মঙ্গলবার   ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪   আশ্বিন ১ ১৪৩১

ওসমান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ প্রেতাত্মাদের হাতে

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪  

 

 

শিল্পাঞ্চল হিসেবে হিসেবে খ্যাতি রয়েছে নারায়ণগঞ্জে। ব্রিটিশ আমল থেকেই নারায়ণগঞ্জ গোটা দেশের অন্যতম ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে প্রসিদ্ধ। সময়ের পটপরিবর্তনে দেশের নাম করা ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোর প্রাণকেন্দ্রও এই নারায়ণগঞ্জ। বিকেএমইএ, ইয়ার্ন মার্চেন্ট এসোসিয়েশন, হোসেয়ারি এসোসিয়েশন, নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স, জুট এসোসিয়েশসহ প্রায় শতের কাছাকাছি ব্যবসায়িক সংগঠন রয়েছে নারায়ণগঞ্জে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছরের বেশি অধিক এই ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোতে ওসমানপরিবারের কালো থাবা পড়েছে। 

 

বেশিরভাগ সংগঠনেরই নির্বাচন ছাড়াই ওসমানদের নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিদের হাতে নেতৃত্ব ছিল। তাদের নিয়ন্ত্রিত নেতৃত্বে নানা উৎসব-উপলক্ষ্য, কারণ ছাড়াই ব্যাপক চাঁদাবাজির শিকার হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এনিয়ে কোন আওয়াজ করারও সাহস পায়নি কেউ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনে ওসমান সাম্রাজ্যের কর্তা ব্যক্তি শামীম ওসমান, সেলিম ওসমান, অয়ন ওসমান, আজমেরী ওসমানসহ পরিবারের সকলে গা ঢাকা দিয়েছে। তাদের অন্যতম সহযোগি হিসেবে নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়িক সেক্টর নিয়ন্ত্রণের হর্তাকর্তা ছিলেন নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজল। 

 

মূলত সেলিম ওসমান ও শামীম ওসমান প্রশাসনিক নানা তদবির, বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্বে কারা আসবেন সেটি নির্ধারণ করতেন এই কাজল। কাজলের ঈশারায় বহু ব্যবসায়ী নারায়ণগঞ্জ ছাড়া হয়েছেন, আবার কেউ কেউ কোন ব্যবসা ছাড়াই  বিভিন্ন সংগঠনের কর্তাব্যক্তি বনে গেছেন। ওসমানদের সাথে পালিয়েছেন খালেদ হায়দার খান কাজলসহ বেশ কয়েকজন ওসমানদের চাটুকার। তবে ওসমানদের সাথে গত ১৬ বছর যারা আষ্টেপিষ্টে ছিলেন তারা ওসমানদের দখলে থাকা নেতৃত্বের ওদল-বদল করেই দায় সারছেন। 

 

এনিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যবসায়ীদের মাঝে একদিকে ক্ষোভ আবার অন্যদিকে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা বলছেন, ২০১০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর থেকে বিকেএমইএর সভাপতির পদে ছিলেন সেলিম ওসমান। সর্বশেষ ২০১২ সালে ভোটের মাধ্যমে সভাপতি হন তিনি। তারপর ২০১৪, ২০১৬, ২০১৯, ২০২১ ও ২০২৩ সালে সমঝোতার মাধ্যমে পর্ষদ করে সভাপতি হন সেলিম ওসমান। কিছুদিন আগে বিলুপ্ত জাতীয় সংসদে তিনি নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সদস্য ছিলেন। 

 

তাঁর ভাই শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন। বিকেএমইএতে প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের কারণে টানা পাঁচবার সমঝোতার মাধ্যমে পর্ষদ গঠন করা হলেও সংগঠনের উদ্যোক্তারা চুপচাপ ছিলেন। তাদের সেসব পর্ষদের কারা ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কারা শামীম ওসমান, সেলিম ওসমানের নাম ভাঙিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলতেন। ইয়ার্ন মার্চেন্টে কারা জুয়ার আসর বসিয়েছেন। খালেদ হায়দার খান কাজল  কাদেরকে বিনা নির্বাচনে বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্ব ওসমানদের কথায় তুলে দিতেন। এখন তারাই আবারো নির্বাচন ছাড়াই ওসমানদের ঘনিষ্ঠজনদের মাঝেই নেতৃত্ব অদল-বদল করছেন।

