শনিবার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪   পৌষ ১৩ ১৪৩১

আমাদের নিক্ষেপ করা গ্রেনেডের স্প্রিন্টারে আমি আহত হয়েছিলাম

বীর মুক্তিযোদ্ধা রওশন আলী

প্রকাশিত: ১১ ডিসেম্বর ২০২২  

 

একাত্তরে ডিসেম্বর মাসে আমরা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। নতুন প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা তুলে ধরার জন্য এই বিজয়ের মাসে ‘দৈনিক যুগের চিন্তা’য় একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনের কাহিনী তুলে ধরা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা রওশন আলীর পায়ে গ্রেনেডের স্প্রিন্টার বিদ্ধ হয়ে আহত হওয়ার কাহিনী।  

 

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা রওশন আলী  : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা যারা পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি তাদের সবারই কোন না কোন ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান স্মৃতি হিসেবে মনের মনিকোঠায় রয়ে গেছে। আমি বেশ কয়েকটি অপারেশনে অংশ নিলেও একটি ঘটনা প্রায়ই আমার মনে ভেসে ওঠে। সে ঘটনাটি হচ্ছে একটি অপারেশনে আমাদেরই ছোড়া গ্রেনেডের স্প্রিন্টার আমার পায়ে লেগে আহত হয়েছিলাম। কিন্তু  সেই অপারেশনের উত্তেজনায় তখন এতটাই বিভোর হয়ে ছিলাম যে, পায়ে গ্রেনেডের স্প্রিন্টার বিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি তৎক্ষনাৎ টের পাইনি। অপারেশন শেষ করে যখন বেরিয়ে আসি তখন পায়ে ব্যথা অনুভব করি এবং পায়ের প্যান্ট উল্টে দেখি আমার পায়ে স্প্রিন্টার বিদ্ধ হয়ে পা রক্তাক্ত হয়ে গেছে। অবশ্য সেই স্প্রিন্টার আমাকে গুরুতর আহত করতে পারেনি। কিন্তু অল্পতে বেচে গেছি। স্প্রিন্টার গায়ে লাগলে হয়তো আমার মৃত্যু হতে পারতো।

 

 

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি গোদনাইল নৈশ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতাম। একই সাথে গোদনাইল বাজারে মুদি দোকান চালাতাম। তবে রাজনৈতিক ভাবে আমি ছিলাম ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) একজন সক্রীয় সমর্থক। ন্যাপের সব সভা-সমাবেশে আমি সক্রীয়ভাবে যোগ দিতাম।

 

 

একাত্তরের পঁচিশে মার্চে পাকিস্তান বাহিনী বাংলাদেশের মানুষের উপর গণহত্যার শুরুর পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরু করতে দেশের মানুষের প্রতি নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর  সেই ঘোষনার পর আমাদের এলাকার অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ভারতে চলে যেতে শুরু করেন। বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতা এবং ছাত্র নেতারা এলাকা ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণের জন্য ভারতীয় চলে যান। স্থানীয় নেতারা আমাকেও মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেন।

 

 

এক পর্যায়ে আমি এলাকা ছেড়ে আমাদের অন্যান্য নেতাদের সাথে ভারতে চলে যাই। তখন আমাদের সঙ্গে ছিলেন আলী হোসেন (পরে আমাদের গ্রুপ কমান্ডার) আব্দুল মতিন, মহিউদ্দিন মোল্লা এহসান কবীর রমজানসহ আরো কয়েকজন। সবার নাম এতদিন পর মনে করতে পারছিনা। আগরতলা যাওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের পাঠানো হয় আগরতলা থেকে অনেক দূরে পঞ্চবটি নামে একটি এলাকায়। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সেখানে আমাদের বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র চালনা, বোমা তৈরি এবং সে বোমা কিভাবে নিক্ষেপ করতে হবে তার প্রশিক্ষন দেয়া হয়। ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর আমরা অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে দেশে ফিরে আসি।

 

 

আমরা অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে ক্যাম্প ছেড়ে আসার সময় আমাদের প্রশিক্ষনের দায়িত্বে থাকা সিনিয়র অফিসার ক্যাপ্টেন নাসিম, যিনি পরে সেনাবাহিনী প্রধান হয়েছিলেন,  তিনি আমরা বাংলাদেশের প্রবেশ করার আগে আমাদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। তিনি আমাদেরকে বলেন যে, বাংলাদেশে গিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর চলাচল বন্ধ করা এবং তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে পর্যদস্ত করার জন্য যা করা দরকার সেসব অপারেশনের দিকে আমাদের বেশি নজর দিতে হবে।

 

 

তার সেই পরামর্শ অনুযায়ী আমরা বাংলাদেশে এসেই কি কি অপারেশন করলে পাকিস্তান বাহিনী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করি। এক পর্যায়ে পরিকল্পনা করি যে, নারায়ণগঞ্জ থেকে পাট রপ্তানী বন্ধ করতে পারলে পাকিস্তানিরা কিছুটা পর্যুদন্ত হবে। ইতিমধ্যে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি গ্রুপ খানপুরে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের পাটের গুদামে বোমা মেরে পাট গুদামটি পুরা ধ্বংস করে দিয়েছিল। একইভাবে আমরাও পরিকল্পনা করি যে আজিম মার্কেটে কো-অপারেটিভ পাট গোডাউনে অপারেশন করে ধ্বংস করে দেবো।

