একান্ত সাক্ষাৎকারে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব
প্রকাশ: ২২ মে ২০১৯, ০১:১৩ পিএম
মনির হোসেন : ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব বলেছেন, বাংলাদেশ ও ত্রিপুরার আর্থিক উন্নয়নের লক্ষ্যে অচিরেই সোনামুড়ায় নতুন বন্দর নির্মাণ করা হবে। উভয় দেশের উন্নয়নে যা কিছু করা দরকার সবই পর্যায়ক্রমে করা হবে বলে তিনি জানান।
সম্প্রতি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে এ প্রতিবেদককে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মেঘনা নদী দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত ছোট ছোট লঞ্চ, স্টীমার, জাহাজ আসছে। সেগুলোকে আমাদের সোনামুড়া পর্যন্ত আনার জন্য বাংলাদেশের সাথে আমাদের চুক্তিবদ্ধ হওয়ার ফাইল স্বাক্ষর হয়েছে। আগামী ১ বছরের মধ্যে ভারত সরকারের অর্থায়নে সোনামুড়াতে নতুন বন্দর নির্মণ করা হবে। এতে উভয় দেশের মানুষ আর্থিকভাবে লাভবান হবে। যা অতীতে হলদিয়া বন্দরে হতো এটা এখন চট্টগ্রাম ও আশুগঞ্জ বন্দরে হবে। মেঘালয়, মিজোরাম, আসাম ও ত্রিপুরা যতটা লাভবান হবে ঠিক ততটাই লাভবান হবে বাংলাদেশের।
ফেনী নদীর উপর ব্রীজ হচ্ছে উল্লেখ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সরকার চট্টগ্রাম বন্দরকে ব্যবহার করার অনুমতি প্রদান করেছে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ত্রিপুরা আসতে ট্রান্সপোর্টেশন খরচ কমে যাবে। অতীতে হলদিয়া বন্দর থেকে যোগাযোগখাতে অনেক পয়সা খরচ করতে হতো। কারণ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ত্রিপুরা মাত্র ৬৩ কিমি। আর হলদিয়া বন্দর থেকে আসামের গুহাটি হয়ে ত্রিপুরার দূরত্ব ১২২০ কিমি। তাই চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে দেয়ায় ট্রান্সপোর্টেশন খরচ অর্ধেকের নীচে নেমে আসবে।
চা-পাতার উপর গুরত্বারোপ করে বিপ্লব কুমার দেব বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে শ্রীলংকা থেকে চা-পাতা আমদানী করে। অথচ আমাদের ত্রিপুরাতে বড়মাত্রায় উন্নত চা-পাতা হয়। কিন্তু আমাদের চা-পাতা বাংলাদেশে পাঠাতে ৮০% ডিউটি ফি দিতে হয়। এই ডিউটি ফি কম হলে ত্রিপুরা থেকে ১০ থেকে ১৫ হাজার মেট্রিক টন চা-পাতা বাংলাদেশে পাঠাতে পারি।
তিনি বলেন, ডিউটি ফি বৃদ্ধির ফলে অবৈধ বিজনেস যারা করে তারা কোন না কোন ভাবে চা-পাতা বর্ডার ক্রস করে দেয়। এতে আমরা সবাই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। তাই অবৈধ বিজনেসকারীদের সুযোগ বন্ধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের কাছে ডিউটি ফি কমানোর জন্য আমরা প্রস্তাব পাঠিয়েছি। আশা করি ইতিমধ্যে ঐ প্রস্তাব এগ্রিড হয়েছে। ফলে আমরা বাংলাদেশে বৈধভাবে ১০থেকে ১৫হাজার মেট্রিক টন চা-পাতা পাঠাতে পারব। আর শ্রীলংকা থেকে চা-পাতা আনতে বাংলাদেশের যে পরিমাণ ট্রান্সপোর্টেশন খরচ লাগতো সেটাও কমে আসবে।
বাংলাদেশের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি ত্রিপুরা রাজ্য সরকারও সে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে উল্লেখ করেন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, নর্থইস্টে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি রয়েছে। নর্থইস্টকে আরও উন্নত করতে হলে উভয় দেশের আর্থিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করতে হবে।
বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের উন্নতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, আমরাও আমাদের টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিকে আরও ডেভলাপ করে দিব। তিনি বলেন, অচিরেই ত্রিপুরাতে স্পেশাল ইকোনোমিক জোন (ঝঊত) করা হবে। এতে অর্থনৈতিকভাবে দু’দেশই লাভবান হবে বলে আমি মনে করি।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, অতীতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা থেকে বাংলাদেশে পণ্যবাহী ট্রাক বর্ডারে লোড-আনলোড করতে হতো। এখন বাংলাদেশের পণ্যবাহী ট্রাকগুলো ত্রিপুরা বর্ডার ক্রস করে আরো ৩কিমি ভিতরে এসে সরাসরি আগরতলা গোল বাজারে চলে আসছে। ফলে লোড-আনলোডের অতিরিক্ত খরচ কমে গেছে।
