অল-ইন্ডিয়া দলের কিংবদন্তী ফুটবলার আলাউদ্দিন খাঁন
এন.হুসেইন রনী
প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৩, ০৬:১৫ পিএম
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অপূর্ব ক্রীড়াশৈলির প্রকাশ ঘটিয়ে ফুটবল জগতে তুমুল আলোড়নের মাধ্যমে মানুষের মন কাড়েন অল-ইন্ডিয়া দলের বাঙালি ফুটবলারদের আইকন খাঁন। পুরো নাম আলাউদ্দিন খাঁন। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি ছিল তার অগাধ প্রেম। আলাউদ্দিন খাঁনের জন্ম ১৯২০ সালে নারায়ণগঞ্জ সদরের ১৭৯ নং পাইকপাড়ায়।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৯৩৬ সালে ঢাকার বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ স্পোর্টস এসোসিয়েশনের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি ছিলেন একজন দুর্দান্ত লেফট উইঙ্গার। সেই, ঢাকার মাঠ থেকে যাত্রা শুরু, এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এই কিংবদন্তী ফুটবলারকে। তার পায়ের জাদুতে মুগ্ধ হয়েছে বাঙালি জাতি; বিমোহিত হয়েছে তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের লক্ষ কোটি ফুটবলপ্রেমী।
তারই স্বীকৃতি সরূপ ২০০০ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে তৎকালীন ক্রীড়া মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর নির্দেশক্রমে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান এক জমকালো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন সংলগ্ন মাঠকে আলাউদ্দিন খাঁন স্টেডিয়াম হিসেবে ঘোষণা করেন।
কিংবদন্তি ফুটবলার আলাউদ্দিন খাঁন, সেদিন অনুষ্ঠান মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন, আবেগাপ্লুত হয়েছিলেন তার প্রতি জাতির শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখে। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী’র প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার প্রচেষ্টায় ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে আলাউদ্দিন খাঁন স্টেডিয়ামের কাজ।
অল্প বয়সেই ঢাকার বড় বড় ক্লাব থেকে ডাক আসে তার। ১৯৩৬ সালেই ঢাকা স্পোর্টস এসোসিয়েশনে ডাক পান এবং তার চমৎকার নৈপুন্যে কলকাতা স্পোর্টস ক্লাবের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। ১৯৩৭ সালে চট্টগ্রাম ফুটবল এসোসিয়েশনের হয়ে চট্টগ্রাম আইলিংটন করিন্থিয়ান্স দলের বিরুদ্ধে ফাইনাল খেলে চ্যাম্পিয়ান হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।
১৯৩৮ সালে আরকানে (বার্মা) অনুষ্ঠিত আরকান ফুটবল এসোসিয়েশনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম পুলিশ ফুটবল ক্লাবের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৩৮ সালে চট্টগ্রাম পুলিশ এথেলেটিকস স্পোর্টস এর পক্ষ থেকে আলাউদ্দিন খাঁন’কে চ্যাম্পিয়ান অব দ্যা ইয়ার সম্মানে ভূষিত করা হয়। ১৯৩৯-১৯৪০ সাল পর্যন্ত পরপর দুই মৌসুম চট্টগ্রামের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে চট্টগ্রাম ফুটবল এসোসিয়েশন দলেই থেকে যান।
১৯৪১-১৯৪২ মৌসুমে ওঋঅ (ইন্ডিয়ান ফুটবল এসেসিয়েশন) লীগে ইস্ট বেঙ্গল কলকাতা দলের হয়ে তার দুরন্ত পায়ের গতি ও জাদুতে সকলের মন জয় করেন। ১৯৪৩ সালে বি এন্ড এ রেলওয়ে স্পোর্টস ক্লাবের হয়ে IFA (ইন্ডিয়ান ফুটবল এসেসিয়েশন) লীগে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
আইএফএ লীগে ভালো পারফরমেন্সের কারণে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সিনিয়র আর্ন্তজাতিক ফুটবল ম্যাচে দ্য ইন্ডিয়ান ফুটবল এসোসিয়েশন (ইন্ডিয়ানস্) [THE INDIAN FOOTBALL ASSOCIATION (INDIANS)] এর পক্ষ হয়ে ইন্ডিয়ান ফুটবল এসোসিয়েশন (ইউরোপিয়ানস্) [INDIAN FOOTBALL ASSOCIATION (EUROPEANS)] এর বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে অংশগ্রহণ করেন। তার খেলায় মুগ্ধ হয় ব্রিটিশরাও।
