গার্মেন্টস শিল্পে অসন্তোষ তৈরির নেপথ্যে কারা

যুগের চিন্তা রিপোর্ট
প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম

গার্মেন্টস শিল্পে অসন্তোষ তৈরির নেপথ্যে কারা
২০২৪ সনের ৫ আগষ্টের পরে পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ থামছে না। গাজীপুরে ব্যপক আকারে শ্রমিক অসন্তোষ তৈরী হলেও নারায়ণগঞ্জে এর আকার তেমন ভাবেক প্রভাব তৈরী করতে পারছে না। তবে নারায়ণগঞ্জে বিভিন্ন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী গুলোতে শ্রমিকদের যুক্তিক দাবীর সাথে নানা অযুক্তিক দাবী তুলছেন তাও প্রকাশ্যে উঠে এসেছে। একই সাথে শ্রমিকদের দিয়ে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে বিশৃঙ্খলা তৈরী করে একশ্রেনীর শ্রমিক নেতারা ফায়দা নিয়ে থাকেন। বিগত সময়ের আওয়ামী লীগের ভুইফোর সংগঠন শ্রমিকলীগের নেতারা গার্মেন্টস সেক্টর গুলোতে প্রভাব বিস্তার করে অনেকে বিত্তশালি হয়ে গেছে। কিন্তু গত বছরের ৫ আগষ্টের পরে আওয়ামী লীগের শ্রমিক নেতারা পালিয়ে গেলেও বাম রাজনীতি দলের সাথে সম্পৃক্ত কিছু বিশৃঙ্খলা তৈরী করে ফায়দা নিতে মরিয়া হয়ে রয়েছে। গার্মেন্টস শিল্প মালিকদের মতে নতুন কিছু ব্যক্তি বড় নেতা সাজার জন্য তারা শ্রমিকদের উস্কানি দিয়ে ফায়দা নিতে চাচ্ছে। এদের মাঝে কারা সেই শ্রমিক নেতা।
এদিকে নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষের মুখে প্রায় ২১ টির মতো পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ও ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বড় কোনো কারণ ছাড়া এই অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টার পেছনে দেশি-বিদেশি চক্র জড়িত বলে শিল্পসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। সেই সাথে স্থানীয় শ্রমিক নেতাদের ফায়দাতো আছেই। পোশাক খাতকে পেছনে নেয়া এবং দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত করতে এমনটা করা হচ্ছে বলে তারা মনে করছেন।সাম্প্রতিক সময়ে আন্দোলন যেন একদম ‘ছেলের হাতের মোয়া’ হিসেবে পরিণত হয়েছে। সারাদেশের মতো নারায়ণগঞ্জেও এর ব্যতিক্রম নয়। বিশেষ করে গার্মেন্ট কারখানাতে শ্রমিক আন্দোলন যেন বেশি বেশি হচ্ছে। কয়েকদিন পরপরই একদম ছোট ইস্যুকে বড় ইস্যুতে পরিণত করে তারা আন্দোলনে নেমে পড়ছেন। কিছু থেকে কিছু হলেই তাদের আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। যেন মন চাইলো আর শ্রমিক নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়লো। তারই চিত্র যেন নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি ফ্যাক্টরীর আন্দোলনে পাওয়া গেছে।
এছাড়া শ্রমিকদের নিজেদের কর্মসংস্থানের শ্রমিকদের সাথে অন্য প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদেরও তারা যুক্ত করছেন। এক প্রতিষ্ঠানের সমস্যাকে কেন্দ্র করে অন্য প্রতিষ্ঠানকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছেন। আর এই আন্দোলনের সাথে রসদ যোগিয়ে আসছেন কিছু শ্রমিক নেতা। যাদের কোনো কর্ম নেই কোনো পেশা নেই। শ্রমিক আন্দোলন করাই যেন তাদের প্রধান পেশা। এসকল শ্রমিক নেতাদের উস্কানিতে আন্দোলনে নামা অনেক সময় আন্দোলনরত শ্রমিকেরাও জানে না তারা কিসের জন্য আন্দোলন করছেন।