অতীতের ত্রিপুরার কমিউনিস্ট সরকার বাংলাদেশে মাদক পাচার করে অবৈধ বিজনেসের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এই অবৈধ বিজনেসে বাংলাদেশ ও ত্রিপুরা উভয় দেশের লোকজন জড়িত ছিল। আর এগুলোকে আমাদের দেশ থেকে তৎকালীন সময়ে পলিটিক্যালি শেল্টার দেয়া হতো। কিন্তু আমাদের ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার ক্ষমতায় আসার পর এগুলোকে শক্ত হাতে দমন করেছি। বিশেষ করে এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার অবৈধ বিজনেস আমি বন্ধ করে দিয়েছি।
অতীতের ত্রিপুরার কমিউনিস্ট সরকার মুখে মুখে বাংলাদেশ প্রীতি দেখালেও বাংলাদেশের নিউ জেনারেশনকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য বাংলাদেশে মাদক দ্রব্য পাচারের ক্ষেত্রে ত্রিপুরাকে রোড বানিয়েছিল। এই ত্রিপুরা দিয়েই হিউজ গাজা, ইয়াবা টেবলেট, ইনজেকশন ও ফেন্সিডিলসহ নেশা জাতীয় মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে যেতো। আমি দয়িত্বভার গ্রহণ করার পর এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। ইতিমধ্যে এই অপকর্মের সাথে জড়িত ৬২৫জন কে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ২৫০ জনেরও বেশি জেলে বন্দি রয়েছে। শতশত নেশা জাতীয় মাদক দ্রব্য উদ্ধার করে তা ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।
বিল্পব কুমার দেব মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করার কথা স্মরণ করে বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা ঐ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের কাজে বাংলাদেশের ১ইঞ্চি ভূমিও ব্যবহার করতে দিব না। যা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই জিরো টলারেন্স এর কারণেই নর্থইস্টে শান্তির হাওয়া বইছে। যার সুফলে আমরা সবাই ভোগ করছি।
তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বেশ কিছু অর্জনের কথা স্মরণ করে বলেন, বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ। আজ বাংলাদেশের চাউল অন্য দেশে বিক্রি হচ্ছে শুনে বেশ অবাক লাগে। অতীতে এরশাদ সরকার টানা ৯-১০ বছর ক্ষমতায় থেকেও এ কাজ করতে পারেনি। এটা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণেই সম্ভব হয়েছে। গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির কারণে সারা দুনিয়া আজ বাংলাদেশকে চিনে। গার্মেন্টস শিল্পকে ঢেলে সাজানো এটাও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বড় পদক্ষেপ বলে তিনি মনে করেন।
মুসলিম প্রধান দেশ হওয়া স্বত্বেও জন্ম নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ এক নম্বরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাা সবাইকে নিয়ে অত্যন্ত সফলভাবে এ কাজটি করতে সক্ষম হয়েছেন। কারণ এ বিষয়ে কোন মৌলভী, ইউনিভার্সিটি প্রফেসর বা কোন রাজনৈতিক ব্যাক্তি কেউ এর কোন সমালোচনা করে নাই। অথচ ত্রিপুরায় এ কাজটা করতে গেলে মুসলিম মাইনোরিটিরা আপত্তি করে বসেন। তারা বলে বসেন এটা ইসলামে নেই। সে দিক দিয়ে নিঃসন্দেহে বলা যায় এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক ও সাহসী পদক্ষেপ।
উভয় দেশের প্রতি আমাদের প্রেম ভালবাসা অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেব বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী এক সাথে দু’দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। যা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।