রাইফেল ক্লাবের অস্ত্র উদ্ধার তৎপরতা কার স্বার্থে বন্ধ
যুগের চিন্তা রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
রাইফেল ক্লাবের অস্ত্র উদ্ধার তৎপরতা কার স্বার্থে বন্ধ
নারায়ণগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন রুখতে শামীম ওসমান ও তাদের অনুসারীদের মাধ্যমে রাইফেল ক্লাব থেকে লুট হওয়ায় অস্ত্র গত ৫ মাসে ও উদ্ধার হয়নি তা নিয়ে ফের আলোচনা-সমালোচনা উঠছে নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক ও সামাজিক মহলে। এ ছাড়া ও বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের মঞ্চে নেতাকর্মীদের বক্তব্যে উঠে আসছে রাইফেল ক্লাবের অস্ত্র উদ্ধারের ধীরগতি ও ব্যর্থতা সমালোচনা।
এদিকে গতকাল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে জেলা প্রশাসকের মত বিনিময় সভায় মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপু তার বক্তব্যে রাইফেল ক্লাবের লুট হওয়া অস্ত্র দ্রুত উদ্ধারে জোর দাবি জানিয়েছেন। এর আগে ও ত্বকী মঞ্চের একটি আলোক প্রজ্জলন কর্মসূচিতে নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি এড. মাহবুবুর রহমান মাসুম তার বক্তব্যে ঐতিহ্য রাইফেল ক্লাবের অস্ত্র লুট করে ছাত্র-জনতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল শামীম ওসমান ও তার বাহিনী।
এই অস্ত্রের দায়ভার কে নেবে? প্রশাসনের কাছে জানতে চাই, কেন রাইফেল ক্লাবের অস্ত্র উদ্ধার করা হয় না ? বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গরা রাইফেল ক্লাবের লুট হওয়া সেই অস্ত্র উদ্ধার নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলছেন। কার স্বার্থে লুট হওয়া সেই অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে না। নাকি এখনো ওসমানদের সাথে কোন কোন প্রশাসন কিনবা সিভিল কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ আছে তা নিয়ে ও প্রশ্ন রয়েছে।
এদিকে জানা গেছে, রাইফেল ক্লাবের অস্ত্র লুটের পিছনে খলনায়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানের সেকেন্ড ইন কমান্ড রাইফেল ক্লাবের সাবেক সাধারন সম্পাদক ও চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজলের মাধ্যমে গত ১৮ ও ১৯ জুলাই রাইফেল ক্লাবের প্রায় ১৪২টি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে শহরে সন্ত্রাসী কায়দায় ছাত্র-জনতার উপরে গুলি ছুড়েছিলেন সাবেক সাংসদ শামীম ওসমান,পুত্র অয়ন ওসমান, শ্যালক তানভীর আহম্মেদ টিটু, মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদ, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রাফেলসহ তাদের অনুসারীরা।
পরবর্তীতে ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তোপের মুখে পরে পালিয়ে যায় স্বৈরাচার শেখ হাসিনসহ তাদের দোসররা পালায় একই সাথে নারায়ণগঞ্জ থেকে পালিয়ে যায় ওসমান ও তাদের দোসররা। এর পরপরই নানাভাবে শামীম ওসমান ও তাদের দোসরদের গুলি ছোঁড়ার কয়েকটি স্পটের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ ভারাইল হলে প্রশ্ন উঠে এতো আগ্নেয়াস্ত্র আসলো কোথা থেকে পরবর্তীতে বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে খবর নিয়ে জানা যায় রাইফেল ক্লাবের অস্ত্র লুট করে ছাত্র-জনতার উপরে হামলার এই ঘটনা ঘটায় ওসমানরা।
পরবর্তীতে তা নিয়ে যুগের চিন্তা পত্রিকায় লাগাতার অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশের পর গত (১২ আগষ্ট) রাইফেল ক্লাবের লুট হওয়া ৪টি অস্ত্র উদ্ধার করেন র্যাব-১১‘র সদস্যরা। কিন্তু বাকি আরো ১৩৮টি আগ্নেয়াস্ত্র কোথায় রয়েছে তা নিয়ে কোন প্রকারের মাথা ব্যাথা নেই প্রশাসনিক কমকর্তাদের।