সম্প্রতি সময়ে ৫ আাগষ্টের পরে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশিপুর হাট খোলা অবস্থিত ক্রোনি গার্মেন্ট বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিকদের অভিযোগ তাদের পাওনা পরিশোধ না করে মালিক ফ্যাক্টরী বন্ধ করে দিয়েছে। তাছাড়া নারায়ণগঞ্জ শিল্প পুলিশের তথ্য মতে, গত সাত মাসে না গ্রিন বাংলা হোম টেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, এশিয়ান ফ্যালকন গার্মেন্টস, জিএল ফ্যাশন, মাস্টার টেক্সটাইল, ওয়েস্ট বেস্ট অ্যাটায়ার্স, স্টার কাটিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংসহ ২১টি কারখানা বন্ধ হয়। সব কারখানাই ছোট ও মাঝারি। এছাড়া আইএফএস টেক্সওয়্যার লিমিটেড,ইউরোটেক্স নিটওয়্যার লিঃ, ফেম ডিজাই লিঃ, রাসেল গার্মেন্টস, আর কম্পোজিট, রবিন টেক্স গার্মেন্টস সহ আরও একাধিক ফ্যাক্টরীতে শ্রমকি অসন্তোষ তৈরী হয়। বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় শ্রমিকেরা নিরব থাকলেও এবার তারা সরব হয়েছেন। প্রত্যেক শ্রমিক অসন্তোষের পিছনেই কোনো না কোনো শ্রমিক নেতার উস্কানি রয়েছে।
অন্যদিকে রূপগঞ্জের রবিন টেক্স গার্মেন্টসের শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় শ্রমিকদের ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগে গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি সেলিম মাহমুদকে গ্রেফতার করেছে যৌথ বাহিনী। ১৭ এপ্রিল রাত দেড়টায় ফতুল্লা রেলস্টেশনসংলগ্ন ভাড়া বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) তারেক আল মেহেদী বলেন, সম্প্রতি রুপগঞ্জের রবিন টেক্স গার্মেন্টস কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের পেছনের মাস্টার মাইন্ড হচ্ছে শ্রমিক নেতা সেলিম মাহমুদ। তার ইন্ধনেই শ্রমিকরা বেপরোয়া আচরণ করে যৌথ বাহিনীর ওপর হামলা ও ভাঙচুর করেছে। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন। সেলিম মাহমুদের সহযোগি হিসেবে রয়েছেন আরেক শ্রমিক নেতা আবু নাইম বিপ্লব। এছাড়া তাদের সাথে শ্রমিক নেতা হিসেবে পরিচিত আরেক বামদল সিপিবির নেতার নাম উঠে এসেছে।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে জানাযায়, সম্প্রতি সময়ে বিসিকের আর এস কম্পোজিটের শ্রমিকরা কিছু বৈশাখি ছুটির জন্য আন্দোলন করলে মালিক পক্ষ তা মেনে নিয়ে ১৪ এপ্রিল বৈশাখীর দিন তাদের ছুটি দেন। অথচ কলকারখানার অধিদপ্তরের তথ্যমতে গার্মেন্ট সেক্টরে বৈশাখি ছুটি নাই। এমনকি আন্দোলনরত শ্রমিকরাও তা স্বিকার করেন। কিন্তু ছুটি শেষে এসে শ্রমিকরা আবার অযৌক্তিক কিছু দাবী দেন ফ্যাক্টরীর মালিক পক্ষকে। অথচ মালিকের তথ্যমতে, তার ফ্যাক্টরীর শ্রমিকদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন তিনি। সেই সাথে এই প্রতিষ্ঠানের বেশ সুনাম রয়েছে বিসিক মালিক সমিতিতে।
শ্রমিকদের অযৌক্তিক কিছু দাবী ধাওয়ার কারনে কয়েকদিন ধরেই তাদের গার্মেন্টস কারখানাটি বন্ধ থাকে। শ্রমিকদের দাবীর মধ্যে রয়েছে- সরকার ঘোষিত সকল ছুটি দিতে হবে। যেটা সাধারণত বাংলাদেশের কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেই দেয়া হয় না। এমনকি কলকারখানার অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ীও তা নেই। কর্মে যোগ দেয়ার ৬ মাসের মধ্যেই ঈদ বোনাস দিতে হবে এবং তা আগামী ঈদুল আজহা থেকেই কার্যকর করতে হবে। এটাও বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে দেয়া হয়ে থাকে না। ঈদুল ফিতর ৫ দিন ও ঈদুল আজহার ৬ দিন ছুটি দিতে হবে। এই বিষয়টি সাধারণত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মরত শ্রমিকদের সাথে আলোচনা করেই দেয়া হয়ে থাকে। হাজিরা বোনাসের জন্য মাসে ১৫ মিনিট ছাড় দিতে হবে। এটাও কোনো প্রতিষ্ঠানে দেয়া হয় না এবং একেবারেই অযৌক্তিক দাবী। রমজানের ইফতার বিল ৬০ টাকা দিতে হবে। ইফতারের সময় ১ ঘণ্টা দিতে হবে এবং তা ওভার টাইম হিসেবে গণ্য করতে হবে। যা নিয়মের মাঝে নেই। দুই ঈদের ছুটির দিন বেলা ১১ টার মধ্যে বেতন দিয়ে