মঙ্গলবার   ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪   আশ্বিন ১ ১৪৩১

অস্ত্র জমা দেননি ওসমান ও গাজী পরিবারের লোকজন

যুগের চিন্তা রিপোর্ট

প্রকাশিত: ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪  


সেপ্টেম্বরের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দেওয়ার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকলেও নারায়ণগঞ্জ জেলায় অন্তত ৫৫টি আগ্নেয়াস্ত্র জমা পড়েনি। এরমধ্যে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান ও তার পরিবারের সদস্যদের কাছে রয়েছে অন্তত আটটি আগ্নেয়াস্ত্র, যা তারা জমা দেননি।

 

 

এসব অস্ত্র অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে নারায়ণগঞ্জ জেলায় ৭৩৭টি অস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। এরমধ্যে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত টানা চার মেয়াদে মোট ৩২১টি অস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে।

 


অন্তবর্তীকালীন সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেসামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে দেওয়া ১৯১টি অস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করেছে জেলা প্রশাসন। এরমধ্যে ১০২টি শটগান ও বন্দুক, ৬৭টি পিস্তল, ১৪টি রাইফেল এবং ৮টি রিভলবার। এই সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে জেলার বিভিন্ন থানায় ১৩৬টি অস্ত্র জমা দেওয়া হয়েছে। এখনও ৫৫টি অস্ত্র জমা পড়েনি।

 


অস্ত্র জমা না দেওয়া ব্যক্তিদের তালিকায় রয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান, তার ভাই সেলিম ওসমান, ছেলে ইমতিনান ওসমান অয়ন ও শ্যালক তানভীর আহম্মেদ টিটুও। অস্ত্র জমা না দেওয়ার তালিকায় নাম রয়েছে এই আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য সারাহ বেগম কবরীরও।

 


নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১৮ অক্টোবর শামীম ওসমানের নামে পয়েন্ট ২২ বোরের একটি রাইফেলের লাইসেন্স দেওয়া হয়। তিনি এই রাইফেলের লাইসেন্স ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর নবায়নও করেছেন। গত বছরের ২৬ অক্টোবর একটি এনপিবি পিস্তলের লাইসেন্স নেন তিনি। কিন্তু অন্তবর্তীকালীন সরকারের ঘোষণার পর বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে তিনি অস্ত্র দু’টি জমা দেননি। তার অস্ত্র দু’টি অবৈধ হিসেবে বর্তমানে জেলা প্রশাসনের তালিকাভুক্ত রয়েছে।

 


তার ভাই নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম সেলিম ওসমানও তার আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেননি। ২০২০ সালের ১ মার্চ তার নামে একটি পিস্তল ইস্যু করা হয়। তার নামে ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আরেকটি পিস্তলের লাইসেন্স দেওয়া হয়। এটিও তিনি জমা দেননি। শামীম ওসমানের ছেলে ইমতিনান ওসমান অয়ন তার শটগানটি এখনও জমা দেননি।

 


তার শ্যালক ও বিসিবির সাবেক পরিচালক তানভীর আহম্মেদ টিটুর নামে ২০১৫ সালের ১৫ নভেম্বর পয়েন্ট ২২ বোরের একটি রাইফেলের লাইসেন্স দেওয়া হয়। গত বছরের ৫ নভেম্বর পয়েন্টট ২২ বোরের একটি এনপিবি পিস্তলেরও লাইসেন্স পান তিনি। অস্ত্র দু’টি তিনি এখনও জমা প্রদান করেননি। শামীম ওসমানের বেয়াই (ছেলের শ্বশুর) ফয়েজউদ্দিন আহমেদ লাভলু তার লাইসেন্সপ্রাপ্ত শটগানটি এখনও জমা দেননি।

 


গত ১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়েছিলেন শামীম ওসমান ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী। তার নেতৃত্বে সন্ত্রাসী বাহিনীর অগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করার একটি ভিডিওচিত্র সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে। ওইদিন শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন, শ্যালক টিটু, বেয়াই লাভলু, তার ছেলে মিনহাজুল আবেদীনসহ অনুসারীদের গুলি করতে দেখা গেছে।

