লুটপাটের রাজনীতি তৈরি করে। এই পরিবারের পরের স্তুরেই তাদের অনুসারী আরো ১৫০ জনেরও বেশি ব্যক্তি সন্ত্রাস, লুটপাট, খুনখারাবির মাধ্যমে গোটা জেলায় লুটপাটের রামরাজত্ব তৈরি করেন। এসব লুটপাটের ফিরিস্তি তৈরি করতেও কয়েকবছর সময় লেগে যাবে। দেশে-বিদেশে অবৈধ সম্পদের পাহাড়, কয়েক দেশের নাগরিকত্ব, বিদেশে আলিশান বাড়ি-গাড়ি, শপিং কমপেক্সসহ কোন কিছুই তারা বাদ রাখেনি। দেরীতে হলেও শামীম ওসমান, তার স্ত্রী ও শ্যালকের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
প্রায় ২০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান, তার স্ত্রী সালমা ওসমান ও শ্যালক তানভীর আহমেদকে আসামি করে মামলা দায়েরের অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
গতকাল বুধবার (১৫ জানুয়ারি) বিকালে এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন। তিনি বলেন, কে টেলিকমিউনিকেশন্স লিমিটেডের মাধ্যমে তারা এই অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। আগামীকালের মধ্যেই মামলাটি দায়ের করা হবে বলে জানান তিনি।
দুদক মহাপরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, অনুসন্ধানের সময় বিটিআরসি থেকে পাওয়া রেকর্ডপত্র ও তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, কে টেলিকমিউনিকেশন্স লিমিটেড আন্তর্জাতিক কিংবা বৈদেশিক ইনকামিং কল আনা তথা সেবা রফতানির জন্য বিটিআরসি থেকে ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) লাইসেন্সপ্রাপ্ত একটি প্রতিষ্ঠান। যার চেয়ারম্যান সালমা ওসমান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ।
আক্তার হোসেন আরও জানান, দুদকের অনুসন্ধানের সময় ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে বা আইজিডব্লিউ অপারেটরকে টেলিকমিউনিকেশন্স লিমিটেডের আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল আনয়ন কিংবা সেবা রফতানি এবং তার সংশ্লেষে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশে আনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, আইজিডব্লিউ অপারেট ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে ৯১ কোটি ৫০ লাখ ৯২ হাজার ৮৬৫ কল মিনিট সেবা রফতানি করে। রফতানি করা এ সেবার মূল্য ২ কোটি ৭৪ লাখ ৫২ হাজার ৭৮৬ মার্কিন ডলার। উক্ত বৈদেশিক মুদ্রা আইন অনুযায়ী ফরেন রেমিট্যান্স হিসেবে বাংলাদেশে নিয়ে আসার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ জন্য নারায়ণগঞ্জের আইএফআইসি ব্যাংকের শাখা থেকে পাঠানো উক্ত আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্ট নম্বরের বিবরণীতে দেখা যায়, ২ কোটি ৭৪ লাখ ৫২ হাজার ৭৮৬ মার্কিন ডলারের স্থলে ২২ লাখ ৬৯ হাজার ৪২৭ মার্কিন ডলার আনা হয়েছে। আনা হয়নি ২ কোটি ৫১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৫৮ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৯৩ কোটি ৯১ লাখ ১৮ হাজার ৬০৩ টাকা। তাছাড়া বিটিআরসি থেকেও এ সংক্রান্তে অনুরূপ তথ্য পাওয়া যায়। এ সময়ে আইজিডব্লিউ অপারেটরের চেয়ারম্যান হিসেবে সালমা ওসমান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তানভীর আহমেদ দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
দুদকের এই কর্মকর্তা আরও জানান, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি শামীম ওসমানের সহযোগিতায় চেয়ারম্যান হিসেবে সালমা ওসমান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তানভীর আহমেদ দায়িত্বে থাকা অবস্থায় উল্লিখিত আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বার্থ থাকা সত্ত্বেও বিদ্যমান মানি লন্ডারিং আইন অমান্য করে ১৯৩ কোটি ৯১ লাখ ১৮ হাজার ৬০৩ টাকা মূল্যের ২ কোটি ৫১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৫৮ মার্কিন ডলার পাচার কিংবা মানি লন্ডারিং করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় পাচারের অপরাধ হয়েছে।
তবে দুদকের এই মামলা করার পরেও এই ওসমান পরিবারের অবৈধ সম্পদ ও লুটপাটের ফিরিস্তি ততোট বোঝা যাবেনা। কেননা, চাঁদাবাজি, জমিদখল, টেন্ডারবাজি, শিপব্যবসা, মাদকব্যবসা, খেলাধুলায় বেটিং, গার্মেন্ট ইন্ড্রাষ্ট্রিজে চাঁদাবাজি, নারায়ণগঞ্জের সকল ব্যবসায়ী সংগঠনের কথায় কথায় চাঁদাবাজি, অস্ত্রের ব্যবসা, নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের অর্থ লুটপাটসহ বিভিন্ন ক্লাবে মাদকব্যবসাসহ সকল সেক্টরেই তাদের লুটপাটের অভয়ারণ্য গড়ে ওঠে। এসব অবৈধ অর্থ পাচারের জন্যও নারায়ণগঞ্জে গোটা ত্রিশেক লোক কাজ করতো বলে জানিয়েছে সূত্র। জেলা ক্রিড়া সংস্থার জায়গার বিক্রি, সংগঠনে লুটপাট, বেটিং, ওসমান আলী স্টেডিয়ামের অর্থ তসরুপ, মাদকব্যবসা, নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে লুটপাটের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের জোরে শামীম ওসমানের শ্যালক টিটু তো বিসিবি পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। লুটপাটের অর্থ ব্যাপক হারে বিদেশে পাচার করেছেন শামীম ওসমান। তুরস্ক, আমেরিকা, দুবাইসহ আরো কয়েকদেশের নাগরিকত্ব পর্যন্ত নিয়েছেন শামীম ওসমান। শামীম ওসমানহ তার গোটা পরিবার পুরো নারায়ণগঞ্জকে বছরের পর বছর লুটপাট চালিয়েছেন। এই পরিবারের প্রতিটি ব্যক্তিরই বিভিন্ন খাতে চাঁদাবাজির জন্য অর্ধশত লোক নিয়োজিত ছিল। এতো বড় লুটপাট চালিয়েও দিব্যি বিদেশে আয়েশ করছে এই কুখ্যাত পরিবার। বর্তমান সরকারের কাছে এই পরিবারের অবৈধ সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানিয়েছে নারায়ণগঞ্জবাসী।