 

বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, নিতাইগঞ্জের বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারা সেলিম ওসমানের কথাতেই ব্যবসায়ীদের উপর নানা খড়গ চালাতেন। এমনকি নির্বাচনের নামে সিলেকশন করতেন। বিভিন্ন উছিলায় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করতেন। ইয়ার্ন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি লিটন সাহা তো শামীম ওসমান, সেলিম ওসমানকে বাবা, বাবা বলে সম্বোধন করতেন। তাদেরকে বাবা বলে ডাকতেন এমন লোকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। 

 

তাদের সংস্পর্শে থেকে যাকে তাকে তারা লাঞ্ছিত করতেন, চাঁদা আদায় করতেন। এমনকি নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের মতো অভিজাত এলিট ক্লাবে নির্বাচন করতে সাহস পেতো না ব্যবসায়ীরা। শামীম ওসমান, সেলিম ওসমানের ঘনিষ্ঠজনরাই নির্বাচনের নামে সিলেকশনে নেতৃত্বে থাকতেন। সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ভিডিও শামীম ওসমানের শ্যালক তানভীর আহমেদ টিটুর সাথে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সহসভাপতি এস.এম রানাও গুলি চালিয়েছে। লিটন সাহাও হত্যা মামলার আসামি হয়েছে। ওসমানরা বিতাড়িত হওয়ার পর দূর থেকে তাদের ঘনিষ্ঠজনেরাই আবার সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে এসে ওসমানদের পারপাস সার্ভ করার মিশনে নেমেছে।  

 

সূত্র জানায়, হোসিয়ারি ব্যবসার জন্য বিখ্যাত ছিল নারায়ণগঞ্জ। অথচ হোসেয়ারি সমিতিতে কাগজপত্র ছাড়াই সদস্য বাড়িয়ে ওসমানদের কথায় বারবার বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক ১৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নাজমুল আলম সজল। ওসমানদের সিন্ডিকেটে থাকার দরুণ সেলিম ওসমান, শামীম ওসমানের বাইরে কাউকে নির্বাচনের মনোনয়নপত্র পর্যন্ত কিনতে দেয়া হতো না। কেউ মনোনয়নপত্র কিনতে চাইলে টর্চার সেলে টর্চার করার অভিযোগও ছিল দেদারচে।

 

সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজল, নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক পদেও ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এই ক্লাব থেকে শূট্যারদের অস্ত্র বিভিন্ন সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দেয়া হয়। মাত্র ৪টি অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এখনো প্রায়ত ১৫০টি অস্ত্র বাইরে সেসব লোকের কাছে আছে বলে জানিয়েছে ক্লাব কর্তৃপক্ষ। অথচ কাজলের ঘনিষ্ঠরাই এখন তার ঈশারায় নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়িক সেক্টরগুলোর নেতৃত্ব নেয়ার কৌশল অবলম্বন করছে।

 

 এদেখে ব্যবসায়ীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। তারা বলছেন, ওসমানদের প্রেআত্মারাই ব্যবসায়িক সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে নেওয়ার নানা কৌশর করছে। কোন নির্বাচন কিংবা ব্যবসায়ীদের মতামত না নিয়েই তারা লোকদেখানো পরিবর্তন বুঝানোর চেষ্টা করছে।

 