ছুটি দিতে হবে। তাদের এই আন্দোলনে উস্কানি সহ নেতৃত্বে কয়েকজন শ্রমিককে সনাক্ত করে। সেই এই আন্দোলনে সাইদ নামের একজন শ্রমিক উস্কানি দেয়ার অভিযোগ রয়েছে বলে জানান আন্দোলনরত কয়েকজন শ্রমিক। পরে মালিক পক্ষ তাদের এই দাবী আদায়ে জেলা প্রশাসকের কাছে সমাধানের জন্য গেলে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়ে তারা কখনো বৈশাখি ছুটি পেয়েছে কি না। এসময় শ্রমিকরা জানান তারা বৈশাখি ছুৃটি পান না। পরে তাদের দাবী কথা জানতে চাইলে তাদের কোন দাবী নেই বলে জানান। কিন্তু আন্দোলনের বিশৃঙ্খলা তৈরীর পেছনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের সনাক্ত করে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তাদেরকে কাজে নেয়ার দাবী জানান অন্য শ্রমিকরা। প্রশাসন থেকে জানিয়ে দেয়া হয় সাময়িক বরখাস্তকৃতদের বেপারে তদন্ত করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এখানে উস্কানি দাতা শ্রমিক নেতা সাইদ রয়েছেন ফতুল্লার দায়িত্বে। এছাড়া ফতুল্লায় আব্দুল কাদির নামে আরেক ছিচকে শ্রমিক নেতা রয়েছে।
তাছাড়া তাদের এই সকল দাবী শুধু গার্মেন্টস কারখানা নয় বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানেই মেনে নেয়া সম্ভব না। অথচ শ্রমিকরা এসকল দাবী আদায়ে আন্দোলন করে যান। পরবর্তীতে ওই গার্মেন্টস মালিক কারখানা বন্ধ করে দেন। কারখানা বন্ধ করে দেয়ার ফলে গার্মেন্টস শ্রমিকদের মাথায় হাত পড়ে। তাদের কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে যায়। তারা তাদের ভুল বুঝতে পারেন। সেই সাথে গার্মেন্টস খোলার জন্য মালিকের দারস্থ হন। কিন্তু কে এই দাবী উত্থাপন করলো কারা আন্দোলন করতে বললো তাদের খুঁজে পাননি শ্রমিকরা। তাদের মাঝে রয়েছে গার্মেন্টসে কর্মরত মিশু, সিরাজ, মনির হোসেন, রোমান, আহাদ, শিউলি সহ আরও অনেকে। তাদের নেপথ্যে রয়েছেন গার্মেন্টস শ্রমিকের কতিপয় নেতা। ঠিক এরকমভাবেই গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কিছু শ্রমিকনেতা নিজেদের স্বার্থের জন্য শ্রমিকদের উস্কানি দিয়ে আন্দোলনে নামাচ্ছেন। সেই সাথে শ্রমিকদেরকে অনেক সময় উত্তেজিত করে তুলছেন। নানা ভাবে শ্রমিকদের ্উস্কানি দিয়ে শ্রমিকদের দিয়ে শ্রমিক নেতারা মালিকদের থেকে বিশাল অংকের টাকা ফায়দা নিয়ে থাকে বলে একাধিক মালিক পক্ষ জানান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মালিক জানান, বিভিন্ন আন্দোলনের শ্রমিকদের অংশ থেকে ২০ থেকে ৪০% কমিশন নিয়ে থাকেন। অর্থাৎ ৫০ লাখ টাকা বিল আসলে সেখান থেকে শ্রমিক নেতারা ১০ লাখ টাকা নিয়ে থাকেন। তাছাড়া অনেক মালিক পক্ষ জামেলা এড়ানোর জন্য, এমনকি লষ থেকে বাচার জন্য হলেও শ্রমিক নেতাদের কয়েক লাখ টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে থাকেন। যাতে করে কোন জামেলা না হয়। এছাড়া ছাষাঢ়ায় শ্রমিকরা আসলে তাদের থেকে জনপ্রতি ১০০ টাকা করে নিয়ে মিছিল মিটিং করে থাকেন শ্রমিক নেতারা। আর এই ভাবে তারা মালিক শ্রমিকদের থেকে দুই ভাবে ফায়দা নিয়ে থাকেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, এভাবে চলতে থাকলে বৈশ্বিক ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে তাদের কার্যাদেশ অন্য দেশে স্থানান্তর করতে পারে। এমন ঘটনা হলে মালিক-শ্রমিক উভয়ের জন্য নেতিবাচক হবে। সামগ্রিকভাবে পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা শঙ্কা দেখা দিয়েছে। মূলত পোশাক খাত নিয়ে দেশি রাজনীতিও ঢুকে পড়েছে। এ সংকট দ্রুত শক্তভাবে প্রতিহত করতে না পারলে দেশের পুরো পোশাক শিল্পে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।