 


শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ অনুসারী মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম ও যুবলীগের ক্যাডার নিয়াজুল ইসলাম খানও সেদিন গুলি করেন। এর আগে ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি হকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে লক্ষ্য করে গুলি নিজাম ও নিয়াজুল। এই ঘটনায় দায়ের করা মামলা থেকে তাদের দু’জনকে পুলিশ অব্যাহতি দিলেও গত বছরের সেপ্টেম্বরে নিয়াজুলের পিস্তলের লাইসেন্স বাতিল করেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাহমুদুল হক।

 


এছাড়া শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমান ও তার বাহিনীর কাছেও রয়েছে একাধিক অবৈধ অস্ত্র। প্রায় সময় তারা অস্ত্র হাতে শহরে মহড়া দিতেন। যদিও আজমেরী ওসমানের কোনো অস্ত্রের লাইসেন্স ছিল না। গত বছর তিনি জেলা প্রশাসনের কাছে একটি শটগান ও পিস্তলের লাইসেন্সের আবেদন করেন কিন্তু পরে তিনি তা পাননি।

 


সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি বলেন, ‘ওসমান পরিবারের সদস্যরা এই শহরে অসংখ্য খুনের ঘটনার সাথে জড়িত। তাদের কখনও বৈধ অস্ত্রের প্রয়োজন হয়নি। কেননা তাদের কাছে অসংখ্য অবৈধ অস্ত্র রয়েছে, এসব অস্ত্র দিয়ে ছাত্র আন্দোলন চলাকালীনও গুলি চালিয়েছে।’ তিনি প্রশাসনের কাছে সকল অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি জানান।

 


এদিকে, সারাহ বেগম কবরীর নামে ২০১৩ সালের ২৭ মে একটি রিভলবারের লাইসেন্স ইস্যু করা হয়। এটি বর্তমানে জেলা প্রশাসনের অবৈধ ঘোষিত তালিকায় রয়েছে।

 


অস্ত্র জমা না দেওয়ার তালিকায় আছেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, তার স্ত্রী তারাব পৌরসভার সদ্য সাবেক মেয়র হাছিনা গাজী, বড় ছেলে গাজী গোলাম মূর্তজা ও ছোট ছেলে গাজী গোলাম আসরিয়াও। ২০১৭ সালে তাদের নামে চারটি শটগানের লাইসেন্স ইস্যু করা হয়। তাদের নামে পিস্তলের লাইসেন্সও ছিল। পিস্তলগুলোও তারা জমা দেননি।

 


রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আরিফুল হক ভূঁইয়াও তার নামে ইস্যু করা পয়েন্ট ২২ বোরের পিস্তলটি জমা দেননি। তিনি ২০১৩ সালের ৪ এপ্রিল অস্ত্রটির লাইসেন্স পেয়েছিলেন। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর এটি নবায়নও করেন।

 


অস্ত্র জমা দেননি রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামও। তার নামে ২০১২ সালের ২২ জানুয়ারি আগ্নেয়াস্ত্রটি ইস্যু করা হয়। তিনি সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর অস্ত্রটির লাইসেন্স নবায়ন করেছিলেন। তার নামে ২০১২ সালের ২৮ মে একটি পিস্তলের লাইসেন্স দেওয়া হয়। এটিও তিনি জমা দেননি।

 


অস্ত্র জমা দেননি জাতীয় পার্টির নেতা ও ব্যবসায়ী জয়নাল আবেদীন। তিনি মুন্সিগঞ্জ জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি। নারায়ণগঞ্জ জেলা থেকে তার নামে ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল একটি শটগানের লাইসেন্স দেওয়া হয়।

 


নারায়ণগঞ্জের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, ‘যারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র জমা দেননি, তাদের ওই অস্ত্রগুলো অবৈধ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান চলছে।’      এন. হুসেইন রনী  /জেসি