উদাহরণ হিসেবে তারা বিকেএমইএ’র সহ-সভাপতি মোরশেদ সারওয়ার সোহেলের কথা টানছেন। ব্যবসায়ীরা বলেন, এই মোর্শেদ সারোয়ার সোহেল, খালেদ হায়দার খান কাজলের মতোই ওসমানদের ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন গত ১৫ বছর ধরে। নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতি, আদালত, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ওসমানদের কথা মতো প্রভাবিত করা, বিভিন্ন নির্বাচনে কাজলের মতোই সেলিম ওসমানের টাকা পৌঁছানো। বার ভবনের নাম পরিবর্তনে প্ররোচনা দেয়াসহ অনেক কর্মকাণ্ডে ছিলেন প্রকাশ্য। সেলিম ওসমানের হয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা উঠানোর দায়িত্ব ছিলো তাঁর উপর জানান ব্যবসায়ীরা। এছাড়া ব্যবসায়ীদের ডাটা কালেকশন থেকে শুরু করে চাপ প্রয়োগ করা সব ছিল তার নিয়ন্ত্রণে।

 

 ওসমানরা ভেগে গেলেও তাঁদের প্রেআত্মারা রঙ বদলাচ্ছে। তারাই আবার ব্যবসায়ী ও উদ্যেক্তাদের জিম্মি করে আগের মতোই তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে ক্ষুব্ধ বিভিন্ন সংগঠনের ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, সংস্কার বলতে তো শুধু লোক বদল নয়, নেতৃত্ব আসবে নির্বাচনের মাধ্যমে, সকল ব্যবসায়ীদের মতামতের ভিত্তিতে। তারা যে লোক বদলাচ্ছেন দেখাচ্ছেন, সেটি কি সকল ব্যবসায়ীদের মতামতের ভিত্তিতে হচ্ছে, 

 

নাকি আড়ালে থাকা ওসমানদের প্রেআত্মা হয়ে করছেন। তারা জোর দিয়ে বলেন, গত ১৫ বছর নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীক সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে এই বেহাল দশার পেছনে কারা ওসমানদের কাঁধে ভর করে ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে রেখেছিলেন তাদের আমলনামাও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের দৃষ্টি দিতে বলেন।

 

আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, খালেদ হায়দার খান কাজলের ভাগ্নি নারায়ণগঞ্জ মহনগর যুব মহিলা লীগ নেত্রী এড. সুইটি ইয়াসমিনের স্বামী মাসুম ডায়িংগুলোতে কত বড় সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন সেটি তলিয়ে দেখতে গেলেই থলের বেড়াল বেরিয়ে আসবে। নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে রামু সাহার সাথে ওসমানদের ঘনিষ্ঠতা, তৎপরতা বিশ্লেষণ করলে ব্যবসায়ীদের নানা হাল-হকিকত সম্পর্কে ভীতিকর তথ্য বেরিয়ে আসবে। সেলিম ওসমান, শামীম ওসমান, শামীম ওসমানের শ্যালক তানভীর আহমেদ টিটুর বন্ধু ফজর আলী, 

 

এসএম রানাসহ ব্যবসায়িক পার্টনার পরিচয়ে ব্যবসায়িদের উপর কারা নানা সময়ে নানা নির্যাতন করেছেন, অরাজকতা তৈরি করেছেন, সুবিধা নিয়েছেন, চাটুকারিতা করেছন তা কারো অজানা নয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ওসমান পরিবারও গা ঢাকা দিয়েছে। কিন্তু তাদের দোসররা সরে যাওয়ার সময় পাননি। যারা ফলে ওসমানদের পক্ষে তারাই ওসমানদের প্রেআত্মা হয়ে ওসমানদের দখলে থাকা বিভিন্ন সংগঠন-প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক থেকে গত ১৫ বছরের নির্যাতন, জুলুম অব্যাহত রাখার কৌশল অবলম্বন করেছেন। যদিও উদ্যোক্তারা বলছেন, ওসমানদের প্রেআত্মাদের সেই কৌশল কখনোই সফল হবার নয়। ওসমানদের পেআত্মারা সকলের কাছেই চিহ্নিত।

এই বিভাগের আরো খবর