 

 

পরিকল্পনা অনুযায়ী একদিন রাত রাত ৯ টার দিকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের এলাকা থেকে হেঁটে কোঅপারেটিভ গোডাউনের দিকে যাই। গোডাউনের গেটে বেশ কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড ছিলেন। আমরা অস্ত্র উচিয়ে তাদেরকে সারেন্ডার করাই এবং সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য বলি। তারা অস্ত্র দেখে ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। তখন আমরা ভিতরে ঢুকি। আমার কাছে তখন একটি ব্যাগে গ্রেনেডে ছিল। ব্যাগে ছিল কয়েকটি আর্জেস গ্রেনেড এবং কয়েকটি স্মোক গ্রেনেড। এ গ্রেনেড আমরা পাট গোডাউন ধ্বংস করার জন্য ব্যবহার করবো বলে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমরা কোঅপারেটিভ মিলের ভিতরে গিয়ে কোন কোন গোডাউনে কত পার্ট আছে এবং কোন গোডাউনে বোমা নিক্ষেপ করলে সবচেয়ে বেশি পাট ধ্বংস হবে তা ঘুরে ঘুরে দেখি।

 

 

একপর্যায়ে আমার হাতে থাকা ব্যাগ থেকে একটি স্মোক গ্রেনেড নিয়ে প্রথমে মহিউদ্দিন গোডাউনের ভিতরে নিক্ষেপ করে। সে একটু বেশি সাহসী ছিল বলে গ্রেনেড নিক্ষেপের দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়। পাট গুদাম ধ্বংস করার জন্য আমাদের স্মোক গ্রেনেড নিক্ষেপ করাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মহিউদ্দিন বেশী উত্তেজিত হয়ে আমার হাতে থাকা ব্যাগ থেকে একটি থার্টি সিক্স আর্জেস গ্রেনেড নিয়ে গোডাউনের দিকে নিক্ষেপ করে দেয়। গোডাউনের ভিতর পাটের মধ্যে বিকট শব্দে আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। এরপর পুরো গুদামে আগুন ধরে যায় এবং কিছুক্ষনের মধ্যে গুদামটি সম্পূর্ন ধ্বংস হয়ে যায়।

 

 

অপারেশন সফল হওয়ার পর আমরা দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করে আমাদের এলাকায় চলে। কিন্তু গ্রেনেড নিক্ষেপের সময় আমি বুঝতেই পারিনি যে সেই গ্রেনেডের একটি স্প্রিন্টার ছুটে এসে আমার পায়ে বিদ্ধ হয়েছে। আমি তখন অপারেশনের জন্য এত উত্তেজনা ছিলাম যে, পায়ে স্প্রিন্টার বিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি  সঙ্গে সঙ্গে টের পাইনি। অপারেশন শেষ করে গোডাউন এলাকা থেকে বেরোনোর পর আমি পায়ে প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করি। তারপরে পায়ের ফুলপ্যান্ট উপরের দিকে তুলে দেখতে পাই আমার পায়ের মধ্যে স্পিন্টার বিদ্ধ হয়েছে এবং প্রচন্ড রক্তপাত হচ্ছে। আমরা এলাকায় এসে পানি দিয়ে ক্ষত স্থানটি ধুয়ে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখি। পরদিন সকাল বেলা গোদনাইল বাজারে রফিক ডাক্তারের কাছে আমি এই পায়ের ক্ষতটি দেখাতে যাই। তিনি ক্ষতটি দেখে জানতে চান এটা কিভাবে হলো। আমি তখন তাকে বলিনি যে কোঅপারেটিভ পাটের গোডাউনে অপারেশন করতে গিয়ে স্প্রিন্টার লেগেছে। আমি তাকে বলি একটি খুটির সাথে খোঁচা লেগে কেটে গিয়েছে। তিনি তখন ওষুধ দিয়ে এই পায়ে ব্যান্ডেজ করে দেন। আমি দুদিন রেস্ট নেয়ার পরে আর ব্যথা অনুভব করিনি। তখন আবার আরেকটি অপারেশনের জন্য পরিকল্পনা নিয়ে মেতে উঠি।

 

 

দেখতে দেখতে মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পেরিয়ে এলাম। এখনো যখন মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অপারেশনের কথা স্মরণ করি, তখন আমার মনে পড়ে কোঅপারেটিভ পাট গোডাউনে নিক্ষেপ করার গ্রেনেডের স্প্রিন্টার এসে আমার পায়ে এসে লেগে আহত হওয়ার ঘটনা। সেই স্প্রিন্টারের ক্ষত এখনো আমার পায়ে দৃশ্যমান।

এস.এ/জেসি
 

এই বিভাগের আরো খবর