১৯৪৫ সালে খাঁন কলকাতার মাঠে তার দলের হয়ে IFA SHIELD জয় করার গৌরব অর্জন করেন। এভাবেই কিংবদন্তী ফুটবলার আলাউদ্দিন খাঁন ভারতের দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ইন্টার প্রভিনেন্স টুর্ণামেন্ট থেকে শুরু করে IFA দলের হয়ে করাচী, লাখনৌ, পাটনা এবং কানপুরসহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য প্রদর্শনী ম্যাচে খেলে, একজন অসাধারণ ফুটবলার হিসেবে ভারতবাসীর মনে স্থায়ী জায়গা করে নেন। ১৯৭৭ সালে আলাউদ্দিন খাঁন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জাতীয় পুরস্কার (ফুটবল) [NATIONAL AWARD IN FOOTBAL] প্রাপ্ত হন; যা ক্রীড়াঙ্গণ তথা নারায়ণগঞ্জের জেলার জন্য ছিল অত্যন্ত গৌরবের।
এই কীর্তিমান ফুটবলার ২০০১ সালে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় নিজ বাসভবনে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। এই মহান মানুষটি তার স্ত্রীসহ ছয় কন্যা ও তিন সন্তান রেখে যান। তারা হলেন যথাক্রমে: নাজমা বেগম, আলেয়া বেগম, সেলিনা খানম, মাঈনুদ্দিন আহমেদ (মাসুদ খাঁন), জিয়াউদ্দিন আহমেদ (জিয়া খাঁন), মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ, তাহমিনা খানম ও ফারহান খান।
তন্মধ্যে আলাউদ্দিন খাঁনের দ্বিতীয় পুত্র জিয়া খাঁন একজন সাবেক ফুটবলার; বাবার মতো তিনিও লেফট উইঙ্গার হিসেবে ঢাকার মাঠ কাঁপিয়েছেন এবং ফুটবলপ্রেমীদের মন জয় করেছেন। বর্তমানে জিয়া খাঁন সোনালী সকাল ক্রীড়া সংঘের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে নারায়ণগঞ্জ শহরে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও পিতার মতোই সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন ব্যাক্তিতে পরিণত হয়েছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া সংগঠক ও নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি মিজানুর রহমান বাচ্চু, নারায়ণগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি এজেডএন ইসমাইল বাবুল এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা আলাউদ্দিন খাঁনের শিষ্য আশরাফ উদ্দিন চুন্নু বলেন, “সর্বজন শ্রদ্ধেয় ফুটবলার আলাউদ্দিন খাঁন এবং তার পরিবারের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা। তার খেলোয়াড়ী জীবনের শেষে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একেজন ক্রীড়াসংগঠক ও প্রশিক্ষক হিসেবে তিনি যে অবদান নারায়ণগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থায় রেখেছেন তা নারায়ণগঞ্জবাসী চিরকাল মনে রাখবে।”
আজ হয়তো আলাউদ্দিন খাঁন বেঁচে থাকলে নারায়ণগঞ্জের ক্রীড়া জগতের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো; জাতীয় দলের পাইপ লাইনে আরো বেশি বেশি খেলোয়াড় তৈরি হতো। আজ ক্রীড়াঙ্গণের এই দু:সময়ে তাহারেই পড়ে মনে। তাই কবি শ্রীরজনী কান্ত সেনের ভাষায় বলতে হয়,
তোমারি দেওয়া প্রাণে তোমারি দেওয়া দুখ,
তোমারি দেওয়া বুকে, তোমারি অনুভব৷
তোমারি দুনয়নে তোমারি শোক-বারি,
তোমারি ব্যাকুলতা তোমারি হা হা রব৷
আজ ধর্ম-মত-পথ নির্বিশেষে নারায়ণগঞ্জের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ মনে করেন, নিখিল ভারতবর্ষে যে কয়জন জননন্দিত ফুটবলারের নাম উচ্চারিত হতে থাকবে; ফুটবলার আলাউদ্দিন খাঁনের নামটিও ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরকাল। লেখক: প্রাক্তন প্রভাষক, ফিরোজা বাশার আইডিয়াল কলেজ, ঢাকা