এদিকে জানা গেছে, সরকারি স্থাপনা হলেও রাইফেল ক্লাব ছিল শামীম ওসমানের অঘোষিত অফিস ও টর্চার সেল। এখানে বসেই নারায়ণগঞ্জ শহরের রাজনীতি ও নানা অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতেন সন্ত্রাসী শামীম ওসমান। পূর্বে শহরের বালুরমাঠ এলাকায় রাইফেল ক্লাব নামে আরেকটি অফিস ছিল শামীম ওসমানের। ২০০১ সালের ১৬ জুন শামীম ওসমানের ওপর বোমা হামলা হয় এই রাইফেল ক্লাবে। পরবর্তীতে নির্বাচনে হেরে গেলে দেশ ছেড়ে কানাডা পালিয়ে যান শামীম ওসমান।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে দেশে ফিরে আসেন শামীম ওসমান। ততদিনে রাইফেল ক্লাবের জায়গা পরিবর্তন হয়ে বর্তমানের জায়গায় চলে এসেছে। দেশে ফিরেই পুনরায় রাইফেল ক্লাবের দখল নেন শামীম ওসমান। নারায়ণগঞ্জের ব্যাবসায়ী থেকে শুরু করে সাত খুন মামলায় ফাঁসির আসামি নূর হোসেনের মত সন্ত্রাসীরাও রাইফেল ক্লাবে শামীম ওসমানের কাছে হাজিরা দিত। রাইফেল ক্লাবের ভেতরে ছিল শামীম ওসমানের টর্চারসেল। শামীম ওসমানের মতের বিরোধীতা করলেই রাইফেল ক্লাবে ডেকে নিয়ে টর্চার করা হত।
২০১১ সালের পর থেকেই নারায়ণগঞ্জ শহর গুম ও খুনের শহর হিসেবে দেশব্যাপী সমালোচিত হতে থাকে আর এসকল ঘটনা ও কর্মকাণ্ডের সাথে ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল রাইফেল ক্লাব। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ শহরের ঝুট সেক্টরের নিয়ন্ত্রণ, ব্যাবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, ফুটপাতের হকার নিয়ন্ত্রণ, সরকারি বিভিন্ন টেন্ডারসহ পুরে শহর এই রাইফেল ক্লাব থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হত।
সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রাইফেল ক্লাব থেকে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র ১৯ জুলাই শতশত সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দিয়ে আন্দোলন দমন করতে ছাত্র জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করেছিলেন এই শামীম ওসমান ও তার অনুসারীরা। এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসকল ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে জনসাধারণের মাঝে চরম ক্ষোভ দেখা যায়। আন্দোলনের দ্বিতীয় দফায় ৪ আগষ্ট ক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা শহরের রাইফেল ক্লাবে হামলা চালায় ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। বর্তমানে এই রাইফেল ক্লাব পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকলে ও এই রাইফেল ক্লাবের সেই লুট হওয়ার অস্ত্র ৫ মাসে ও কোন উদ্ধার হয়নি তা নিয়ে সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাঝে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এদিকে গত (৮ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় চাষাঢ়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ত্বকী হত্যার ১৪২ মাস উপলক্ষে আয়োজিত আলোক প্রজ্জলন কর্মসূচিতে রাইফেল ক্লাবের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্দেশ্য নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি এড. মাহবুবুর রহমান মাসুম বলেন, বাংলাদেশের ঐতিহ্য রাইফেল ক্লাবের অস্ত্র লুট করে ছাত্র-জনতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল শামীম ওসমান ও তার বাহিনী। এই অস্ত্রের দায়ভার কে নেবে? প্রশাসনের কাছে জানতে চাই, কেন রাইফেল ক্লাবের অস্ত্র উদ্ধার করা হয় না ? ওদের দোসররা এখনও নারায়ণগঞ্জে কীভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে?
গতকাল (১৬ জানুয়ারি) সকালে নবাগত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞার সাথে নারায়ণগঞ্জ জেলার রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের এক মতবিনিময় সভায় মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব এড. আবু আল ইউসুফ খান টিপু রাইফেল ক্লাবের সেই লুট হওয়া অস্ত্র উদ্দেশ্য বলেন, নারায়ণগঞ্জের সাবেক গডফাদার শামীম ওসমান, তার ভাই সেলিম ওসমান,
ছেলে অয়ন ওসমান, ভাতিজা আজমেরী ওসমান, নজরুল ইসলাম বাবু, সাবেক মেয়র আইভী; এদের গ্রেফতারে বাঁধা কোথায়। আমরা মনে হয়, এখনো তাদের কোন কোন প্রশাসন কিনবা সিভিল কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ আছে। এখনো রাইফেল ক্লাব থেকে যে অবৈধ অস্ত্রগুলো নিয়ে ছাত্র-জনতার উপর গুলি করা হয়েছিলো, তা কিন্তু এখনো একটিও উদ্ধার করা হয়নি। আপনি সেই অস্ত্রগুলো উদ্ধারে দ্রুত পদক্ষেপ নিবেন বলে আশা করছি।