বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হল ধানমন্ডি ৩২

যুগের চিন্তা রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

বুলডোজার দিয়ে ভাঙা হচ্ছে রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি
রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভাঙা হচ্ছে। বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাত সোয়া ১১টায় বাড়িটির দেয়াল বুলডোজার দিয়ে ভাঙতে দেখা যায়। এরআগে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে হামলা ভাঙচুর চালানো হয়। পরে সেখানে আগুন দেয় ছাত্র জনতা। ভারত থেকে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার দেওয়া বক্তব্যের প্রতিবাদে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয় ছাত্ররা। বিপুলসংখ্যক বিক্ষোভকারী গেট ভেঙে বাড়িতে ঢুকে শাবল-হাতুড়ি দিয়ে ভাঙচুর শুরু করে। এক পর্যায়ে বাড়িটির দুইতলায় দেওয়া হয় আগুন।
এদিকে খুলনার ময়লাপোতা এলাকায় শেখ হেলালের বাড়িতেও বুলডোজার দিয়ে ভাঙচুর করার খবর পাওয়া গেছে। গতকাল বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দিকে এগোতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ ও আওয়ামী লীগবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেন তারা। শাবল, হাতুড়ি ও রড দিয়ে বাড়ির দেয়ালসহ বিভিন্ন জায়গায় করা হয় আঘাত। কেউ খুলে নিয়ে যান জানালা, কেউ আবার স্মৃতি হিসেবে একটি করে ইট খুলে নিয়ে যান। এ সময় ছাত্র-জনতা ‘ভুয়া ভুয়া’, ‘খুনি হাসিনার বিচার চাই’, ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’, ‘দলে দলে যোগ দিন, মুজিববাদের কবর দিন’, ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ’ ও ‘ধুলায় মেশাও তাড়াতাড়ি, বত্রিশের দালানবাড়ি’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন।
৩২ নম্বর সড়কের মুখে জায়ান্ট স্ক্রিনে জুলাই অভ্যুত্থানের নৃশংসতার প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িটি বাংলাদেশের জন্য অভিশাপ আখ্যা দিয়ে ওই বাড়িতে হাজার হাজার লোক জড়ো হয়েছেন। কয়েক হাজার মানুষ বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে বাড়িটি নিশ্চিহ্ন করার জন্য যে যার মতো অংশগ্রহণ করছেন। উত্তেজিত জনতা বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে থাকেন। খালি হাতে যে যেভাবে পেরেছেন বাড়ির বিভিন্ন অংশ ভেঙে ফেলেন। বাড়িটির দরজা-জানালা খালি হাতে ভেঙে ফেলছেন। বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া দাবি জানিয়ে স্লোগান দেন উত্তেজিত জনতা। আজাদি না গোলামি, আজাদি আজাদি। দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা, ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘর ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও। এরকম নানা স্লোগানের প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ৩২ নম্বরের সড়কটি। স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে ওই এলাকা।
রাত যত বাড়তে থাকে, দলে দলে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার মানুষ ধানমন্ডি ৩২ নম্বর অভিশপ্ত বাড়ির সামনে এসে জড়ো হতে থাকে। যুবক, কিশোর, নারী-পুরুষসহ বয়স ধর্মবর্ণনির্বিশেষে রীতিমতো মানুষের ঢল নামে এ সড়কটিতে। ৩২ নম্বর সড়ক ছাপিয়ে মানুষের ঢল মিরপুর সড়ক পর্যন্ত এসে পৌঁছায়। মূল সড়কের যান চলাচলে যাতে বিঘ্ন না ঘটে, সেজন্য ছাত্রদের হাতে হাত রেখে যানবাহন চলাচলের শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কাজ করতে দেখা যায়।
অনেককে বলতে শোনা যায়, অন্তত একটি করে ইট হলেও নিয়ে স্মৃতি হিসেবে রেখে দিতে চান। ফ্যাসিবাদের আঁতুড়ঘর হিসেবে এ ধানমন্ডি ৩২ নম্বরকে আখ্যায়িত করেন তারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, কেউ কেউ এখান থেকে একটি লোহার গ্রিল, একটি কাঠের টুকরা, অর্থাৎ যে যার মতো যা পারছেন স্মৃতি হিসেবে আঁতুড়ঘরখ্যাত ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে নিয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকছেন। এদিকে রাত ৯টা ১০ মিনিটের দিকে সেনাবাহিনীর একটি টিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে উত্তেজিত জনগণকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ধানমন্ডি মিরপুর রোডের মূল সড়কে অবস্থান নেন। পরে রাত ৯টা ৫৮ মিনিটের দিকে তারা ওই এলাকা ছেড়ে চলে যান।
এদিকে মিরপুর রোড থেকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরমুখী সড়ক দিয়ে একটু পশ্চিম দিকে এগিয়ে গেলে বাম পাশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের ভিডিও প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করা হয়। উৎসুক মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে শেখ হাসিনার সেই নির্মম গণহত্যার তাণ্ডবলীলা অবলোকন করেন। অনেককে সেখানে আবেগতাড়িত হয়ে যেতে দেখা যায়।
নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের আয়োজনে ছাত্রসমাজের উদ্দেশে শেখ হাসিনা গতকাল বুধবার রাত ৯টায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেবে বলে সোশ্যাল মাধ্যমে প্রচারিত হয়। আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজেও এ তথ্যটি গত মঙ্গলবার প্রকাশ করা হয়েছে। এ খবরের পর কানাডায় অবস্থানরত লেখক ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়িতে লাখ লাখ মানুষকে যাওয়ার আহ্বান জানান। নিজের ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘কাডাল রানী লাইভে যাবে যখন, তখন সবাই যান ৩২ নম্বরে। বাকি কাম সাইরা আইসেন এইবার। লাখ লাখ মানুষ আসেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। আওয়াজ তোলেন থাকবে না, ৩২ নম্বর থাকবে না।’ এ আহ্বানের পর ‘ধানমন্ডির ৩২ নম্বর অভিমুখে বুলডোজার মিছিল’ নামে একটি কর্মসূচি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে ‘ধানমন্ডি ৩২ অভিমুখে বুলডোজার মিছিল’ শিরোনামে একটি পোস্টার ফেসবুকে পোস্ট করে বিদেশে অবস্থানরত সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন লেখেন, আপার বক্তব্যের তালে তালে বুলডোজার চলবে। এর প্রতি সমর্থন জানিয়ে স্ট্যাটাস দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা হাসনাত আবদুল্লাহও। গতকাল সন্ধ্যায় কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘আজ রাতে ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি মুক্ত হবে।’ তার এমন ঘোষণার পর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জড়ো হতে থাকেন। পরে তারা মিছিল নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করেন।
এ খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে লাঠিসোটা, এসএস পাইপ, হাতুড়ি ইত্যাদি নিয়ে ছাত্র-জনতা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জড়ো হতে থাকেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত ৮টার দিকে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা বাড়ির গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন। বাড়ির ভেতরে কয়েক হাজার ছাত্র-জনতা প্রবেশের পর ভেতরের অবকাঠামো কাউকে হাতুড়ি দিয়ে, কাউকে শাবল দিয়ে ভাঙচুর করতে দেখা যায়। এ সময় তাদের আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দিতেও শোনা যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাত সাড়ে ৮টার দিকে ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়।
বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘যে শেখ হাসিনা আমাদের ভাইদের গুলি করে দেশ থেকে পালিয়েছেন। তিনি কী করে কর্মসূচি ঘোষণা করেন। আমরা এ দেশে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনার কোনো অস্তিত্ব রাখব না। যারা ছাত্র হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, সেসব ফ্যাসিবাদীর কোনো চিহ্ন বাংলাদেশের মাটিতে রাখতে চাই না। অবিলম্বে শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত এনে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। নিষিদ্ধ সংগঠনের কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হবে না।’
ঘটনাস্থলে উপস্থিত জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্সের আহ্বায়ক সালেহ মাহমুদ রায়হান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর এ দেশের প্রথম স্বৈরাচারের চিহ্ন মুছে ফেলতে চাই। আমরা বুলডোজার ভাড়া করেছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই সেগুলো আসবে। এখানে কিছুই থাকবে না।’ তবে বুলডোজার কলাবাগান মোড়ে আটকে দেয় পুলিশ। সংগঠনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘হাসিনাকে বক্তব্য প্রকাশের সুযোগ দেওয়াকে বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদবিরোধী জনগণের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ হিসেবে দেখি।’
পরে বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ফেসবুকে আরেক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘আজ রাতে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি মুক্ত হবে।’ এর আগেই বুধবার বিকেলে আলোচিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর ইলিয়াস হোসাইন ও পিনাকী ভট্টাচার্য ফেসবুকে ‘ধানমন্ডি ৩২ অভিমুখে বুলডোজার মিছিল’ ঘোষণা করেন। একটি ফটোকার্ড শেয়ার করেন এই দুই কনটেন্ট ক্রিয়েটর। তাতে বলা হয়, ‘হাজারো ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা চালিয়ে দিল্লি পালিয়ে গিয়ে সেখান থেকেই খুনি হাসিনার বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতার প্রতিবাদে ২৪-এর বিপ্লবী ছাত্র-জনতার উদ্যোগে রাত ৯টায় এই কর্মসূচি পালিত হবে।’
এর আগে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর পরই বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ৩২ নম্বরের এ বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন।